ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৬
স্নানের শব্দ
এবার আর সালেহা খাতুন হাসপাতাল থেকে ফিরলেন না। এমন হবে শবনম তা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি, ভেবেছিল এবারও আগের মতোই সপ্তাহখানেক হাসপাতাল-বাস শেষে লাজুক ভঙ্গীতে ক্লান্ত চেহারায় বাড়ি ফিরে আসবেন তিনি।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা অন্য রোগীদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ভাব জমিয়ে, কোন রোগীর শরীরের কি অবস্থা, কে কিভাবে মারা গেল, কে ভয়াবহ রোগের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে উঠলো, কোন নার্সের চোখ গাভীর চোখের মতো সুন্দর, মোলায়েম ব্যবহার, কোন ডাক্তার মহা বেয়াদ্দপ, রোগীদের শুধু ধমকায়, কোন ডাক্তার হাসিমুখ ছাড়া কথা বলে না, এমনকি কোন আয়া স্বামীর হাতে প্রতিদিন মার খায়-টুকটুক করে সেসব গল্প বলবেন তিনি। পাশের কেবিনের রোগীর চাচাতো বোনের সাথে তার এতটাই খাতির হবে যে, হাসপাতাল ছেড়ে আসার দিন তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে-কেটে একসার করবেন। অথচ সেসব অনুমান মিথ্যা করে দিয়ে, হাসপাতালে ভর্তি করার পরদিন ভোরবেলা, ‘রাত্রি শেষের শুভ শুক্রবারে ’তিনি চলে গেলেন নিঃশব্দে তার প্রিয় সন্তান, নাতি নাতনি ছেড়ে একেবারে চিরতরের জন্য, অন্য এক অজানা পৃথিবীতে। মৃত্যু-হ্যাঁ, মৃত্যুই হয়তো একমাত্র সত্য এই পৃথিবীতে, বাকি সব মিথ্যা। মৃত্যুই নিশ্চিত। মৃত্যুই চূড়ান্ত ভবিষ্যত। সামনের অ্যাম্বুলেন্সে সালেহা খাতুনের কফিনে শোয়া মৃতদেহ আর পেছনের গাড়িতে নির্বাক তারেক আর শ্রাবণকে নিয়ে ছুটছিল শবনমের টয়োটা। গ্রামের বাড়িতে নিজের স্বামীর কবরের পাশে তাকে দাফন করার অছিয়ত বহুআগেই করে রেখেছিলেন তিনি। সেই মতোই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গ্রামের আত্মীয়স্বজন যারা ছিল, তারা সবাই এসে ভিড় করছে শেষ বারের মতো সালেহা খাতুনের চিরনিদ্রিত মলিনমুখটা দেখতে।
ফর্সা, মায়াবি চেহারার সালেহা খাতুন নিরীহ, মুখ চোরা, সহজ সরল, ভালোমানুষ ধরনের শাশুড়ি ছিলেন। সারা জীবন পুত্রবধূর সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন তিনি। অন্য অর্থে, খানিকটা সমীহ করেই চলেছেন শিক্ষিত, স্মার্ট, চাকরিজীবী পুত্রবধূকে। বুদ্ধিমতি নারীর মতোই পুত্রের ব্যক্তিজীবনে অযথা নাক গলাতে আসেননি, নিজের ভূবনেও থেকেছেন যথাসাধ্য নীরবে, প্রায় মুখ বুজে। শবনম বুঝতে পারতো, তার ব্যস্ত চালচলন, মুখের উপর ফট করে অপ্রিয় সত্যি কথা বলে ফেলা, রাত করে বাড়ি ফেরা এসব হয়তো তিনি ঠিক পছন্দ করতেন না, হয়তো আড়ালে আবডালে ছেলের কাছে নিজের অপছন্দের বিষয়টি পরোক্ষভাবে তিনি জানাতেনও, কিন্তু মুখোমুখি গ্যাঞ্জাম পাকাননি কখনো। পুত্রবধুর উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেননি নিজের মতামত কিংবা হয়তো অবস্থানগত কারণে মতামত চাপানোর সাহসও পাননি তিনি।
ছোট্ট শ্রাবণকে তার জিম্মায় রেখে নিশ্চিন্তে দিব্যি অফিস করেছে শবনম। অফিসের কাজে দেশ বিদেশে ট্যুরও করেছে। সালেহা খাতুন নিবিষ্ট চিত্তে ঘর সামলেছেন, নাতনির দেখাশোনা করেছেন। সারা দুপুর গৃহকর্মীদের সাথে বসে টেলিভিশনে বাংলা ছায়াছবি দেখেছেন।
