ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-২৩
স্নানের শব্দ
‘তোরা তো সারাক্ষণ অনলাইনে পড়ে থাকিস, কখনো যদি সেখানে আমার নামে কোনো খারাপ কথা লেখা দেখিস, তখন কেমন লাগবে তোর?’ শবনম সতর্ক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে মেয়েকে। কিছুক্ষণ আগে ওয়েটার টেবিলে খাবার রেখে গেছে। সেখান থেকে একটা মচমচে ফ্রাইড চিকেনে কামড় বসিয়ে চিবুতে চিবুতে শ্রাবণ পাল্টা প্রশ্ন করে,
‘কেন মা? তুমি কি সেলিব্রেটি হয়ে গেছ?’
ওর বলার ভঙ্গিতে শবনম হেসে ফেলে। তারপর বলে, ‘সে তো একটু আধটু হয়েছিই, পত্রিকায় ছবি ছাপিয়েছে, ইন্টারভিউ বেরিয়েছে।’
একটা চিকেন উইংস-এ সস মাখাতে মাখাতে শ্রাবণ বলে, ‘তাহলে তো ঠিকই আছে, সেলিব্রেটিদের নিয়ে স্ক্যান্ডাল হবে এটা তো খুব স্বাভাবিক! যদু মধু কদুকে নিয়ে মানে আমজনতাকে নিয়ে তো আর কেউ কিছু লিখবে না ..’
শবনম হাসে। আজকে গাড়িতে বসে মেয়ের সঙ্গে অফিসের সংকট নিয়ে দুয়েকটা কথা শেয়ার করেছিল। সেসব কথার সূত্র টেনে শ্রাবণ জ্ঞানী মানুষের মতো ভাব করে বলল,
‘শোনো মা তোমার পজিশনে যাওয়ার জন্য কত মানুষের লোভ বলো তো, তোমার নামে বদনাম রটিয়ে কোনোভাবে ফেলে দিতে পারলে হয়ত তারা গিয়ে তোমার চেয়ারে বসবে, এরকম ভাবে..’
শবনমের মনে হয় তার সামনে বসে শ্রাবণ না, যেন তার কোনো বুঝদার অভিভাবক কথা বলছে।
‘আরেকটা জিনিস ভাবো তো মা, বায়োলজিক্যালি তুমি নারী আবার তুমি কোম্পানির হাইয়েস্ট র্যাংকিং পারসন, ৭ চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার, তুমি যদি পুরুষ হতে, তাহলে কি অপজিট পক্ষ তোমাকে ডিস্টার্ব করত না?’
শবনম একটু ভাবে।
‘হুম, করত হয়ত কিন্তু সেটার ধরনটা অন্যরকম হতো, মেয়েদের হ্যারাস করার কিছু বাঁধা ধরা ছক আছে, যেমন চরিত্র নিয়ে বাজে কথা রটানো, শারীরিকভাবে হেনস্থা করা, যেগুলো পুরুষ যেমন পাত্তা দেয় না, সমাজও তেমন কিছু মনে করে না, কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এসব ঘটলেই হলো—মান সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু হয় ।’
ওরা মা মেয়ে একটা খুব সুন্দর সাজানো গুছানো রুফটপ রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছে। শ্রাবণ মেন্যু দেখে নিজে পছন্দ করে খাবারের অর্ডার দিয়েছে এখন খুব আগ্রহ নিয়ে মজা করে খাবারগুলো খাচ্ছে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আবার বড় মানুষের মতো ভঙ্গি করে মাকে নানারকম পরামর্শ দিচ্ছে।
‘বুঝছো মা, পুরুষের জগতে কাজ করতে ঢুকলে তুমি যে নারী সেইটা একদম ভুলে যেতে হবে। নারী পুরুষ ব্যাপার না, আসল ব্যাপার হলো কাজ। কাজে তুমি কতটা পারদর্শী, কতটা দক্ষ, কতটা যোগ্য সেটাই সবাই দেখবে ..’
