প্যাপিরাসের পুরোনো পাতা
ভোরবেলা রানা ভাই ঘুম থেকে উঠার আগেই আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। স্ট্রিন্ডবার্গার রিসর্ট থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে সামান্য দূরেই বয়ে যাচ্ছে নীল নদ। ইচ্ছে করলে নীলের বাঁধানো তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাওয়া যায় অনেক দূরে। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে আমরা দিক পরিবর্তন করে ডাইন দিকের গলিপথে ঢুকে পড়লাম। আমাদের দেশের যে কোনো বড় শহরের অপরিসর, আবর্জনা ও জঞ্জালে পরিপূর্ণ ভোরের গলিপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভুলেই গিয়েছিলাম এটি ঢাকা নয় লুক্সর শহরের প্রান্তে একটি পাঁচতারা রিসর্টের পাশের একটি রাস্তা। পথে জনসমাগম নেই, তবে স্কুল ড্রেস পরা শিশুদের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলের পথে যেতে দেখা গেল। কিশোরী মেয়েদের এবং শিশুদের সঙ্গের বোরকা পরা নারী অভিভাবকদের দেখে বোঝার উপায় নেই মিশর নাকি এটি বর্তমানের বাংলাদেশ। আমরা অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে লুক্সরের ঝকঝকে জগতের ঠিক বিপরীত বাস্তবতার খানিকটা দেখে এলাম। এখানেও গায়ে গায়ে ঘেঁষে গড়ে ওঠা গলিপথের বাড়িগুলোর মধ্যে দুই চারটে বাদ দিলে বেশির ভাগই রংচটা-বিবর্ণ, বোঝা যায় শহুরে মধ্যবিত্তের বসবাস এই এলাকায়। এক জায়গায় দুটি বাড়ির মধ্যবর্তী নিচু জায়গায় ডাস্টবিন উপচে পড়ছে আবর্জনা, চারিদিকে ছড়িয়ে আছে পলিথিন ব্যাগ এবং প্লাস্টিকের বোতল। শুধু এখানে কোনো কাক বা কুকুর চোখে পড়েনি।
লুক্সরের অশ্ব‐শকট
রিসর্টে ফিরে গোসল শেষে বাইরে বেরোবার প্রস্তুতি নিয়ে যখন নিচে এলাম, রেস্টুরেন্ট তখন কানায় কানায় পূর্ণ। ইচ্ছে ছিল বাইরে রেলিং দিয়ে ঘেরা চত্বরে টেবিলে বসে নীলের দিকে চোখ রেখে ধীরে সুস্থে ব্রেকফাস্ট করব। কিন্তু আমাদের অনেক আগেই সবগুলো টেবিল দখল করে বসে পড়েছেন নানা দেশের নানা বর্ণের বিচিত্র পোশাকের সব ভ্রমণবিলাসী মানুষ। আমরা তিনজনের জন্য একটা জায়গা খুঁজে বের করে দুজন বসে পড়লাম আর রানাভাই যথারীতি একটু দেরি করে এলেন। যে কোনো বড় রেস্টুরেন্টে বুফে ব্রেকফাস্টে পছন্দ মতো খাবার প্লেটে তুলে আনা আমার কাছে একটা ঝামেলার ব্যাপার। কুড়ি পঁচিশটা আইটেম হলে তাও দেখে শুনে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। কিন্তু যেখানে পশ্চিমের পৃথিবী, আরব দুনিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং প্রাচীন মিশরের ঐতিহ্য বিশাল রেস্তোরাঁর সুদীর্ঘ কয়েকটি টেবিলে এসে মিশেছে সেখান থেকে কিছু বেছে নেওয়া সত্যিই কঠিন। আমরা ঠাণ্ডা ফ্রুট জুস থেকে শুরু করে গরম কফি পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে যখন ক্ষ্যান্ত দিলাম তখন প্রায় দশটা বেজে গেছে।
রিসর্টের সামনে ট্যাক্সি ও টাঙ্গা
