সায়েন্স ফিকশন
হিমাঙ্কের নিচে
ঋতু ঠিকঠাক থাকলে ক্যালেন্ডারের হিসাবে এ সময়টাকে বসন্তকাল বলা যেত। কিন্তু পৃথিবীতে দীর্ঘদিন শীতকাল স্থায়ী হয়ে গেছে। এখানে আলাদা কোনো ঋতু ভাগ নেই। পৃথিবী হয়ে গেছে বরফে আচ্ছাদিত এক অদ্ভুত তুষার জগৎ। তবে যখন এলোমেলো তুষার ঝড় শুরু হয় তখন বোঝা যায় গ্রীষ্ম এসেছে। তাও সব তালগোল পাকানো। তুষার ঝড় যে কেবল গ্রীষ্মে হয় তা নয়। থেকে থেকে শীত, বসন্তেও তুষার ঝড় এসে ওলোটপালট করে দিয়ে যায় চারপাশ।
আনিতি দাঁড়িয়ে আছে গ্লোবাল ইশকুলের মাঠে। ইশকুল বিল্ডিং, চারপাশের গাছ সব বরফে ঢেকে আছে। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা হালকা তুষারপাত হয়ে গেছে। তুষার কণা ঝিরঝির করে ছড়িয়ে পড়ছে। পায়ের নিচে জমাট পুরু বরফের ওপর ঝিরঝিরে তুষার কুচি। আনিতির গায়ে ওয়ার্মস্যুট। ঘরের বাইরে এলে এই পোশাক পরতে হয়। তাতে শরীর গরম থাকে। বাইরের প্রবল ঠাণ্ডা থেকে শরীরকে রক্ষা করা যায়। দেহের তাপমাত্রা ঠিক রাখে।
ছোটো বেলা আনিতি এই ইশকুলে আসত। সবাইকে ৩ বছর বয়স থেকে ৮ বছর বয়স পর্যন্ত ইশকুলে আসতে হয়। শিশুর বয়স ৩ বছর হওয়া পর্যন্ত পরিবারে কঠোরভাবে প্যারেন্টিং মানতে হয়। শিশুর বয়স ৮ বছর পার হলে সে বাড়িতে বসে অনলাইনে ক্লাস করে। তবে সেখানেও প্যারেন্টসের জন্য আলাদা প্যারেন্টিং কোর্স আছে। ইশকুলে নিয়ে আসা হয় শিশুদের সোসালাইজেশনের জন্য। তাতে শিশুরা অন্যদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায়। সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শেখে।
এটা কিয়োতি শহর। ৯ বছর বয়সে আনিতি বাবা-মায়ের সঙ্গে হোয়াইঝি শহরে চলে যায়। হোয়াইঝি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো শহর। আধুনিক সকল ব্যবস্থা সেখানে আছে। কিয়োতি থেকে হোয়াইঝি শহরে যেতে স্কাই রাইডে দেড়ঘণ্টা সময় লাগে।
আজ ইশকুল বন্ধ। ছেলেমেয়েরা কেউ আসেনি। শিক্ষকদের ঘর আটকানো। আনিতি উদাস চোখে কিছুক্ষণ বরফ ঢাকা বিল্ডিং, গাছপালার দিকে তাকিয়ে থাকল। বারবার তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সে যেন সেই ছোট্ট মেয়েটি হয়ে গেছে। তার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন মিস ম্যাগনোলিয়া লিলিফ্লোরা। ওরা ডাকত মিস ফ্লোরা বলে। তিনি একজন অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট। ইশকুল প্ল্যাটোরিয়ামে নিয়ে গিয়ে তারা চেনাতেন। রাতের আকাশে সেই তারা দেখে আনিতি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত। বিলিয়ন নক্ষত্র দিয়ে ভরা মহাকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবত বড়ো হয়ে আমিও মিস ফ্লোরার মতো অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট হব।
মিস ফ্লোরা তাদের পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস বলতেন, রাতের আকাশের দিকে তাকালে দেখবে অসংখ্য তারা। তাদের মধ্যে আছে কয়েকটি গ্রহ। তারার সাথে তুলনা করলে গ্রহগুলো আমাদের পৃথিবীর মতোই ছোটো। এদের আকাশে বড়ো দেখা যায় কারণ এরা আমাদের খুব কাছের।