‘ইশ পাকা বুড়ি একটা! এমনভাবে কথা বলছিস যেন পঞ্চাশ বছরের কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন ভদ্রমহিলা কথা বলছেন! ’
মায়ের কথায় শ্রাবণ একটু লজ্জ্বা পায়। ঠোঁট বাঁকা করে লাজুক হাসে। কপাল থেকে বাঁ হাত দিয়ে আলগা চুল সরিয়ে মুখটা নিচু করে বলে,
‘তোমার কাছেই তো শিখেছি! তুমিই না সেদিন কাকে যেন বলছিলে, কাজের জায়গায় মেয়েদের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। কেউ যেন নারী বলে দুর্বল না ভাবতে পারে! কেউ যেন অন্যায় সুযোগ নিতে না পারে! ’
শবনম ঠিক মনে করতে পারে না, কবে কাকে কখন এসব কথা বলেছিল সে। কিন্তু তা নিয়ে মেয়েকে আর কিছু বলে বিব্রত করতে চায় না সে। শুধু বলে, ‘সামনে তো তুইও চাকরি বাকরি করবি, তখন এই কথাগুলো মনে রাখিস, তাহলেই চলবে।’
‘চাকরি করব না মা, ভাবছি বাইরে থেকে ডিগ্রিটা নিয়ে এসে বাবার ব্যবসা দেখা শোনা করব। বিজনেস উইমেন হব আমি!’
শ্রাবণ ঘাড় ঝাঁকিয়ে ঘোষণা দেয়। শবনম একটু অবাকই হয়। তার চকচকে চাকরির ক্যারিয়ার দেখেও সেই লাইনে না গিয়ে মেয়ে কিনা আকৃষ্ট হলো বাবার লক্কর ঝক্কর মার্কা ব্যবসার দিকে! যাক করুক ওর যা ইচ্ছা! সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সে স্বাধীন।
শবনম বলল, ‘তা বেশ। চাকরি বা ব্যবসা যাই করিস কথাগুলো মনে রাখিস। মেয়ে বলে হীনমন্যতায় ভোগার কিছু নেই, যা করবি নিজের সাহসে, নিজের যোগ্যতায় করবি।’
ওদের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। মা মেয়ে খাওয়া শেষে ফুড কোর্ট থেকে বেরিয়ে পাশের সিনেপ্লেক্সে ঢ়ুকে যায়। একটা আধা হরর, আধা সায়েন্স ফিকশন, আধা মনস্তাত্ত্বিক টাইপের জগাখিচুড়ি মার্কা ইংরেজি ছবি চলছিল। পপকর্ণের ঠোঙ্গা হাতে খুব আগ্রহ নিয়ে সিনেমাটা দেখছিল শ্রাবণ। শবনমের রুচির সঙ্গে আবার এই ধরনের সিনেমা তেমন যায় না। সে কিছুক্ষণ জোর করে চোখ টেনে মেয়ের সাথে মুভি দেখল তারপর কখন যে হলের নরম সিটে গা এলিয়ে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়েল নিজেই টের পেল না।
ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখলো একটা খুব চমৎকার দুধসাদা রঙের মার্বেল পাথরে তৈরি সাজানো গুছানো ঘরে বসে একমনে কাজ করছে সে। এক সময় কাজ শেষ হলে কম্পিউটর বন্ধ করে বাইরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল শবনম। আর তখনই সে আবিষ্কার করল ঘরটায় কোনো দরজা নেই। দুই হাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে সবগুলো দেয়াল বাইরে বের হওয়ার জন্য দরজা জানালা খোঁজার চেষ্টা করল শবনম। কিন্তু মসৃণ দেয়ালে হাত পিছলেই গেল শুধু দরজা জানালা কেনো, কোনো ফাঁকফোকড়ের চিহ্নই খুঁজে পাওয়া গেল না। যেন নিরেট সাদা একটা বাক্সে আটকা পড়েছে সে। শবনম চিৎকার করে বলল, ‘কেউ আছেন? আমি বের হতে চাই! শুনতে পাচ্ছেন ..’
