অঘ্রানের অন্ধকারে
ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব: ১১
বেলা তেতে উঠছে। রোদের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বাড়ির দোতলার বারান্দায় শাবিন দাঁড়িয়ে আছে। তার ভেতর ছটফটে ভাব। সে কোনো এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।
বাসার সামনে রিকশা এসে থেমেছে। শাবিন অবাক হয়ে দেখল তুরি নামছে রিকশা থেকে। শাবিন মনে করার চেষ্টা করল কতদিন পর তুরির সঙ্গে তার দেখা হচ্ছে। মনে করতে পারল না। তার দিন, মাসের হিসেব সব উলটোপালটা হয়ে গেছে। শুধু মনে করতে পারল অনেক-অনেক দিন পর তুরির সঙ্গে তার দেখা হচ্ছে।
তুরি এসে বসেছে শাবিনের ঘরে। মায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। মা তার কাছে জানতে চেয়েছেন বাড়ি কোথায়, কয় ভাইবোন, কে কী করে, বাবা কোথায় থাকেন, কী করেন? মা মারা গেছেন শুনে দুঃখ করলেন। তারপর অতি পরিচিত প্রশ্ন করেছেন, তোমার এখনো বিয়ে হয়নি কেন?
তুরি বলল, বিয়ে করিনি তাই।
বিয়ে করোনি কেন?
ইচ্ছে করেনি।
এখনো ইচ্ছে করে না?
করে।
বয়স বাড়ছে। বিয়ে করো।
মা উঠে চলে গেলেন। শাবিনের ঘর হয়ে আছে লন্ডভন্ড। সবকিছু চারদিকে ছড়ানো ছিটানো। ময়লা জামা, গেঞ্জি, আন্ডারওয়ার, মোজা ঘরের এখানে ওখানে পড়ে আছে। ঘরে ভাপসা চাপা গন্ধ। মনে হচ্ছে অনেকদিন ঘরের দরজা-জানালা খোলা হয়নি। অথচ ঘরের দরজা-জানালা খোলা।
তুরি বলল, আপনি চাকরি ছেড়েছেন কেন?
চাকরি করতে ইচ্ছে করে না।
এখন কী করছেন?
বাড়িতে থাকি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই। সময় কেটে যায়।
আপনার কী হয়েছে?
কিছু হয়নি তো।
শেভ করেননি কতদিন! মুখ ভরতি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখ লাল হয়ে আছে।
রাতে ঘুম হয় না।
অসুখ করেছে। ডাক্তার দেখিয়েছেন?
আমরা সকলেই অসুস্থ। আমি, তুমি সবাই। এই যে বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি সুস্থ হলে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেন না।
তুরি বুঝতে পারে শাবিনের অভিমান হয়েছে। হয়তো তার অভিমানের জন্য সে দায়ী। কোনো খবর না দিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিতে চেয়েছিল। তাই বলে একজন মানুষ এভাবে নিজেকে ভেঙেচুরে এলোমেলো করে ফেলবে!
তুরি বলল, আপনি অসম্ভব ব্রিলিয়েন্ট একজন মানুষ। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। কোথাও হয়তো কোনো ভুল হয়েছে। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ।
তুরিকে চমকে দিয়ে শাবিন বলল, তুমি আমাকে ভালোবাসো?
বুকের অতল থেকে বাতাস টেনে এনে তুরি বলল, ভালো না বাসলে আপনার সাথে কি বিছানায় যেতাম! স্বীকার করছি সেদিন মদ খেয়ে আমি খানিকটা বেসামাল ছিলাম। প্রচুর কথা বলেছি। একান্ত ব্যক্তিগত গোপন করে রাখা কথা আপনাকে বলেছি। তবে অতটা বেসামাল নিশ্চয় ছিলাম না যে নিজেকে আটকাতে পারতাম না।
তাহলে তুমি বারবার হারাও কেন?
তুরি চোখ নামিয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা তুলে বলল, আপনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। আপনার আকর্ষণ থেকে বেরুতে পারি না। আবার মনে হয় আপনাকে ঠকাচ্ছি। আপনাকে ঠকাতে চাই না।
আমি কী চাই তা আমি ভালো জানি।
আপনি কী চান?
তোমাকে।
সব জেনেশুনে!
