ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৩
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
মাকে একটা গ্লাস দেয় বিথীকা। একটা বালিশ ছিঁড়ে তুলা বের করে। ঘরে কলাপাতা ছিল। কলাপাতার উপর তুলা বিছিয়ে ওখানে ভাইকে রেখে সুন্দর করে মুড়িয়ে কোলে রাখে। পাশের ঘরের একজন মহিলা বিথীকাকে সহযোগিতা করে। মহিলা বালিশের পরিষ্কার তুলা ছিঁড়ে গ্লাসে রাখা মায়ের দুধে ভিজিয়ে বিথীকাকে দেয়। বিথীকা ভাইয়ের মুখে তুলোটা দিলেই ও চুষতে শুরু করে। চোখ বন্ধ ছিল। দুধ চোষার সঙ্গে সঙ্গে চোখ খোলে। ওর দিকে তাকিয়ে মায়ারাণী চিৎকার করে বলতে থাকে, আমার স্বাধীনতা, আমার স্বাধীনতা। মাগো তোকে আমি আশীর্বাদ করি। তুই ছেলেটাকে বাঁচিয়ে এনেছিস। আহারে, তুই হ্রদের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে তুলে এনেছিস। তুই বিশ্বাস করিসনি যে মরে গেছে। হায় ভগবান!
– মা, কাঁদতে হবে না। চুপ করে শুয়ে থাক। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হও। একটানা পাঁচদিন এভাবে দুধ খাইয়ে বিথীকা ভাইকে আদর-যত্নে ভরিয়ে রাখে। শরণার্থী ক্যাম্পের সবার মুখে বিথীকার নাম। মৃত ভেবে যারা বাচ্চাটিকে হ্রদের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল তারা ক্যাম্প থেকে বের হয়না। নিশ্চুপ বসে থাকে। কিভাবে তারা এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল ভেবে অবাক হয়। মাঝে মাঝে অন্য তিনভাই ওকে ঘিরে ধরে বসে থাকে। বিথীকা ওদের ছাড়া আর কাউকে ওর পাশে আসতে দেয়না। কেউ ঢোকার সাহস পায়না। সবাই মিলে ভাবে কত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল এই শরণার্থী ক্যাম্পে। সব ঘটনা স্মৃতি হয়ে বুক ভরে থাকে বিথীকার। ওর প্রশংসায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে শরণার্থী ক্যাম্পের মানুষরা। এই দুঃসাহসী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সবাই বলে, এমন মেয়ে আমরা কখনো দেখিনি। বিথীকা প্রশংসায় আপ্লুত হয়না। ভাবে, ছোট্ট ভাইটিকে বাঁচিয়ে তুলেছি এটা আমার দায়িত্ব। এখন থেকে আমি চার ভাইয়ের বড় বোন। আমার জীবন ধন্য। শরণার্থী ক্যাম্পে জীবনযাপন অন্যরকম হয়ে যায়। মা ঠিকমতো সুস্থ হলে ও মুক্তিযুদ্ধের কাজ করবে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করবে। একটি শিশুকে বাঁচানোর জন্য ও হ্রদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নিজেই ডুবে যাবে কিনা সেটাও ওর মাথায় আসেনি। মুক্তিযুদ্ধে এভাবেই কাজ করতে হবে। অসুস্থ যোদ্ধাদের সুস্থ করে ফেরত পাঠাতে হবে যুদ্ধক্ষেত্রে। তবেই শরণার্থী জীবন হয়ে উঠবে যুদ্ধের জীবন। নিজের সঙ্গে কথা বলে উৎফুল্ল হয় বিথীকা। মায়ের কাছে এসে বসে। তিনভাই মায়ের পাশে বসে আছে। ছোট্ট ভাই মায়ের কোলে। ওকে ঢুকতে দেখে তিন ভাই নড়েচড়ে বসে ওকে জায়গা দেয়। ওর মা বলে, এই ছেলেটার একটা নাম ঠিক করতে হবে রে। এখন থেকে ওই নাম ধরে ওকে ডাকব আমরা।
– আমি ওর জন্য একটা নাম মনে মনে ঠিক করে রেখেছি।
– বল, আমাকে বল।
– ওর নাম হবে অসীম।
– সুন্দর, সুন্দর। সবাই মিলে হাততালি দেয়।
অমল বলে, আমার সঙ্গে ওর নামের মিল আছে। অমল আর অসীম আমরা দুই ভাই।
নিরঞ্জন হাততালি দিয়ে বলে, আমরা চার ভাই। চার ভাই।
কৃষ্ণপদ হাসতে হাসতে বলে, আমরা চার ভাই এক বোন। অসীম আমাদের মায়ের স্বাধীনতা। দেশ স্বাধীন হলে আমরা ওকে নিয়ে দেশে যাব। ও আমাদের জয় বাংলা।
সবাই মিলে হাসে। হাসতে হাসতে মুখর হয় শরণার্থী শিবিরের একটি ঘর। বাইরে থেকে হাসির শব্দ শুনতে পায় হরেন্দ্রনাথ। ছেলেমেয়ের উচ্ছ্বাস তাকে আপ্লুত করে। দ্রুত ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। দরজা ঠেলে ঢুকলে হাসির রেশ বেড়ে যায়।
কৃষ্ণপদ একলাফে উঠে দরজার কাছে এসে বলে, বাবা, এসো এসো। আমাদের জয় বাংলা তোমার জন্য হাত-পা নাড়ছে।
– তোরা কি ওকে জয় বাংরা ডাকবি নাকি?
