ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১৪
স্নানের শব্দ
কয়েকদিন ধরে সকাল হলেই চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি নামছে। নিজের গাড়িতে বসে অসহ্য যানজটে আটকে থেকে ঢাকা শহরের উপর হুড়মুড় করে ঝরে পড়া বৃষ্টি উপভোগ করা হয়তো কবি কালিদাসের পক্ষে সম্ভব, কিন্তু শবনমের মতো কাঠখোট্টা বেরসিক মানুষদের কাছে এর চেয়ে বিরক্তিকর আর কিছু নেই। এরমধ্যে আজ সকালে ড্রাইভার আয়নাল ফোন করে জানালো রাত থেকেই তার প্রচণ্ড জ্বর, গাড়ি নিয়ে বের হতে পারবে না। অফিসে ফোন করলে কিছুক্ষণের মধ্যে বদলি ড্রাইভার পাঠিয়ে দেবে অথবা তারেকের গাড়িতেও অফিসে যাওয়া যায় কিন্তু শবনম দেখল, তার নিজেরও শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। মাথা, নাক, গলা ভারী হয়ে আছে।
পর পর বেশ কয়েকটা শক্তিশালী হাঁচিও দিয়ে ফেলল সে। আজকে অফিসে কোনো জরুরি মিটিং আছে কি না, গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফাইল সই করতে হবে কি না মনে মনে একটু ভেবে নিল সে। যখন সে রকম কিছু মনে পড়ল না, তখন সিদ্ধান্ত নিল অফিসে না যাবার। তারেক তাকে প্রতি দিনের মতো অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হতে না দেখে খানিকটা অবাকই হলো। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকাল সে। ‘শরীরটা ভাল্লাগছে না। তাই ভাবলাম আজকের দিনটা একটু রেষ্ট নেই।’ শবনম বলে।
‘একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে, তোমার আবার রেস্ট লাগে নাকি?’ তারেক রসিকতা করে বলে। তারপর যোগ করে, ‘তবে হ্যাঁ, বিশ্রাম নেওয়ার জন্য খুব সুন্দর দিন, কাঁথা মুড়ি দিয়ে আরাম করে ঘুমাও। শরীর ঠিক হয়ে যাবে।’
যদিও অসময়ে ঘুমানোর মানুষ নয় শবনম, তবু আজ কেন যেন তার সারা গায়ে আলসেমি এসে ভর করেছে। ফলে বিছানা ছেড়ে উঠল না সে। তারেকের বর্ষাপ্রীতি অপরিসীম। বৃষ্টির দিনগুলিতে সে এমনিতেই খুব উতলা হয়ে থাকে। আজকেও বৃষ্টির অজুহাতে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি শেষে গড়িমসি করে নিতান্ত অনিচ্ছায় বিছানা ছাড়ল তারেক। আগে থেকেই এক ভিআইপি কাষ্টমারের সঙ্গে মিটিং সেট করা ছিল, নইলে এমন দিনে তাকে বাড়ির বাইরে বের করা একটা অসম্ভব ব্যাপার। তারপরও বের হওয়ার আগে ভেজা বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ‘আহা’, ‘উহু’ করে যুগপৎ চা ও বৃষ্টির স্বাদ আস্বাদন করল সে।
শ্রাবণ এখন ঘুমাচ্ছে, বেলা করে উঠে মাকে বাসায় দেখলে নিশ্চয়ই বাবার মতোই মেয়েও খুব অবাক হবে। সারাক্ষণই তো মাকে বলতে থাকে, তুমি কাজের চাপ একটু কমাও। ওয়ার্কোহলিক হয়ে গেছো একেবারে। কাজ না করে থাকতে পার না। নিজের দিকে একটু তাকাও, নিজের যত্ন নাও। যেন সেই শবনমের অভিভাবক। আসলে বাবা মার বয়স বাড়লে সন্তানরাই এক পর্যায়ে মা বাবা হয়ে যায়। নিজের পরাক্রমশালী মায়ের কথা মনে পড়ে শবনমের, শেষ দিকে কেমন শিশুর মতো অবুঝ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