পুত্রবধূর প্রতি চাপা অভিযোগ, অনুযোগ, রাগ -ক্ষোভ, বিরাগ বিরক্তি যে একেবারেই ছিল না, তা হয়তো নয়। তবে শবনম ইচ্ছা করেই এসবকে ইস্যু করে তোলেনি, দেখে শুনেও উপেক্ষা করে গেছে অনেক কিছু, যেন সে দেখেও দেখেনি, শুনেও শোনেনি।
তারেকও শুরু থেকেই আদর্শ পুরুষের মতো স্ত্রী ও মায়ের সাথে যথাসম্ভব ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ফলে এক সংসারে থেকেও বউ শাশুড়ির মধ্যে টেরম টেরম যুদ্ধ হয়নি বরং এক ধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হয়েছিল। আরেকটা জিনিস ও ইদানিং মনে হয় শবনমের, সাধারণত যেটা হয়, ঘরের কর্তৃত্ব নিয়েই খুটোখুটি বাঁধে বউ শাশুড়ির। কিন্তু শবনম যেহেতু সারাজীবনই বর্হিমুখী স্বভাবের, আর দিনরাত নিজের চাকরি বাকরি নিয়েই বেশি ব্যস্ত থেকেছে, তাই হয়তো ঘরের খুঁটিনাটি নিয়ে তেমন মাথা ঘামানোর সুযোগ পায়নি। বরং এসব ঝামেলা থেকে বরাবরই নিজেকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ফলে শাশুড়ি ঘর সংসারের একচ্ছত্র কর্ত্রী হতে পেরে সন্তুষ্ট থেকেছেন। শবনমের মনে হয়, না ভাল, না মন্দ, না মধুর, না তেতো, দ্বন্দ্বহীন, আবেগহীন, প্রত্যাশাহীন, স্নেহ ও করুণাবিহীন একটা অদ্ভুত সহনীয় কিন্তু জটিল সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এক সংসারে পাশাপাশি দীর্ঘদিন কাটিয়ে গেছে তারা দুই নারী।
কে জানে এমন একটা সময়ে মনে মনে সম্পর্কের এইরকম ব্যবচ্ছেদ করা ঠিক হচ্ছে কিনা। শবনমের মনে হয় যেকোনো মৃত্যুই এক ধরনের কুহক নির্মাণ করে। মৃত্যুর পটভূমিকায় ব্যক্তি মানুষ, আর তার সাথে সম্পর্কের ধরণ সব কিছুই হঠাৎ করে যেন পাল্টে যায়। এই মুহূর্তে সালেহা খাতুনের মৃতদেহ খাটিয়ায় তুলে কবরস্থানের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারেকের ছোট দুই বোন সালমা আর শামীমা ঘরের মেঝেতে আছড়ে পড়ে মায়ের জন্য মাতম তুলে বাড়াবাড়ি রকম কাঁদছে। শ্রাবণও নিঃশব্দে ঘন ঘন চোখ মুছছে। শোকগ্রস্ত তারেকও ছলছল চোখে বোনদের জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিয়ে গ্রামবাসীর সাথে মায়ের খাটিয়া কাঁধে নিয়ে গোরস্থানের দিকে রওনা হয়েছে। শবনম ঘরের এক কোণায় মুখে কাপড় গুজে চুপচাপ একা বসেছিল। তার মাথার মধ্যে সালেহা খাতুস সংক্রান্ত নানা রকমের তিক্ত মধুর স্মৃতি এসে ভিড় করছিল। বাড়িভর্তি চেনা-অচেনা মানুষ। কেউ সুর করে মাথা দুলিয়ে গুণগুণ করে কোরান শরীফ পড়ছে। কেউ কেউ গুজগুজ ফিসফিস করে একে অন্যের সাথে কথা বলছে। বলতে বলতে কেউ হয়তো মুখে কাপড় চাপা দিয়ে একটু হেসেও ফেলছে, তারপর আবার চেহারায় দুঃখ দুঃখ একটা ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। শোকের বাড়ি জুড়েও কেমন যেন একটা উৎসব উৎসব ভাব। এরই মধ্যে ময়লা ছাপা শাড়ি পরা গ্রামের একজন বয়স্ক মহিলা এসে শবনমকে জিজ্ঞেস করল, ‘শাউড়িরে শেষ দেখা দেখছোনি গো বউ? ’
শবনম মাথা নাড়ে। বয়স্ক মহিলা আবার বলে,
‘তুমার শাউরি গেরামে আইলে খুব সুনাম করতো তুমার, তুমি বলে ঢাকায় অনেক বড় চাকরি করো? অনেক টেকা বেতন পাও? একলা একলা বিদেশেও বলে যাও?’