বিথীকা বলে, জয় বাংলার সময়ের ছেলে বলে ওর পরিচয় হবে। ওর নাম রেখেছি অসীম।
– বাহ্, সুন্দর নাম। ওকে আমার কোলে দে। বাইরে থেকে ঘুরিয়ে আনি।
– নাগো, কয়দিনের ছেলে মাত্র। ওকে বাইরে নিওনা।
– ভয় পেয়োনা তুমি। ও হ্রদের জলে ঘরে আসা সাহসী ছেলে।
আবার হাসির শব্দ ওঠে। সবাই মিলে একসঙ্গে হাসতে থাকে। শরণার্থী শিবির এমন আনন্দের জায়গা হবে বড়রা কেউ ভাবতে পারেনি। ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে যায় হরেন্দ্রনাথের। এই শরণার্থী শিবিরে থেকে জীবনের বিপুল অনুভব তাকে আন্দোলিত করে। সামনে আসছে স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের নানা খবরে উদ্বুদ্ধ হয়ে যায় দিনের রশি। ভারতের সহযোগিতা বিচিত্র সম্ভারে পূর্ণ করে রাখছে মুক্তিযুদ্ধকে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বেশ অনেকটি শরণার্থী শিবির দেখে গেছেন। সবাইকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। সামনের বিশাল ছবি হরেন্দ্রনাথকে নানা দিগন্তে উদ্ভাসিত করে রাখে। হরেন্দ্রনাথ মনে মনে প্রণাম করে ইন্দিরা গান্ধীকে। হাসিতে নিজেকে উচ্ছ্বল করে তোলে। চারদিকে কেউ নাই। তাই জোরে জোরে বলে, মাগো, তোমাকে আমি মায়ের মতো শ্রদ্ধা করব পুরো জীবন ধরে। তুমি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছ। মাগো, মাগো, তুমি আমার মা হয়ে থাকলে আজ থেকে–ইন্দিরা মা। একটু পরেই দেখতে পায় রাস্তার ধারে বসে এলাকার একজন ট্রানজিস্টারে খবর শুনছে।
হরেন্দ্রনাথকে হাঁটতে দেখে ডেকে বলে, ও শরণার্থী দাদা, এদিকে আসেন। বিবিসিতে আপনার জন্য খবর আছে। বসেন খবর শোনেন। তখন ভেসে আসে কন্ঠস্বর–পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং সামরিক আইন প্রশাসক লেটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান যেসব শরণার্থী ভারতে পালিয়ে গেছেন, তাঁদের ঘরে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশের আর সব নাগরিকের মতো তাঁরাও একইভাবে বসবাস করতে পারবেন। গভর্নরকে উদ্ধৃত করে রেডিও পাকিস্তাান জানিয়েছে, রাজনৈতিক নেতাসহ ছাত্র, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মচারী, সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রাক্ষাকারী সংস্থার সদস্যদের স্বদেশে স্বাগত জানানো হবে।
জেনারেল টিক্কা খান বলেছেন, সীমান্তে শরণার্থী অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, সেখানে খাবার, আশ্রয়, চিকিৎসা ও যানবাহনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। মিথ্যা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণার প্রভাবিত হয়ে শরণার্থীরা দেশ ত্যাগ করেছেন এবং এখন অকারণে অপুষ্টি ও রোগে-শোকে ভুগছেন। বিবিসির কমনওয়েলথ সংবাদদাতা বলেছেন, জেনালেন টিক্কা খানের এই বিবৃতির যথার্থতা নিয়ে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সন্দিহান। আমাদের প্রতিনিধি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে বিপুলসংখ্যক লোকের চলে আসায় পাকিস্তানে যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, তারই প্রতিক্রিয়ায় জেনারেল এই বক্তব্য দিয়েছেন।
(চলবে)
এসএ/