ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৭
স্নানের শব্দ
মাত্র এক সপ্তাহের বিরতি, কিন্তু শবনমের মনে হচ্ছে যেন বহু বহু দিন পর অফিসে ঢুকেছে সে। সব কিছইু কেমন যেন অচেনা, নতুন। অথচ দৃশ্যত সব একরকমই আছে, সেই তেঁতুল বিচি রঙের সেন্টার টেবিল, টেবিলের কাঁচের নিচে চাপা দেওয়া তারেক আর শবনমের সঙ্গে পাঁচ বছর বয়সী শ্রাবণের হাস্যোজ্জল ছবি, কালো রেক্সিনের রিভলভিং চেয়ার, ডেক্সটপ কম্পিউটর, সাইড টেবিলে কয়েকটা ফাইল, সৌখিন টবে রাখা মিনি ক্যাকটাস। জানালারও ওই পাশে রুগ্ন নিম গাছ। অফিস সহকারী প্রতিদিনের মতো টেবিলে পানির গ্লাস আর মগ ভর্তি কফি রেখে গেছে।
সিইওর সঙ্গে একবার সৌজন্য সাক্ষাতের কথা ভাবে শবনম। এটা দাপ্তরিক ভদ্রতা, আমি যে আবার পুরোদমে কাজে যোগ দিয়েছি ঊর্ধ্বতনকে সেই ম্যাসেজটা পৌঁছে দেওয়া। পাশাপাশি এ কদিন কাজকর্মের কি অগ্রগতি হলো, ম্যানেজমেন্টের গতি প্রকৃতি কোনদিকে কথাচ্ছলে সেটাও আন্দাজ করে নেওয়া যাবে। শবনম সিইওর পারসোনাল সেক্রেটারি রেশমিকে ফোন দেয়, বস রুমে আছে কি না জানতে।
‘না ম্যাম, স্যার তো রুমে নাই।’
‘ও। কোনো মিটিংয়ে গেছে নাকি?’
‘না, ম্যাম। আপনি শোনেন নাই? স্যারের একটা ঝামেলা হয়েছে..’
‘কি ঝামেলা? আমি তো কয়েক দিন ছুটিতে ছিলাম, জানি না, কি হয়েছে, বলো তো? উনার ফ্যামিলির কিছু?’
এবার রেশমি আমতা আমতা শুরু করে।
‘না, ঠিক ফ্যামিলির না, ওসমান স্যার হয়ত আপনাকে পরে জানাবে ম্যাডাম। আমি আসলে তত বেশি কিছু জানি না।’
মেয়েটার কণ্ঠে স্পষ্ট অস্বস্তির ছাপ। শবনম আর জোরাজুরি না করে ফোন ছেড়ে দেয়। মাত্র এই কদিনে কি এমন ঝামেলা হতে পারে যা এমনকি মেয়েটা মুখ ফুটে বলতেও চাইছে না। শবনম আন্দাজ করার চেষ্টা করে মনে মনে। কোনো আর্থিক দুর্নীতি? ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে মতবিরোধ? কি হতে পারে? নিজে থেকে কেউ না জানালে এই পজিশনে অযাচিত কৌতুহল দেখানো তাকে মানায় না।
অফিসে কেমন একটা থম ধরা, রাখরাখ ঢাকঢাক পরিবেশ। শবনমের অস্বস্তি হয়, আর সেই অস্বস্তি নিয়েই নিচের ফ্লোরে অ্যাকাউন্টস চিফের কক্ষে উঁকি দেয় শবনম। চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট আতিয়ার নোয়াখালীর মানুষ। আঞ্চলিক ভাষাতে কথা বলেন স্বাচ্ছন্দ্যেই। শবনমের শাশুড়ির মৃত্যুতে আন্তরিকভাবে সৌজন্যসূচক শোকপ্রকাশ শেষে তিনিই খবরটা দিলেন।
‘আঁই তো এই যুগের ব্যাপার-সেপার বিশেষ বুঝি ন’। কি এক মিটু বলে আইছে দ্যাশে, ওই একটা ট্রেইনি এক্সিকিউটিভ নাফিসা তানজিনা.. না কি জানি নাম, চিনিও না ঠিকমতো, কি এক মিটু লেইখছে... সিওরে লই.. উতাল পাথাল পড়ি গেছে এক্কেবারে ..এমডি হেতিরে কইছে কিছুদিন অফিসে না আইত বইলা ..’
ও, ঘটনা তাহলে এই?