দুপুর বারোটা বাজার পরও শ্রাবণ যখন ঘুম থেকে উঠল না, তখন শবনম নিজেই উঠে গিয়ে ওর দরজায় নক করল। দরজা খুলে মাকে দেখে শ্রাবণের চোখে রাজ্যের বিস্ময়, ‘আরে, তুমি অফিস থেকে এসে পড়েছ? এত তাড়াতাড়ি? ’
শবনম মৃদু হাসল, ‘যাইনি আজকে, ব্রেক নিলাম।’
‘গ্রেট ! জীবনে ব্রেকের দরকার আছে।’ বুড়ো মানুষের মতো মুখ করে বলল শ্রাবণ।
‘তোর জন্য বসে আছি, একসঙ্গে ব্রাঞ্চ করি চল...’ শবনম প্রস্তাব দেয়। শ্রাবণ মুখে ব্রাশ আর গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুমে ঢুকছিল। আধা ঘন্টা পর বেরুল পরিপাটি হয়ে, বাইরে বেরুবার জামা কাপড়, ফতুয়া জিন্স পরে।
‘সরি মা, আমি তো জানতাম না, তুমি বাসায় থাকবা ! আমার তো আগে থেকে প্রোগ্রাম ঠিক করা আছে, ক্লাবের মিটিং, সিনিয়র, জুনিয়র সবাই অপেক্ষা করছে। যাওয়াই লাগবে। ইশ্ আগে জানলে আমি ঠিক মিটিং ক্যানসেল করতাম, থাকতাম তোমার সঙ্গে।’
‘না, না ঠিক আছে। তুই যা! অসুবিধা নেই।’
শবনম নিজেকে সামলে নেয়। মাকে জড়িয়ে ধরে দুই গালে শব্দ করে চুমু খেয়ে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যায় শ্রাবণ। যাবার আগে পাকা বুড়ির মতো উপদেশ দিয়ে যায়, ‘শোনো, এটা তোমার ‘মি টাইম’। নিজের মনের সঙ্গে কথা বলো, নয়তো গান শোনো, ইচ্ছা করলে বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথাও বলতে পারো...’ বৃষ্টি শেষে চমৎকার রোদ উঠেছে এখন। ব্যালকনিতে টবে লাগানো গাছের সবুজ পাতাগুলো রোদের আলোতে তেঁতুল দিয়ে ধোয়া সবুজ পিতলের থালা বাটির মতো ঝক ঝক, চক চক করছে। পিতলের রং কি সবুজ হয়? একা বাড়িতে এমন উপমা মনে আসায় নিজের মনেই হাসল শবনম। সে তো জানেই পিতলের রং স্বর্ণালী, তবে সেই স্বর্ণের মধ্যে সবুজ আভা ছড়ালে যা হয় পাতাগুলো এখন সেরকম রূপ ধরেছে। স্বর্ণ-সবুজ রঙের ভেজা মসৃণ পাতাগুলোতে একটু হাত বুলালো শবনম। ছোট্ট শিশুর মতো মন ভালো হয়ে গেল তার।
অনেকদিন মৌসুমীর সঙ্গে কথা হয় না ভেবে ঘরে ঢুকে মোবাইলের বোতাম টিপতেই ওপাশ থেকে মৌসুমীর ব্যস্ত গলা শোনা গেল। হড়বড় করে সে যা বলল, তার সারমর্ম হচ্ছে আগামী মাসে একটা সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে কলকাতা যাচ্ছে মৌসুমী, এখন মহা ব্যস্ত ভিসা প্রসেস করার কাগজপত্র যোগাড় করা নিয়ে। শবনম আর ওর ব্যস্ততায় ব্যাঘাত ঘটানো সমীচীন মনে করল না।
এবার সময় কাটাতে একটু দোনামোনা করে সুরাইয়াকে ফোন দেয় শবনম।
‘কিরে, তুই তো কোনো খোঁজ খবরই রাখিস না, এত পর হয়ে গেলি!’
এই সেই হেন তেন বলে কিছুক্ষণ মধুর অনুযোগ করে সুরাইয়া। বলে, ব্যাংকের চাকরিটা ছেড়েই দিচ্ছে। ‘সেকি কেন? এখনো তো আরও চার পাঁচ বছর রিটায়ারমেন্টের বাকি..’ ‘আসলে ছাড়তে চাইনি, কিন্তু দেখ, বাগেরহাটে পাঠাতে চাইছে প্রমোশন দিয়ে, এই বয়সে, ঘর সংসার ফেলে গ্রামে গিয়ে পড়ে থাকা যায়, বল?’