অবশ্যই।
মানুষ এমনকিছু না যে সে পচে যায়।
তুরি আবার গভীরভাবে বুকের ভেতর নিঃশ্বাস টেনে নিল। নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, সেদিন আপনার সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এমন কোনো ভাবনা আমার ভেতর আগে আসেনি। হয়তো আপনাকেই সবকিছু দিতে চেয়েছি।
শাবিন চুপ করে আছে। জানালার পর্দা সরানো। ঘরের ভেতর জানালা দিয়ে রোদ ঢুকেছে। তুরি চুলের ক্লিপ খুলে হাতের ব্যাগে রাখল। চুলগুলো গুছিয়ে নিয়ে খোঁপা করল।
চোখ তুলে বলল, আমার অ্যাক্সিডেন্টের পর ভেবেছিলাম আর কারও সঙ্গে জড়াব না। ঘটনা কাউকে বলিনি। লুকিয়ে রেখেছিলাম। কী যেন হলো। আপনাকে বলতে ইচ্ছে করল।
তুরিকে দেখে শাবিনের মন ভিজে উঠল। তাকে দেখাচ্ছে অত্যন্ত দুর্ভাগা একজন মানুষ। তুরিকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে আদর করতে ইচ্ছে করছে।
শাবিন বলল, তুমি কি এ কথাগুলো বলতে এসেছ! কেন বলছ আজ এসব!
তুরি বলল, সেদিন ভীষণ অস্থির ছিলাম। আপনাকে ঘরে একা পেয়ে ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়েছি। প্রকাশ করিনি। প্রবলভাবে চাইছিলাম আপনি আমাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরুন। আমার শরীরের জামাকাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলুন। আমাকে প্রচন্ডভাবে আদর করুন। আদর করতে করতে দম বন্ধ করে আমাকে মেরে ফেলুন। আপনার আদর পেতে পেতে আমার মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। খুব করে চাইছিলাম।
তুমি আমার গালে গাল ঘষছিলে। চোখ নাক কপাল স্পর্শ করলে। তোমার সেই স্পর্শ আমাকে জাগিয়ে দিয়েছিল।
আগে কখনো এমন হয়নি আমার। মিটুনের সাথেও না। কখনো কারও প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করিনি। কেন করিনি জানি না, যেমন আকর্ষণ অনুভব করেছি আপনাকে দেখে। আপনি যখন আদর করছিলেন আমার চোখ ভরে পানি চলে এসেছিল। নিজেকে মনে হচ্ছিল মাখন, উত্তাপ পেয়ে গলে যাচ্ছি।
তুরি কাঁদছে। তার শরীর থিরথির করে কাঁপছে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শাবিনের ইচ্ছে করছে সেদিনের মতো তুরিকে বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। আদর করতে। সম্ভব হচ্ছে না। বাড়িতে মা আছেন।
শাবিন বলল, চলো যাই। বাইরে থেকে হেঁটে আসি।
চোখ মুছে তুরি বলল, কোথায় যাব?
সেই পুকুরপাড়ে। তারপর দুপুরে রেস্টুরেন্টে খাব।
শাবিন অনেক দিন পর শেভ করল। তুরিকে বসিয়ে রেখে শাওয়ার নিয়েছে। তার ভালো লাগছে। সে পরিষ্কার জামাপ্যান্ট পরে তুরিকে নিয়ে রওনা হলো।
বেরুনোর আগে শাবিনের মা বললেন, রান্না চড়িয়েছি। যেখানে যাচ্ছ যাও। দুপুরে এখানে খাবে।
দুপুরে ফিরে আসতে হলো। অল্প কয়েকপদের খাওয়া। তবে যত্ন নিয়ে রান্না করেছেন শাবিনের মা। কই মাছের ঝোল। মুরগির মাংস। লাল শাক, ছোটোমাছের চচ্চড়ি আর ডাল।
খাওয়াদাওয়ার পর শাবিনের মা বললেন, তুমি কি আমার ছেলেকে বিয়ে করবে?
তিনি প্রস্তাব দেওয়ার মতো করে সম্মতির জন্য বলেছেন। হকচকিয়ে গেছে তুরি। এমন প্রস্তাব পাবে ভাবেনি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আপনার ছেলে রাজি কিনা জানতে হবে।
সে রাজি। তোমার কথা অনেক আগে আমাকে বলেছে। তোমাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। তুমি নিজে যখন এসেছ, তোমাকে আর যেতে দেব না, মা।
তুরির ভালো লাগছে। শাবিনের মা যথেষ্ট আন্তরিক মানুষ। তিনি ভালোবাসা আর আদর মিশিয়ে কথা বলছেন।
তুরি বলল, বাবাকে জানাতে হবে।
তুমি রাজি থাকলে তোমার বাবার সাথে কথা বলব।
তুরি বলল, আপনি বাবার সাথে কথা বলুন।
এই ঘটনার তিন মাসের মাথায় শাবিনের সাথে তুরির বিয়ে হয়ে গেল।
(চলবে)