এই ভবের অফিসে প্রতিদিন কত নতুন নতুন ছেলে মেয়েই তো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আসে যায়, সবার কথা মনে থাকে না কিন্তু নাফিসা তানজিনার কথা স্পষ্ট মনে আছে শবনমের।
প্রচলিত অর্থে হয়ত তাকে সেরকম আহামরি সুন্দরী বলা যাবে না, কিন্তু তার সমস্ত উপস্থিতির মধ্যে একটা সহজ সুন্দর সরল লাবণ্য হীরক খণ্ডের মত ঝিকমিকিয়ে উঠত। মাথাভর্তি জলপ্রপাতের মতো কোঁকড়ানো এলোমেলো চুল ছিল মেয়েটার, চেহারা চালচলন আর পোষাক-আশাকে মনে হতো বিদেশি, বাঙালি নয়। কথায় কথায় একদিন শবনম জেনেছিল, ওর জন্ম ওমানে, বাবা-মার সঙ্গে ছোটবেলাটা ওখানেই কেটেছে, কিশোরী বেলায় ছিল কাতারে পরে দেশ এসে প্রাইভেট কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। কোম্পানির এইচ আর ডিপার্টমেন্টে ট্রেইনি এক্সকিউটিভ হিসেবে জয়েন করছিল নাফিসা। এই জুনিয়র এক্সিকিউটিভদের সঙ্গে সাধারণত যোগদানের প্রথম দিনের পরিচয়পর্বের পর শবনমের সঙ্গে আর খুব বেশি দেখা সাক্ষাতের সুযোগ নেই। কিন্তু নাফিসার সঙ্গে ঘন ঘন দেখা হওয়ার কারণ শবনমের কক্ষটি তখন ছিল এইচ আর ডিপার্টমেন্টের পাশেই।
সাদা শার্ট জিনস পড়া প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর মেয়েটি কখনো মাটিতে পা ফেলে হাঁটতো না, যেন উড়তো, দৌড়াতো। ওর উজ্জ্বল কালো চোখ দুটোতে সারাক্ষণই ঝিলিক দিত কৌতুহল আর আনন্দ।
তারপর কি হলো, হঠাৎ করেই অফিসে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল মেয়েটা। কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কৌতুহল বা অল্পপরিচিত কারো খোঁজ খবর করার সুযোগ যেমন কম তেমনি কর্পোরেট আদবকায়দায় সেটি হয়তো ঠিক শোভনও হয় না, তাই নানারাকম কাজের ভিড়ে শবনম ভুলেই গিয়েছিল নাফিসা তানজিনার কথা।
কি লিখেছে মেয়েটা?
আতিয়ার সাহেব ফটোকপি করা একটা কাগজ বাড়িয়ে দেয় শবনমের দিকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইংরেজি ভাষায় লিখেছে নাফিসা। শবনম কাগজটাতে চোখ বুলায়।
‘সেদিন আমি তার কক্ষে গিয়েছিলাম একটা ফাইলে স্বাক্ষর করাতে। আমাকে বসিয়ে রেখে তিনি মনোযোগ দিয়ে ফাইলের কাগজপত্র দেখলেন, পড়লেন, তারপর সবটা দেখে আমার কাজের খুব প্রশংসা করলেন। এটা সেটা জানতে চাইলেন। তারপর প্রয়োজনীয় স্বাক্ষর শেষে ফাইল ফেরত দেওয়ার সময় আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। বুকে হাত দেন আর মুখ বাড়িয়ে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য। বুঝতে পারছিলাম না, কি হচ্ছে, কি করবো। তারপরই তাকে দুহাতে ঠেলে সরিয়ে প্রায় দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। লজ্জা, ঘৃণা, অপমান এবং একরাশ ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ওই ঘটনায় আমি মূক ও বধির হয়ে গিয়েছিলাম। ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলাম ভেতরে ভেতরে। এর পর বহুদিন বাইরে যেতে, নতুন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতাম আমি। এই ট্রমা, ভয় আর নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে আসতে আমার বছরের পর বছর লেগেছে। তবু সম্পূর্ণভাবে সেই ক্ষত সেরে উঠেনি।
...কোম্পানির নাম স্পষ্ট করে লিখলেও নিপীড়কের পুরো নাম লেখেনি সে, সংক্ষেপে লিখেছে এনসি। ‘এনসি পুরুষ এবং ক্ষমতাবান। তার বিরুদ্ধে কার কাছে অভিযোগ করবো, সেই সময় তা বুঝিনি আমি। এখন আমি মুখ খুললাম এই ভেবে যে সবার সামনে তার মুখোশ উন্মোচিত হোক। নারীর জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি হোক।’
কাগজটা পড়া শেষ করে শবনম স্থাণু হয়ে বসে থাকে। যেন বোবা হয়ে গেছে সে, পাথর হয়ে গেছে।
‘দেখছেননি? কি লেইখছে? এমুন একটু আধটু দুষ্টামি পুরুষ মানুষ তো করেই.. এত বছর পরে হেইগুন লই লিখি একটা বেড়াত্যাড়া লাগায় দিসে ..’