‘বাচ্চারা তো বড়ই হয়ে গেছে, তোর আর পিছুটান কি, বল !’ ‘না, না, তুই বুঝবি না। আমার শরীর মন কোনটাই আর চাকরি বাকরি করতে চাচ্ছে না, অনেক তো করলাম, এবার সব ছেড়ে ছুড়ে থিতু হয়ে বসি। আর ছোটাছুটি ভাল্লাগে না।’
সুরাইয়ার মতো তারও কি থিতু হয়ে বসার সময় এসে গেছে, ভাবে শবনম। অফিসের কথা মনে পড়ে তার, নাহ, যে রেস সে শুরু করেছে, তা তো এখনো শেষ হয়নি। পেশাগতভাবে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ চূড়ায় এখনো পৌঁছানো হয়নি তার। নিজের মেধা ও কর্মক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ নেই শবনমের, তবে সে জানে, অফিসে নানা রকমের রাজনীতি আছে, আছে ল্যাং মারার বিভিন্ন অপকৌশল। প্রতিযোগীরা সবাই ফেয়ার খেলা খেলবে না। বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করতে সবাই ফাঁক ফোকড় খুঁজবে। মনিরুজ্জামানরা অডিটের কাছ থেকে যে তথ্য পেয়েছে জোরালো প্রমাণসহ সেটা সঠিক জায়গায় দাখিল করতে পারলে স্বভাবতই ওসমান গণি এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। সত্যি বলতে তখন আর শবনমের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ থাকবে না। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কাউকে কোম্পানির উচ্চ পদে বসানোর প্রশ্নই আসে না। সেক্ষেত্রে সিনিয়রিটি, সিনসিয়ারিটি আর কর্ম অভিজ্ঞতার জোরেই সিইও পদে শবনমকে না নিয়ে পারবে না ম্যানেজমেন্ট। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই অ্যাকাউন্টস চিফ আতিউর কিংবা
অ্যাডমিন হেড শওকতের সমর্থন লাগবে। সমর্থনের জায়গাটাতে পুরুষদের একটা জাতিগত ঐক্য থাকে, হয়তো মনের অজান্তেই একটা লৈঙ্গিক পক্ষপাত লালন করে তারা। বেশিরভাগ সময় ভাল মন্দ বিচার না করেই পুরুষেরা নিজ জাতের প্রতি অন্ধ পক্ষাবলম্বন করে ফেলে। চাকরির শুরুতেও দেখেছে শবনম, পুরুষ সহকর্মীরা দিব্যি একে অন্যের সঙ্গে সিগারেটে টান দিতে দিতে প্রাণের বন্ধু হয়ে যায়। তাদের সিগারেটের আড্ডায় সাধারণত নারী সহকর্মীদের প্রবেশাধিকার থাকে না। (যদিও এখন দিন পাল্টেছে, নতুন প্রজন্মের মধ্যে নারী ধূমপায়ীর সংখ্যাও কম নয়)। সেই সময়ে তার সহকর্মী পল্লবি মাঝে মাঝে দুষ্টুমী করে বলত, ‘চলো, আমরাও ধোয়া গেলা শুরু করি, অন্তত সিগারেটের অজুহাতে বাইরে গিয়ে ছোটখাটো আড্ডা মেরে আসা যাবে...’
পুরুষদের আরেকটা সমস্যা, সহকর্মী হিসেবে মোটামুটি মেনে নিলে বা পছন্দ করলেও উচ্চপদে বা বস হিসেবে নারীকে মেনে নিতে পারেন না অনেকেই। আসলে নারীকে একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে দেখতেই অভ্যস্ত তারা, সেই বৃত্ত ভাঙা সহজ নয়, হয়তো পরিচালনা পর্ষদের অনেকে সদস্যও চাইবেন না নারী সিইও হোক, তা তিনি যতই দক্ষ বা যোগ্য হন না কেনো! কী অসুবিধা?
না, উনি কি রাত বিরেতে পার্টি অ্যাটেন্ড করতে পারবেন? অন্য কোম্পানির সিইওদের জন্য (মদের) পার্টি থ্রো করতে পারবেন?
আসলে উনাকে কি কর্মীরা মান্যি গণ্যি করবে? মানবে উনার সিদ্ধান্ত? উনি কি কোম্পানিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবেন? কর্মী ছাটাই টাটাই এর ব্যাপার আছে, ওইসব কঠিন সিদ্ধান্ত উনি কি নিতে পারবেন? ওইরকম মানসিক দৃঢ়তা কি তার আছে?
শবনম জানে, শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে তার ক্ষেত্রে যেসব অতিরিক্ত প্রশ্ন উঠবে, শুধুমাত্র পুরুষ হওয়ার কারণেই ওসমান গণির ক্ষেত্রে কখনোই সেসব প্রশ্ন উঠবে না। সিইও পদটা ক্ষমতা চর্চার জায়গা। পুরুষতান্ত্রিক দুনিয়া মনে করে ক্ষমতার জগতে শুধু পুরুষরা একাই রাজত্ব করবে। নারী প্রজা হতে পারে, ছোটখাটো মন্ত্রী পদেও না হয় মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু তার উপরে, কভি নেহি।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>