এসব কথার কোনো উত্তর হয় না, শবনম তাই কিছুই বলে না, চুপ করে থাকে। আরেকজন লম্বা ঘোমটা পরা বয়স্কা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তি করে—
‘চাকরি করা বউরা কি আর শাউরির সেবা যত্ন করতে পারে? এক বেলা রাইন্ধা খাওয়ানোরও তো সময় পায় না, খালি দৌড় আর দৌড়..’
আরেকজন ঘরের আরেক কোণা থেকে হঠাৎ বলে উঠে,
‘বাড়ি গাড়ি টেকা পয়সা কিচ্ছু সাথে যায় না গো, একলা একলাই মাটির ঘরে যাওন লাগে, আজকা মরলে কালকে দুইদিন, দুইদিনের দুনিয়া,আখেরাতই আসল জায়গা ..’
প্রথম বয়স্কা শবনমের সামনে দাঁড়িয়ে বুক চাপড়ায়,
‘আহা, কি ভালামানুষ আছিলো গো বুবু! গরিবের লাইগ্যা অনেক মায়া আছিলো তার বুকে, যতবার গেরামে আইছে ততবারই গরিব দুঃখিরে দুই হাত ভইরা দান করছে। বিপদ আপদে মানুষরে সাহাইয্য করছে, আল্লা বেহেশত নসিব করুক, দোয়া করি।’
শ্রাবণ এসে এসময় শবনমের গা ঘেঁষে বসে, তারপর চোখ বুজে ক্লান্ত মাথাটা এলিয়ে দেয় মায়ের কাঁধে। শবনম চুপচাপ মেয়ের ভেজা ভেজা দুঃখী নরম হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বসে থাকে। দাদীর আঁচল ধরে, তার সঙ্গে নানারকম খুনসুটি করে শৈশবের বেশিটা সময় কাটিয়েছে মেয়েটা, ফলে তার শোক ও শূন্যতাটুকু অনুভব করতে পারছিল শবনম।
‘ও বউ, তোমার মাইয়া তো মাশাল্লাহ বিয়ার উপযুক্ত হইয়া গেছে। কবে বিয়া দিবা? তুমি তো হুনছি, বাইরে বাইরেই রইছো, এরে তো বুবুই কোলের মইধ্যে পাইল্যা লাইল্যা বড় করছে!’