শবনমের জলন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে পুরো বাক্য শেষ করার আগেই থেমে যান আতিউর সাহেব।
‘এন সি কি বলছে?’ শবনম নিচু স্বরে জানতে চায়।
‘কি আর কইব? অভিযোগ অস্বীকার কইরছে, চাইর বছর আগের ঘটনা, হেতের বলে কিচ্ছু মনে নাই। কইছে বানোয়াট, মিথ্যা। পরে আবার আমাগো পারচেজের পল্লবিও, ওই যে দুইবছর আগে চাকরি ছাড়ি দি অষ্ট্রেলিয়া গেল গা, হুনছি হেও নাকি হ্যারাসমেন্টের লিখিত অভিযোগ দিছে ম্যানেজমেন্টের কাছে, হের পর আর কি, এমডি একটা তদন্ত কমিটি বানাইছে আর সিইওরে কইছে ছুটিতে যাইত বইলা..পত্রিকায় তো নিউজও আসি গেছে, খেয়াল করেন নাই? বাও রে বাও কি জমানা আইলো.. জীবনে এমন আজব জিনিস শুনি নাই!’
কোনোমতে ভারী পা টেনে টেনে নিজের ঘরে এসে বসে শবনম। না, চাকরিক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলেও তার সঙ্গে কখনো অসৌজন্যতামূলক আচরণ করেনি নির্ঝর চৌধুরী, কোনোদিন কোনো খারাপ ইশারা-ইঙ্গিত করেছেন তেমনটাও মনে পড়ে না। তবে তার মানে এই না যে নাফিসা বা পল্লবির অভিযোগ অসত্য। কত বিবিধ বিচিত্র চেহারা আছে মানুষের! সময় সুযোগ মতো ক্ষণিকের অসচেতনতায় ভদ্র সুবেশের আড়াল সরিয়ে দাঁত নখসমেত সেই বিকট বীভৎস চেহারা সামনে বেরিয়ে আসে। এতদিন মনে করা হতো এসব বুঝি বিনোদন জগতেই বেশি ঘটে, হলিউডের অ্যাশলে, বলিউডের তনুশ্রীরাই কাস্টিং কাউচের শিকার হয়। কিন্তু মিলানোর হ্যাশট্যাগ আহ্বানের ঢেউ যে এভাবে বাংলাদেশে এসেও আছড়ে পড়বে, ঘূর্ণিঝড় বইয়ে দেবে, পুরুষের পালিশ করা চকচকে আবরণ ধুয়ে বেরিয়ে আসবে বিশ্রি কদাকার চেহারা তা কি শবনম ভেবেছিল কখনো?
বেশ কয়েক বছর আগে, শবনমের মনে পড়ে মৌসুমী বলেছিল, একজন স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক, আবার নামী কাগজের সাহিত্য সম্পাদক তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনি এখনো বিয়ে করেন নাই, একা একা লাগে না..’
‘না, এটা আমার চয়েস, আমি স্বেচ্ছায় সিঙ্গেল থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ মৌসুমী সাবলীল ভাবেই জানিয়েছিল।
‘তাহলে শারীরিক চাহিদা কিভাবে মিটান? না, মানে জৈবিক চাহিদা তো অস্বীকার করার কিছু না.. সেটা নিশ্চয়ই আছে আপনার.. মানে এতে দোষের কিছু নেই, ...রাজি থাকলে আপনি আর আমি একদিন লং ড্রাইভে যেতেই পারি... আরও অনেক কিছুই হতে পারে...’
মৌসুমী রাগে দুঃখে অপমানে কাঁপতে কাঁপতে তার রুম থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সাহস করে কাউকেই তখন কথাটা খুলে বলতে পারেনি, উল্টো মানুষজন তাকে নিয়েই হাসাহাসি করবে ভেবে।
শবনম হাত গুটিয়ে বসে থাকে। রাগ, ক্রোধ, দুঃখ ও অস্বস্তির ককটেলে মনটা একটা তিক্ত বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে তার।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/