ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১১
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
মায়ারাণী সবাইকে রুটি আর কলা দেয়। সবাই যে যার মতো খেতে থাকে। খেতে খেতে সূর্যের ছড়িয়ে পড়া দেখে। অজয় মাঝি খেতে খেতে নৌকা চালিয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকে নদীপথ। কখনো নদীর তীরে থেমে ভাত-তরকারি রান্না করে খেয়ে পাড়ি দেয়া হয়ে যায় নদীপথ। ইন্ডিয়ার স্বরূপনগর ব্রিজের নিচে একটি চরে নেমে পড়ে সবাই। নৌকা ছেড়ে দেয়। অজয় মাঝি বলে, যাই। আপনারা দেশে আসলে আবার দেখা হবে।
মায়ারাণী দরদী কন্ঠে বলে, বাবারে, যদি যুদ্ধ করার সুযোগ পাও, যুদ্ধে যেও।
–যাবো মাগো যাবো। দেশ স্বাধীন করার মন্ত্র আমার বুকের ভেতর আছে।
বীথিকা চেঁচিয়ে বলে, হুররে, হুররে –জয় বাংলা –জয় বঙ্গবন্ধু।
চরে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় লোকেরা বলে, জয় বাংলা। জয় বাংলার সবাই আসুন। আপনাদের জন্য ত্রাণসামগ্রী রেখেছি।
হরেন্দ্রনাথ বলে, কি সুন্দর চর এলাকা। আমাদের দেশেও এমন অনেক চর আছে।
–তাহলে বোঝেন আপনারা নিজের দেশের মতো জায়গায় সময় কাটাবেন।
বীথিকা হাসতে হাসতে বলে, হ্যাঁ, ঠিক। মনে হবে নিজের দেশের মাটির আপনজনের মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছি। নদীর ধার থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সবাই। একটি কুঁড়েঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘর থেকে বেরিয়ে আসে গোপাল সাহা। বলে, এটি আমার ঘর। আপনারা দুদিন এই ঘরে থাকবেন।
–আপনি কোথায় থাকবেন?
–আমার ব্যবস্থা আছে। একটি ঘর খালি রেখেছি আমরা শরণার্থীদের জন্য। এই চরের সবাই মিলে আমরা এই আয়োজন করেছি। এখন আপনাদের খাবার আসবে সুখরঞ্জনের বাড়ি থেকে। আপনারা ঘরে ঢুকে বসুন।
মায়ারাণী সবার আগে ঢুকে পড়ে। হরেন্দ্রনাথ সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়। চলে যায় লোকজন। কেউ কেউ বলে, একটুপরই আসছি।
মায়ারাণী দেখতে পায় ঘরের মেঝেতে পাটি পাতা আছে। এক কোণায় চাদর-বালিশ আছে। ঘুমুনোর সময় ব্যবহার করা হবে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে পাটির উপর বসে থাকে মায়ারাণী। বুকের ভেতর গভীর প্রশান্তি ছড়ায়। মনে হয় বেঁচে থাকার স্বস্তি পাওয়া হলো। এখন স্বাধীনতার জন্য কাজ করার পথ খুঁজে নিতে হবে। পরক্ষণে ভাবনা থমকে যায়, এজন্য যে গর্ভের সন্তান নড়ে ওঠে। বিব্রত বোধ করে মায়ারাণী। এই সন্তানের জন্মের দুই মাস বাকি আছে। তার আগে কিছু করা যাবে না। বীথিকা কাছে এসে বসে। বলে, মা কি ভাবছো?
–যুদ্ধ করার কথা ভাবছি।
–কেমন করে যুদ্ধ করবে?
–যুদ্ধের পক্ষে নানা কাজ করব। এটা আমার যুদ্ধ হবে। থাক আর কথা বলিস না।
খাবার নিয়ে ঘরে ঢোকে দুই-তিনজন মহিলা। নিজেরাই থালায় ভাত-তরকারি দিয়ে সবার দিকে এগিয়ে দেয়। একজন মায়ারাণীর দিকে তাকিয়ে বলে, আপনার জরুরি কিছু দরকার হলে আমাদেরকে বলবেন। এই ঘরের পেছনে পেসাব-পায়খানার জায়গা আছে। আপনারা কোথা থেকে আসছেন?
–খুলনার শ্রীনগর গ্রাম থেকে।
–কিভাবে এসেছেন?
–নৌকায়।
–কতক্ষণ লেগেছে আসতে?
–চারটা নদী পার হয়ে আসতে তিনদিন তিনরাত লেগেছে।
–ওহ বাবা। অনেক কষ্ট হয়েছে না?
–না, না তেমন কষ্ট হয়নি।
পাশ থেকে হরেন্দ্রনাথ উত্তর দেয়।
–এখান থেকে কোথায় যাবেন?