তার কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। কেউ এল না। না কোনো মানুষ, না তার মুক্তি। সেই শীতল অন্ধকূপের ভেতরে শবনম শুধু চারিদিক হাতড়ে বেড়াতে থাকল। চারপাশে সাদা বরফের দেয়াল, উপরে নিচে আশে পাশে বের হওয়ার কোনো পথ নেই। ভয়ে আতঙ্ক রক্ত হিম হয়ে গেল শবনমের। দমবন্ধ লাগল। মনে হল, সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। এদিকে সাদা দেয়ালগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তারা ধীরে ধীরে শবনমের দিকে চেপে আসছে, তাকে পিষে দিতে চাইছে। একটা ভয়ানক যন্ত্রণার অনুভূতি তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। মুখ দিয়ে গোঙানীর মত একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল তার। আর এর মধ্যেই অনেক দূর থেকে যেন শুনতে পেল শ্রাবণের চাপা কণ্ঠ,
‘মা, ও মা, কি হয়েছে? ঘুমিয়ে গেছ নাকি?’
চোখ খুলে শবনম প্রথমে বুঝতেই পারল না সে কোথায় আছে! তার চোখে এখনো সেই সাদা বরফের দেয়ালের আলো আর ভয় লেগে আছে। সিনেমা হলের আলো আধাঁরিতে সে কেমন বিভ্রান্ত বোধ করে।
‘তুমি সিনেমা দেখো নাই, ঘুমায়ে গেছিলা?’
শবনম এবার সম্বিত ফিরে পায়। সোজা হয়ে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকায়। সিনেমা শেষ হয়ে গেছে। মানুষজন হল ছাড়ছে। শ্রাবণ কোমল গলায় বলে, ‘তুমি অনেক ক্লান্ত মা, তোমার আসলে রেস্ট দরকার।’
বাসায় ফিরেও সিনেমা হলে দেখা দুঃস্বপ্নটা ভুলতে পারে না শবনম। ওই সাদা পাথরের ঘর থেকে হিম সাদা বরফ কুচি যেন তার রক্তের ভেতর ঢুকে গেছে, শিরা উপশিরা ধমনী দিয়ে সেই শ্বেত শুভ্র তুষার কণাগুলো তাদের সমস্ত শৈত্য নিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেশ শীত লাগছে তার।
শ্রাবণ কপালে হাত দিয়ে বলল, ‘গা টা একটু গরম মনে হচ্ছে, একটা প্যারাসিটামল খেতে পার।’
‘নাহ্ তেমন কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে।’ শবনম মেয়েকে আশ্বস্ত করে। ‘কাল রাতে ঠিক মত ঘুম হয়নি তো! এখন একটা ভাল ঘুম দিলেই .. ব্যাস.. চিন্তা করিস না।’
শ্রাবণ তার অ্যাসাইনমেন্ট করতে নিজের ঘরে চলে গেলে বাইরের কাপড় ছেড়ে একটা ঢিলেঢালা ম্যাক্সি পরে নেয় শবনম। তারপর ঘরের লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। শরীর জুড়ে অবসাদ কিন্তু তার দুই চোখে ঘুম আাসে না। কেমন একটা বমি বমি ভাব হয়, গা গুলাতে থাকে। শ্রাবণের পাল্লায় পড়ে তেলে ভাজা ফাস্ট ফুড খাওয়া বোধহয় ঠিক হয়নি, বয়স বাড়লে পেটে অনেক কিছু হজম হতে চায় না। গ্যাস হয়। বাথরুমে গিয়ে কিছুক্ষণ বমি করার চেষ্টা করল সে। কিন্তু বমি হল না, গা গুলানো ভাবটা রয়েই গেল। চোখ দুটো জ্বালা করছে কিন্তু একটুও ঘুম আসছে না শবনমের। পথের কুকুরদের ঘেউ ঘেউ শুনল সে। রাতের ট্রাকের দূরাগত হর্ন শুনতে পেল। শ্রাবণের ঘর থেকে হাল্কাভাবে কোনো একটা ইংরেজি গানের সুর ভেসে আসছে। সারা রাত জেগে গান শুনবে আর পড়ালেখা করবে মেয়েটা। শবনম এক ধরনের শারিরীক মানসিক অস্বস্তি নিয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে। ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে এলে সে দেখতে পায় শহরের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বিলবোর্ডগুলোতে মনিরুজ্জামানের সঙ্গে তার নানা ধরনের অন্তরঙ্গ ছবি শোভা পাচ্ছে। পথচারিরা দারুণ কৌতুহলে ভিড় করে সেইসব ছবি দেখছে।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/