আনিতি আগ্রহ নিয়ে মিসের কথা শোনে। মিস গ্রহের ছবি দেখিয়ে বললেন, বহুকাল আগে এই পৃথিবী আর গ্রহগুলো সূর্যের অংশ ছিল। সূর্য ছিল এক জলন্ত অগ্নিকুণ্ড আর প্রচণ্ড গরম। একদিন গ্রহগুলো সূর্য থেকে ছিটকে ছোটো ছোটো টুকরো হয়ে আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু তারা পরস্পরকে ছেড়ে গেল না। মনে হয় যেন অদৃশ্য রশি দিয়ে তাদের বেঁধে রাখা হয়েছে। এরা সূর্যের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। পৃথিবী তখন ছিল আগুনের ফুলকির মতো। এর চারদিকে ছিল গরম গ্যাস আর বাতাস।
পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। বরফের ওপর ছায়া পড়েছে। পাশ ফিরে আনিতি দেখল একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার বয়স ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে হবে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মুখের অনেকখানি অংশ গরম কাপড়ে ঢাকা। তবে তার মুখ দেখা যাচ্ছে খানিকটা। সরল সাধারণ মুখ। চোখের দৃষ্টি গভীর ও প্রখর। গায়ে সাদামাটা ওয়ার্মস্যুট। তাতে তার দেহ মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে আছে। পায়ে বরফে হাঁটার মতো সুবিধাজনক বুট জুতা।
ছেলেটি বলল, আজ ইশকুল বন্ধ।
আমাকে আজকেই আসতে হলো। আজ ছাড়া আমার সময় নেই।
তুমি কি কাউকে খুঁজছ?
যেন নিজের অজান্তে আনিতি বলল, মিস ফ্লোরা।
আনিতি এখানে মিস ফ্লোরাকে খুঁজতে আসেনি। যদিও সে ঠিক জানে না মিস ফ্লোরা কোথায় থাকেন। তিনি কোথা থেকে ইশকুলে আসতেন। পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে আনিতি একবার তার শৈশবকে ছুঁতে এসেছে।
ছেলেটি বলল, কোন মিস ফ্লোরা, কী করেন তিনি?
মিস ম্যাগনোলিয়া লিলিফ্লোরা। অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট।
ছেলেটি হাসল। তার হাসি সুন্দর ও সরল। বলল, ও, তারা বুড়িমা। যিনি রাত জেগে আকাশের তারা দেখেন?
আনিতির ভালো লাগছে। সে মিস ফ্লোরার সন্ধান পেয়েছে। তাঁর সঙ্গে একবার দেখা হলে ভালো লাগবে।
আনিতি বলল, তুমি চেনো তাঁকে?
কিয়োতির সকলে চেনে। তুমি বুঝি এখানে থাকো না! কোথা থেকে আসছ?
হোয়াইঝি শহর থেকে। ছোটো বেলায় আমি কিয়োতিতে থাকতাম। এই ইশকুলে আসতাম। তোমার নাম কী?
আমি স্কট। হায়ার এডুকেশন করছি। পাশাপাশি এখানে একটা ফার্ম হাউজে কাজ করি। আজ তো সব বন্ধ।
তুমি আমাকে মিস ফ্লোরার বাড়ি চিনিয়ে দিতে পারবে?
আমাকে ওই পথে ঘরে ফিরতে হবে। তুমি আমার সাথে যেতে পারো।
বুকের ভেতর চাপা উত্তেজনা নিয়ে আনিতি রওনা হলো স্কটের সঙ্গে। তারা যাচ্ছে মিস ফ্লোরার বাড়িতে। আনিতির মনে হচ্ছে মাত্র অল্প কিছুদিন আগে মিস ফ্লোরা তাদের পৃথিবী সৃষ্টির গল্প শুনিয়েছেন।
উত্তপ্ত সূর্য ঠাণ্ডা হতে শুরু করল। তখন পৃথিবীও শীতল হচ্ছে। সূর্যের চেয়ে পৃথিবী ছোটো। তাই তার ঠাণ্ডা হতে সময় লাগল কম। যখন পৃথিবী উত্তপ্ত ছিল তখন এখানে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব ছিল না। ছিল না মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা।
ধীরে ধীরে পৃথিবী আরও বেশি ঠাণ্ডা হয়ে গেল। যখন পৃথিবী বেশ ঠাণ্ডা হয়ে এলো, বাতাসের জলীয়বাষ্প তখন পানিতে রূপান্তরিত হলো। তারপর বৃষ্টি এলো। একটানা দীর্ঘসময় বৃষ্টি হলো। একসময় পৃথিবী আরও বেশি ঠাণ্ডা হলো। পৃথিবীতে তখন জীবজন্তু, গাছপালা দেখা দিলো।
বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্কট মাঝেমধ্যে আনিতির দিকে তাকাচ্ছে। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে কিংবা বলতে চাইছে। তবে কিছু বলছে না। স্কট যাচ্ছে আগে আগে। তার পেছন পেছন আনিতি যাচ্ছে। আনিতির ব্রেইন তাকে নিয়ে গেছে শিশু বেলায়। যেখানে গ্লোবাল ইশকুলে মিস ফ্লোরা তাদের পৃথিবী সম্পর্কে বলছেন। মুগ্ধ হয়ে শুনছে আনিতি।
পৃথিবী ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল, শুষ্ক হচ্ছিল। পৃথিবী যত ঠাণ্ডা হচ্ছে, ততই আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবীর পরিবর্তনের সাথে জীবজন্তুর পরিবর্তন হচ্ছে। একসময় পৃথিবীতে শুকনো জায়গার পরিমাণ বেড়ে গেল। তখন এমন প্রাণী এলো যারা পানিতে থাকতে পারে আবার ডাঙার থাকতে পারে। যেমন ব্যাঙ, কুমির, কচ্ছপ।
একসময় পৃথিবীতে মানুষ এলো। অন্য জীবজন্তু এলো। পাখি এলো। কুকুর, ভালুক, ঘোড়া এলো। অনেক অনেক বছর ধরে পৃথিবী ঠাণ্ডা হতে থাকল। ঠাণ্ডা হতে হতে পৃথিবী একসময় হিমশীতল হয়ে গেল। পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে পরম শূন্যের কাছাকাছি চলে এলো। তারপর পৃথিবীর তাপমাত্রা স্থায়ী হয়ে গেল হিমাঙ্কের নিচে।
বরফ চারদিক ছেয়ে ফেলল। গোটা বিশ্বের ঘরবাড়ি, গাছপালা, জীবজন্তু সকলে বরফে ঢাকা পড়ে গেল। জীবজন্তুরা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে নিজেদের দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলল। তারা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকল।
স্কট দাঁড়িয়ে পড়েছে। আনিতি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সামনে বরফে ঢাকা ছোট্ট এক বাড়ি দেখিয়ে স্কট বলল, ওটা তারা বুড়িমার বাড়ি।
তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ।
মাথা ঝুঁকিয়ে স্কট কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করল। তারপর কৌতুহলী গলায় বলল, তোমাকে কোথাও দেখেছি। তবে কোথায় দেখেছি মনে পড়ছে না। তুমি ভীষণ পরিচিত। অথচ তোমার সাথে আমার আগে কখনো দেখা হয়নি। কী আশ্চর্য!
আনিতি হাসছে। আনিতির চোখ হাসছে। স্কটের কথায় সে আনন্দ পেয়েছে। হাসি মুখে বলল, তুমি আমাকে কোথায় দেখেছ সেটা আমি জানি। তবে তোমাকে এখন বলব না। বললে মজা ফুরিয়ে যাবে। আশা করছি তুমি খুব শিগগির জেনে যাবে আমাকে কেন তোমার এত চেনা লাগছে।
স্কট অপলক দৃষ্টিতে আনিতির দিকে তাকিয়ে আছে। আনিতির চোখে হেঁয়ালি। সে তার ওয়ার্মস্যুটের পকেট থেকে চকলেটের প্যাকেট বের করল। স্কটের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তোমাকে ভীষণ ভালো লেগেছে। ক্র্যানবেরি চকলেট। জানো তো, এটা বিশেষ ধরনের চকলেট। একবার খেলে তিন দিন তোমার শরীর উষ্ণ থাকবে।
ক্র্যানবেরি চকলেটের সঙ্গে স্কট পরিচিত। নাম শুনেছে। বিজ্ঞাপনে ছবি দেখেছে। অনেক দাম। সে কখনো খায়নি। আনিতির হাত থেকে স্কট চকলেটের প্যাকেট নিল। তার মনের ধাঁধা এখনো কাটেনি।
আনিতি ছোটো ছোটো পা ফেলে হেঁটে মিস ম্যাগনোলিয়া লিলিফ্লোরার বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। স্কট তার চলে যাওয়া পথের দিকে তখনো বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে।
২.
দরজার পাশে নেম প্লেটে লেখা ম্যাগনোলিয়া লিলিফ্লোরা। তার পাশে ছয় ইঞ্চি বাই আট ইঞ্চি মনিটরে কয়েকটা প্রশ্ন লেখা।
নাম কী?
কোথা থেকে এসেছ?
কী প্রয়োজন?
কতক্ষণ সময় নেবে?