–আপনারা বলেন শরণার্থী ক্যাম্প কোথায় আছে?
আর একজন নারী সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমাদের কেউ কেউ আপনাদেরকে দিয়ে আসবে বশিরহাট ক্যাম্পে।
–আমরা কি কালকে যেতে পারব?
–না, আর একদিন থাকেন। দম ফেলেন। এই ঘরে চাদর বিছিয়ে গড়াগড়ি করে ঘুমাবেন। এই মেয়ে তোমার নাম কি?
–বীথিকা। ওর নাম কৃষ্ণপদ, ও নিরঞ্জন, ও অমল।
–দেখতে পাচ্ছি সামনে আর একজন আসছে।
–হ্যাঁ, আমি একটা বোন চাই। বোন পেলে আমার খুশির সীমা থাকবেনা।
–ভালোই বলেছো মা।
–তিনটি ভাইয়ের সঙ্গে আমার দিন সুন্দর কাটে।
–যুদ্ধের কথা মনে হয় না?
–হ্যাঁ, হয়। আমি এখানে কোথাও সুযোগ পেলে অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং নেব। তারপর যুদ্ধ করব।
–সাবাস মেয়ে, সাবাস। জয় হোক তোদের।
বীথিকা চেঁচিয়ে বলে, ‘জয় বাংলা’।
এলাকার মহিলারাও ‘জয় বাংলা’ বলে উঠে দাঁড়ায়।
–আমরা এখন যাচ্ছি। কালকে দেখা হবে।
বেরিয়ে যায় সবাই।
হরেন্দ্রনাথ বিস্মিত কন্ঠে বলে, এই চরেরর লোকেরা কেমন আন্তরিকভাবে আমাদের গ্রহণ করেছে। ওদের ঋণ শোধ হবার নয়।
–ঠিক বলেছ বাবা। একটা কুঁড়েঘর খালি রেখেছে শরণার্থীদের জন্য।
–আমাদের মাথার উপর হাত দিয়ে রেখেছে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর নির্দেশ না থাকলে এরা আমাদের এমনভাবে গ্রহণ করতে পারতনা।
–না বাবা, এটা শুধু সরকারি নির্দেশ না, নিজেদের চেতনাও আমাদের জন্য কাজ করছে। নইলে আমরা এমন আন্তরিকতা পেতামনা। আমি এখন তিন ভাইকে নিয়ে পুরো চরটা ঘুরে ঘুরে দেখব।
–জলের ধারে বেশি যাবিনা। এরা তিনজনে যেন হুড়মুড়িয়ে জলে না নামে।
–হ্যাঁ মা, সাবধানে ঘুরব। আমরাতো এমন চর কখনো দেখিনি।
–আচ্ছা ঘুরে আয়।
বীথিকা ভাইদের নিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। এদিক-ওদিক দৌড়ে ব্রিজের নিচে এসে দাঁড়ায়। দেখতে পায় চরের ওপাশ থেকে এপাশে ব্রিজটা চলে গেছে। বীথিকার মনে হয় কালকে ওরা যখন যাবে তখন এই ব্রিজ পার হয়ে যাবে। পরক্ষণে ভাবে, নাও হতে পারে। দেখতে পায় দূরে বাবা দাঁড়িয়ে আছে। ওরা একদৌড়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
বীথিকা বলে, বাবা এই চরটা কি সুন্দর!
–হ্যাঁ মা, খুব সুন্দর। আমি এখানে দাঁড়িয়ে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছি। দেশ স্বাধীন হলে আমরা এখানে বেড়াতে আসব। এখানকার মানুষেরা খুব ভালো। সবাই আমাদেরকে কত মায়া দেখাল।
–ঠিক বলেছো বাবা। আমরা এখানে শুধু বেড়াতে আসব না। একদিন দুপুর বেলা এদের জন্য খাওয়ার আয়োজন করবো। পারবে না?
–পারব। তোর মায়ের কাছে টাকা রাখব। তোর মা জমিয়ে রাখবে। সবাইকে খাওয়াতে অনেক টাকা লাগবে।
–তা লাগবে বাবা। আমরা সবাই মিলে খরচ কমিয়ে ফেলে টাকা জমাব।
–ঠিক বলেছিস মা। দেশ স্বাধীন হলে আমাদের একবার আসতে হবে।
–যাই আমরা চরের ওই দিকটা দৌড়ে আসি। তিন ভাইয়ের হাত ধরে বীথিকা দৌড়াতে থাকে। হরেন্দ্রনাথ ছেলেমেয়েদের আনন্দ দেখে হাসিমুখে ঘরে ফেরে।
(চলবে)
এসএ/