ঘোমটা ঢাকা বয়স্কা শ্রাবণকে দেখে মন্তব্য করে। শ্রাবণ চট করে মাথা তুলে মন্তব্যকারিণীর দিকে তাকায়, হয়তো কিছু বলতে চায়, শবনম তখন আস্তে করে হাত দিয়ে ধরে মেয়ের মাথাটা আবার শান্তভাবে নিজের কাঁধে রেখে দেয়। অস্ফুট কণ্ঠে বলে, ‘দোয়া কইরেন চাচী।’
‘এ্যাঁ গো ও, দোয়া তো করিই .. এই নাতিনরে কত আদর করছে গো বুবু, বুকে রাইখ্যা পালছে, মাটিত নামায় নাই পিপড়া ধরবো, মাথাত রাখে নাই উকুনে খাইব, সোনার টুকরা, কলিজার টুকরা নাতিন গো.. দোয়া করি, ভালা একখান বিয়া হউক তুমার, এ্যাঁ বুবু যুদি দেইখ্যা যাইতে পারতো গো .. আহ্ হা’।
বয়স্কা টেনে টেনে সুর করে বলে। শবনম এবার মেয়েকে নিয়ে উঠে পড়ে। বলে, ‘চলো মা, একটু বাইরে, পুকুরের পাশে হেঁটে আসি।’
আসলে ঘরের এই গুমোট পরিবেশ আর গ্রাম্য কথার অত্যাচার থেকে মুক্ত করে মেয়েটাকে একটু খোলা বাতাসে নিয়ে আসতে চাইছিল শবনম। শ্রাবণ বেরিয়ে এলে ওর পিছু পিছু তারেকের দুই বোন সালমা আর শামীমাও আসে। প্রাচীন পুকুরের শান্ত নীরবতা বুকে নিয়ে ওরা ধীরে ধীরে হাঁটে। আসন্ন সন্ধ্যার নীল আলো জানান দেয় আরেকটা দিন ফুরিয়ে আবার রাত্র আসছে। শামীমা শ্রাবণের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘গ্রামের মানুষের কথায় কিছু মনে কইরো না মামণি, তাদের কথাবার্তা এইরকমই, কোনো রাখঢাক নাই, আসলে বুঝেনাতো.. অশিক্ষিত ..’
‘আমি কিছু মনে করি নাই ফুফুমণি। কারণ আমার দাদুকে ওরা খুব ভালবাসতো। আর তারা যেরকম সরলভাবে জীবন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে তাই বলেছে।’
শ্রাবণ শান্তভাবে বলে।
ওরা পুকুরের পাশে ঘাসে ছাওয়া একটা চত্বরের উপর বসে। সালমা একটু ইতস্তত করে, ‘ভাবি, জানিনা এইসব আলাপ তুলা এখন ঠিক কি-না,আপনে তো ব্যস্ত মানুষ, আবার কখন আপনেরে পাই, আসলে আম্মার গয়না-গাঁটি সব তো ঢাকায়, ওই গুলার ভাগ বাটোয়ারা আম্মা বাঁইচা থাকতেই আমারে বইলা গেছিলেন।’
‘অসুবিধা নাই সালমা। সবই আছে, উনি যেমন রেখে গেছেন। উনার শাড়ি কাপড় গয়নাগাটি, তোমরা ঢাকায় এসে নিয়ে যেও।’ শবনম বলে।
‘আম্মার ঝুমকাগুলি শামীমার মেয়ের জন্য আর মটরদানা হারটা শ্রাবণের, আম্মা বইলা গেছিল..’
‘আমার লাগবে না, ফুপুমণি, আমি তো গোল্ড পরি না, ওটা তোমরা নিয়া নিও।’
শ্রাবণ গম্ভীর ভঙ্গীতে বলে।
‘তোমার লাগবে না কেন? আম্মা বইলা গেছে, এইটা তোমার দাদুর স্মৃতি,পরো বা না পরো, তোমার কাছে রাখবা স্মৃতি হিসাবে।’
‘স্মৃতি তো আমার মনে আছে ফুপু, জিনিস দিয়া কি আর স্মৃতি ধইরা রাখা যায়, মনের মধ্যে না থাকলে?’
শ্রাবণের কথায় শামীমা একটু থমকে যায় হয়তো আহত বোধ করে। শ্রাবণ এবার ফুপুকে জড়িয়ে ধরে, গালে গাল লাগিয়ে আদুরে গলায় বলে,
‘দাদুর ওই সোনার হার তো আমার কাছ থেকে হারায়ে যাইতে পারে ফুপুমণি, চুরিও হইতে পারে, কিন্তু মনের মধ্যে যা আছে তা কোনোদিন হারাবেও না, চুরিও হবে না। এইবার বুঝছো? ওই হার তোমার কাছেই রাখো।’
‘ইশ, এক্কেবারে আমাদের মায়ের মত কথা বলতেছে গো..’
শ্রাবণকে জড়িয়ে ধরে আবার উত্তাল কান্নায় ভেঙে পড়ে তার দুই ফুপু।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/