কোনো শহরে অন্তত একটা দিন পাবলিক ট্রান্সপোর্টে বা পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে না পারলে সেই শহরের প্রায় কিছুই জানা হয় না। দিনের আলোয় লুক্সর শহর ঘুরে ফিরে দেখা, বিশেষ করে স্থানীয় বাজারে একটা চক্কর দেওয়া আর পথের পাশে কোনো সাধারণ রেস্টুরেন্টে বসে একবেলা স্থানীয় খাবার খাওয়ার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম সাড়ে দশটার দিকে। এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে আমাদের রামপুরা-এফডিসি রুটের মাইক্রোবাসের মতো বাহন দেখা যায়। পাশাপাশি রিক্সার বিকল্প হিসেবে আছে টাঙ্গা। স্ট্রিন্ডবার্গার থেকে বেরিয়ে একটু সামনে এগোতেই এক সারিতে বেশ কয়েকটা টাঙ্গা দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়াগুলো গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কেউ জিরাচ্ছে আবার কেউ অকারণে পা ঠুকছে। ঘোড়ার মালিকদের অবস্থাও একই রকম। অশ্বশকটের আসনে বসে কেউ ঝিমাচ্ছে আবার কেউ কেউ অপ্রয়োজনেই হাঁটাহাঁটি করছে। গেটের বাইরে দুই একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলেও জনপ্রিয়তার দিক থেকে মনে হয় যন্ত্রচালিত বাহনের চেয়ে ঘেড়ারগাড়ি এখানে এগিয়ে আছে। আমাদের দেশে টাঙ্গা এখনো বিরল বাহনে পরিণত হয়নি। কিন্তু অশ্বারোহনে পারদর্শী হলেও শ্বেতাঙ্গ পর্যটকেরা বোধহয় অশ্বচালিত বাহনে ঘোরাঘুরির সুযোগ খুব একটা পায় না। তাই লুক্সর শহরেও ঘোড়ার গাড়ি আরও অনেক দিন দাপটের সঙ্গেই চলাচল করতে পারবে বলে মনে হয়। রানা ভাই দুজনের সঙ্গে কথা বলে একশ পাউন্ড থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত ষাট পাউন্ডে রফা করে গাড়িতে উঠে পাগড়ি এবং জুব্বাধারী চালকের পাশে বসে পড়লেন। কংক্রিটের সড়কে খটখট শব্দ তুলে টাঙ্গা চলতে শুরু করলে টাঙ্গাওয়ালা প্রস্তাব দিল, তোমরা যদি আমার টাঙ্গাতেই ফিরে আসা, তাহলে একশ কুড়ি নয়, তোমাদের একশ পাউন্ড দিলেই চলবে। রানা ভাই বললেন, ‘আমরা তো চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার আগে শহর থেকে ফিরব না।’ টাঙ্গাওয়ালার তাতেও আপত্তি নেই। বললো, ‘আমি টাঙ্গা স্ট্যান্ডে তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করব।’ বিষয়টা নিয়ে নিজেদের মধ্যে অলোচনা করে আমাদের মনে হয়েছে, বছরের এই সময়ে বিশেষ করে করোনা মহামারির পরে এখনো মিশরের পর্যটন বাণিজ্য পুরোপুরি জমে ওঠেনি। তাই হয়তো টাঙ্গাওয়ালা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে হলেও ফিরতি পথের যাত্রী হাতছাড়া করতে চায় না।
লুক্সরের একটি বাজার
লুক্সরের কাঁচাবাজার কিংবা পথের পাশের সাধারণ রেস্টুরেন্টে নিশ্চয়ই ক্রেডিট কার্ড বা মার্কিন ডলার চলবে না। কাজেই শহরের বাজারে ঢুকে যাবার আগেই ডলার ভাঙানো দরকার। আমাদের চলার পথের দু’পাশে ব্যাংকের অভাব নেই। মূল সড়কের উপরেই একটা ব্যাংকের সামনে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। মেইন রোডে গাড়ি রাখলে পুলিশে ধরবে বলে টাঙ্গাওয়ালা তার ঘোড়া এবং গাড়ি নিয়ে পাশেই গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। এখানেও পুলিশ! দেশে বিদেশে ট্যাক্সিওয়ালা, অটো-রিক্সাওয়ালা, টাঙ্গাওয়ালা কারোরই পুলিশি হয়রানি থেকে নিস্তার নেই!
