ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব: ৮
অঘ্রানের অন্ধকারে
নবীন বকুলগাছটা বিকেলে নরম রোদ পেয়ে ঝলমলিয়ে উঠেছে। পাতায় পাতায় ঝিরঝিরে বাতাস। দুটো দোয়েল খুনসুটি করছে। গভীর আনন্দে মোহিত হয়ে ডাকছে। ঝটপট করছে। টুকটুক করে লাফাচ্ছে। পুরো গাছজুড়ে ওদের আনন্দের নাচন।
বকুলগাছের নিচে শানবাঁধানো পুকুর। প্রশান্ত পুকুরের পানি। ঝকঝকে গাঢ় সবুজে নিস্তরঙ্গ অচপল ভাব। দিন শেষের নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে পুকুরময়।
পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে শাবিন আর তুরি। শাবিনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে তুরি বকুলতলায় এই পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকবে বলে। কাল রিকশা নিয়ে ঘুরেছে তুরি শহরের নানান জায়গায় এমন চুপচাপ পুকুরের খোঁজে। মিলেও গেছে ঠিক যেমন খুঁজছিল।
অমনি খেয়ালি বাতাসের টানে তিরতিরে ঢেউ উঠল পুকুরের পানিতে। সেই আকুলিবিকুলি করা ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নময় হয়ে গেল শাবিনের দুই চোখ। মায়াময় শোনাল তার কণ্ঠ, ‘আমাদের গ্রামটা অদ্ভুত সুন্দর। অবশ্য আমি ছোটোবেলায় গেছি, বাবার সঙ্গে। গ্রাম বলতে যা বোঝায়, ছবির মতো। পথের পাঁচালী’র নিশ্চিন্তি, না নিশ্চিন্দিপুরের মতো গ্রাম।’
গ্রামের নাম ভুল বলে হেসে ফেলল শাবিন।
শাবিনের স্বপ্নময়তা স্পর্শ করেছে তুরিকে। উচ্ছলিত গলায় বলল, ‘সত্যি!’
‘তোমার মনে আছে, অপূর্বকৃষ্ণ যখন কলকাতা থেকে ফিরে নৌকাঘাটায় নামল তখন কাদায় পিছলে পড়েছিল আর আপনি তো ‘পথের পাঁচালী’র সঙ্গে ‘সমাপ্তি’ গুলিয়ে ফেলেছেন।’
লজ্জার ধাক্কা সামলাল শাবিন, ‘ও হ্যা। ‘সমাপ্তি’ গল্পে, স্যরি-’
‘স্যরি কেন?’
‘ওই যে গুলিয়ে ফেললাম।’
তুরির মনে হলো কী ভীষণ পাগল এই মানুষটা। বলল, ‘তো! কী হয়েছে। বলুন সমাপ্তি গল্পে-’
‘সমাপ্তি গল্পে অপূর্ব নৌকাঘাটায় কাদায় পিছলে পড়লে মৃন্ময়ী খিলখিল করে হেসে ফেলেছিল।’
‘হ্যা মনে আছে। গল্পের শুরুতেই। হঠাৎ এটা মনে হলো কেন? আপনি ওরকম কাদায় পিছলে পড়েছিলেন নাকি! আর কোনো একজন মৃন্ময়ী-’
‘না- না- ঠিক তা নয়। আমি বলতে চাইছিলাম-’
‘কী!’
‘আবার গুলিয়ে ফেলেছি। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।’
‘ও মা কেন?’
‘জানি না তো।’
এবার মুখ ফুটে বলেই ফেলল তুরি, ‘আসলেই আপনি পাগল। ঠিক করে বলুন তো—কী হচ্ছে এসব?’
‘সত্যি জানি না। শুধু জানি—’
‘কী?’