মশলার দোকান
সিঁড়ি দিয়ে উঠে ব্যাংকের প্রবেশ পথের বাইরে এটিএম মেশিনের মতো ডলার ঢুকিয়ে ইজিপশিয়ান পাউন্ড বের করে আনার মেশিনে একশ ডালারের একটা নোট ঢুকিয়ে দিলাম। একটু পরে স্ক্রিনে আরবি এবং ইংরেজিতে যে বার্তা ভেসে উঠলো তার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘তোমার কারেন্সি নোটটিকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না, বদলে দাও’। তারমানে কি এটা অচল একশ ডলারের নোট! একটু ভয় পেয়ে চারিপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ আবার দেখে ফেলেনি তো! অচল নোট দিয়ে পাউন্ড বের করার চেষ্টা দেখে পুলিশ ডাকবে না তো! তবে মেশিন বাহাদুর ‘রিপ্লেস’ করতে বলায় একটু ভরসা পেলাম, অন্য একটা নোট বের করে সাবধানে ঢুকিয়ে দিলাম। না, ভদ্রলোকের আবারও একই কথা, এই নোট চলবে না। এবারে একটু সাহস সঞ্চয় করে ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। চারিদিকে ব্যস্ত লোকজনের মধ্যে একজনকে ধরে বললাম, ‘তোমাদের এটিএম থেকে তো কারেন্সি নোট বদলাতে পারছি না, সমস্যা কী?’ তিনি নিজেও ব্যাপারটা জানেন না, মনে হলো। আরেকজনের সঙ্গে আরবিতে বাতচিত করে জানালেন মেশিনটা একটু সমস্যা করছে, তুমি বরং পাশেই যে ব্যাংকটা আছে সেখানে যাও। এবারে রানা ভাইও আমার সঙ্গে এলেন। একশ ডলার নোটের সোজা দিক উল্টা দিক উল্টে-পাল্টে দেখে মেশিনে ঢুকিয়ে দেবার পরে মুহূর্তেই প্রায় হাজার দুয়েক ঈজিপ্টশিয়ান পাউন্ড বেরিয়ে এলো।
বাজারের গলিপথে সাজানো প্যাপিরাস
আবার অশ্বশকটে উঠে লুক্সর শহরের পথে চলতে চলতে চোখে পড়ে সড়ক দ্বীপগুলোতে শোভা পাচ্ছে ব্রোঞ্জ কিংবা পাথরে তৈরি প্রাচীন মিশরীয় কোনো সুদৃশ্য প্রতীক। রোড ডিভাইডারগুলো সবুজ গাছপালা এবং রঙিন ফুলে সাজানো। দুপাশের উঁচু এবং ছোটবড় দালান কোঠার ফাঁকে ফাঁকেও বৃক্ষলতার আভাস দেখা যায়। এই পথে লুক্সরকে মনে হয় গাছপালায় ছাওয়া সুন্দর সবুজ নগরী। ছুটে চলা ঘোড়ার গাড়ির খটখট আওয়াজের সঙ্গে আমার হঠাৎ করেই একটা গানের কথা মনে হলো। আমি বেসুরো গলাতে বেশ জোরেই গেয়ে উঠি, ‘ও মোর পাগলা ঘোড়ারে...কই থনে কই লইয়া যায়...’ রানাভাই মুখ ফিরিয়ে বলেন, ‘এই ঘোড়া আমাদের খুব বেশি দূরে নিয়ে যাবে না। দুইটা বিখ্যাত বাজার হামিস অথবা আতা বাজার, এই দুটোর একটাতে নিয়ে যাবে।’ শেষ পর্যন্ত পাগলা ঘোড়া আমাদের কোন মার্কেটের সামনে নামিয়ে দিয়েছিল মনে নেই, তবে গন্তব্যে নামিয়ে দেবার আগেই জুব্বাধারী সহিস আমাদের টাঙ্গাস্ট্যান্ড চিনিয়ে দিয়েছিল, সেখানেই সে আমাদের ফেরার জন্যে অপেক্ষা করবে।
স্যুভেনিয়ারের দোকানে
কায়ারোর খানে খলিলি বাজারের মতো এখানেও দোকানিরা সাড়ে এগারোটার দিকে কেবল দোকানের ঝাঁপ খুলতে শুরু করেছে। আমরা সোনা-রূপা-পাথরের অলঙ্কার, তৈজসপত্র, মশলা-পাতি, পোশাক পরিচ্ছদ, বাতিদান-ফুলদানি, প্যাপিরাসের পাতায় আঁকা ছবি, সুগন্ধি এবং সুদৃশ্য স্যুভেনিয়ারের এক বিশাল জগতের ভেতর দিয়ে এগোতে থাকি। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম মিশরে কিছু স্যুভেনিয়ার ছাড়া কোনো কেনাকাটা হবে না। সেই কারণে আমি খুঁজছিলাম প্যাপিরাসের চিত্রকর্ম এবং সহজে বহনযোগ্য কিছু স্মারক। রানা ভাই একটা বড় রকমের মশলার দোকানে ঢুকে মশলাদারের সঙ্গে আলাপচারিতায় জমে গেলেন। কী নেই সেই মশলার দোকানে! পরিচিত দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, গোল মরিচ, জিরা, ধনিয়া, তেজপাতা থেকে শুরু করে নানা রকমের ডাল জাতীয় শস্যদানা, বিট লবন কাবাব চিনির মতো পরিচিত জিনিস থেকে নানা ধরনের অজানা ভেষজ অষুধের এক বিপুল সংগ্রহের ভেতরে ঢুকে রানা ভাই খুদের মতো বিশেষ ধরনের শস্য এবং অপ্রচলিত ডালের সঙ্গে আর্থারাইটিসের হারবাল রিমেডি কিনে ফেললেন। আমরা সে সময় পাশের একটি দোকানে প্যাপিরাসে চিত্রিত অসংখ্য ছবির মধ্যে থেকে নিজেদের পছন্দ মতো ছবি বেছে রাখছি। ছবি নির্বাচনের পালা শেষ হলে পাশের দোকান থেকে রানা ভাইকে ডেকে আনাটাই হেনার কাছে যৌক্তিক বলে মনে হলো। প্রথমত ভাষাগত সমস্যার কারণে প্যাপিরাসওয়ালার সঙ্গে দরদাম করে সুবিধা হচ্ছিল না। রানা ভাইয়ের দীর্ঘ প্রবাস জীবন ইরাকে কেটেছে বলে কাজ চালাবার মতো দু চারটে কথা দিব্যি আরবিতে চালিয়ে নিতে পারেন। দ্বিতীয়ত দরদাম করে কোনো কিছু কেনার ব্যাপারে আমি একেবারেই আনাড়ি। বেছে রাখা গোটা পনের প্যাপিরাসের পাতার দাম এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে ফেলে যখন প্রায় কিনে ফেলেছি সে সময় রানা ভাই এসে তা অর্ধেক করে ফেললেন। উৎসাহিত হয়ে আরো গোটা পাঁচেক বেশি প্যাপিরাস পাতা কিনে আমরা মহাআনন্দে খানিকটা সামনে একটা স্যুভেনিয়ারের দোকানে সেই একই প্রক্রিয়ায় দাম কমাবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কাঁসা পিতলের পাত্র ও বাতিদান, পাথরের ছোট ছোট স্ট্যাচু, চাবির রিং, ম্যাগনেট, স্টিকার এবং আরও নানা পসরা সাজানো দোকানের কট্টর মালিক শুরুতেই বলে দিয়েছিল ‘ফিক্সড প্রাইস’।
লুক্সর শহরে
রানা ভাইয়ের আরবি এবং আমার ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে দরদাম করেও কিছুতেই তাকে গলানো গেল না। অবশ্য দামের দিক থেকে বেশ যুক্তি সংগত বলে আমরা আর বেশি খোজাখুজি না করে তার কাছে থেকেই কিছু স্যুভেনিয়ার কিনে নিয়ে বললাম, ‘এ দেশে আসার পরে তোমার মতো হার্ড হার্টেড মিশরীয় এখন পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি।’
সে কি বুঝল জানি না, তবে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকটা ম্যাগনেট একটা করে সুন্দর প্লাস্টিকের প্যাকেটে ঢুকিয়ে প্যাকেট করে আমাদের হাতে দিয়ে বলল, ‘এই প্যাকেটের জন্য তোমাদের কোনো দাম দিতে হবে না।’
আমরা যখন স্যুভেনিয়ারের বাজার থেকে বেরিয়ে কাঁচা বাজারের দিকে যাচ্ছি তখন কাছেই কোনো একটা মসজিদ থেকে জোহরের নামাজের আজান ভেসে আসছে।
চলবে...