আশ্চর্য ঘোরলাগা গলায় শাবিন বলল, ‘আগে মনে হতো আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। নিজের ওপর নিজেরই রাগ হতো খুব। কিছু করতে পারতাম না। এখন মনে হয় ইচ্ছে করলে আমি সবকিছু করতে পারি।’
‘অবশ্যই পারেন। আপনি রেগুলার ক্লাস করে, পরীক্ষা দিয়ে চমৎকার রেজাল্টও করতে পারেন।’
‘শুধু একটাই ভয়। ঠিক ভয় না, সংশয়।’
‘কী সেটা?’
‘একলা আমি কিছু করতে পারি কিনা। একলা একজন মানুষ বাঁচে কিনা’—বড্ড অসহায় শোনায় শাবিনের গলা।
স্মৃতি বড়ো অলক্ষুনে মনে হয় তুরির। অসময়ে এসে ভাবনায় কড়া নাড়ে। যত ভাবে অতীত ওসব, মরে গেছে। মরে গেলে পচে যায়। সেই পচাগলা অলক্ষুনে অতীত তাকে আঁচড়ায় কামড়ায় খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলে।
ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরির কোণায় কদমগাছের নিচে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত তুরি। দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগত। সেই সময়টুকু ছিল ওর একান্তের নিজের সময়। সেটুকুও কেড়ে নিয়েছিল একজন। নাকি ও নিজেই দিয়েছিল তাকে ওর একান্তের নিজের সময়! অস্থিরতা লেগেই থাকত সেই দুরন্ত ছটফটে মানুষটার গলায়। মাটি ফুঁড়ে উদয় হতো যেন লাফিয়ে। হুড়মুড় করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর সময়ে ভাগ বসাত। মানুষটি এলে ভালো লাগত তুরির। যেন এক ঝলক খোলা হাওয়া সঙ্গে করে নিয়ে আসত রোজ।
স্মৃতিকে বেশিক্ষণ জাপটে থাকতে দেয়নি তুরি। দিশেহারা ভাবটা কাটিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘আমাকে দেখুন, এই আমি তো বেঁচে আছি, একলা একজন মানুষ।’
কথায় পেয়েছে তখন শাবিনকে। কথার সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে এগিয়ে গেল আরও কয়েক ধাপ, ‘আমি ওই বিচ্ছিরি সংস্কারটাকে কেমন আঁকড়ে ধরে আছি! এক-শালিক দেখলে এখনো চমকে উঠি। অশুভতার আশঙ্কায় না। আমার মনে হয় ওই একলা পাখিটা বড্ড দুঃখী। ও বড়ো বেশি একা। ওর খুব কষ্ট। ঠিক তোমার মতো।’
থমকে গেল তুরি। তবে কি ধরা পড়ে গেছে সে নিজের অজান্তে। মনে মনে ভাবল হয়তো ধরা দিতে চেয়েছে নিজেই। চেয়েছে অন্তত কেউ একজন গভীরভাবে অনুভব করুক ও খুব একা একজন মানুষ। কিন্তু মুখে তুরি বলল অন্য কথা, ‘কে বলেছে আপনাকে আমি একা! আমার বড়ো দুঃখ।’
‘আমি টের পাই। মানুষের চোখের দিকে তাকালে তাকে বুঝতে পারি। তোমার কষ্ট আমি খুব বেশি করে অনুভব করতে পারি।’
বুকের ভেতর আবার মোচড় দিয়ে উঠল তুরির। চোখ ভরে উঠেছে পানিতে। নাজুক করে দিচ্ছে। ঘোর তৈরি হচ্ছে ওর ভেতর। এই ঘোর কী ভালোলাগার! শুধুই পছন্দের নাকি ভালোবাসার। যদি ভালোবাসার হয়। তবে তার রূপ কী। নিজের মনকে বোঝায় তুরি। পছন্দ নয়, ভালোবাসা নয়। ওই মানুষটাকে একটুখানি সহযোগিতা করা। নিজের ভেতর নির্ভরতা তৈরি করতে সাহায্য করা মাত্র।
মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে শাবিনের মুখের দিকে তাকাল, তারপরই চোখ নামিয়ে নিল তুরি।
(চলবে)