আনিতি নিজের নাম লিখল। তারপর লিখল গ্লোবাল ইশকুলের শিশু বেলা থেকে এসেছি। আমার প্রিয়মিস ফ্লোরার সাক্ষাৎ চাই। তুমি আমাকে যতক্ষণ সময় দেবে আমি ঠিক ততক্ষণ সময় নেব।
আনিতি ভেবেছে মিস তার লেখা পড়ে রেগে যেতে পারেন। শুধু নামে কাউকে মনে রাখতে পারার কথা নয়। মিসের এত কাছে এসে তাঁকে না দেখে চলে যেতে হবে! আনিতি সিদ্ধান্ত নিল সে প্রশ্নের উত্তরগুলো নতুনভাবে লিখবে, তার পুরো পরিচয় দিয়ে।
ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে গেল। মিস ম্যাগনোলিয়া লিলিফ্লোরা দাঁড়িয়ে আছেন দরজার ওপাশে। গায়ে ঘরে পরা সাধারণ পোশাক। মাথা ভরতি বরফের মতো সাদা চুল। সত্তর বছরের ওপরে বয়স হয়েছে। এখনো বেশ সুঠাম শবীরের গঠন। তেমনি সুদর্শন আছেন। শান্ত গলায় বললেন, আনিতি, ভেতরে এসো।
এত সহজে মিস তাকে চিনতে পারবেন এমনটা আশা করেনি আনিতি।
মিস বললেন, কোথায় থাকো এখন?
হোয়াইঝি শহরে।
কী করো?
কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান একাডেমিতে কাজ করি। নভোচারী।
আরাম করে বসো। তোমাকে বিশেষ ধরনের পানীয় দিচ্ছি। খেয়ে আরাম বোধ করবে।
মিস ফ্লোরা ঘরের পাশের স্পেসে চলে গেলেন। অল্প খানিক বাঁক নিয়ে সেই স্পেস। ঘর ভরতি বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘরের একপাশে বড়ো টেলিস্কোপ। ওপাশে আরেকটি ঘর। তিনি বোধহয় একা থাকেন। আর কারও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কিংবা হয়তো আরও কেউ থাকেন। বাইরে গেছেন। কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে আনিতির আগ্রহ নেই বলে এই ব্যাপারটা সে ভাবতে চাইল না।
ঘর বেশ উষ্ণ হয়ে আছে। আনিতি রীতিমতো গরম বোধ করছে। সে গা থেকে ওয়ার্মস্যুট খুলে ফেলল। ওয়ালে কাপড় ঝুলানোর হুক আছে। সেখানে ঝুলিয়ে রাখল।
মিস ফ্লোরা ফিরে এসেছেন। ট্রের ওপরে দুটো কাচের গ্লাস। একটা গ্লাসে বরফ দেওয়া পানি। আরেক গ্লাসে হালকা সবুজ পানীয়। অনিতার দিকে ট্রে এগিয়ে দিয়ে মিস ফ্লোরা বললেন, বসে আরাম করে খাও।
মিস ফ্লোরার হাত থেকে ট্রে নিয়ে আনিতি সামনের ছোটো টেবিলে রাখল। মিস সামনের সোফায় বসলেন। এপাশের সোফায় আনিতি বসে পড়ল।
মিস ফ্লোরা বললেন, কাছেই ছোটো গ্রিন হাউস আছে। সেখান থেকে কয়েকটা তাজা পাতা নিয়ে এসেছি। এটা খেলে তুমি আরাম পাবে, উষ্ণ বোধ করবে।
আপনার ঘরটা বেশ গরম। আমাকে ওয়ার্মস্যুট খুলতে হয়েছে।
এটাও করা হয়েছে বিশেষ প্রক্রিয়ায়। বহু প্রাচীন পদ্ধতিতে। মাটি আর গাছের শুকনো ডালপালা দিয়ে ঘরের দেয়াল, মেঝে, ছাদ বানিয়েছি।
আনিতি খেয়াল করল ঘরের দেয়াল, মেঝে, ছাদ কাঠ রঙের। তবে কাঠ নয়, অন্যকিছু। সে পানি খায়নি। পানীয় খেয়েছে। মিস অসাধারণ কিছু বানিয়েছেন। খেয়ে ভালো বোধ হচ্ছে। নিজের ভেতর সতেজ আর চনমনে ভাব চলে এসেছে। কিশোরীর মতো ঝলমলে গলায় বলল, আপনার পানীয় পৃথিবীর সেরা। কোনোদিন ভুলব না।
তোমার সাথে দেখা হবে ভাবিনি। সব খবর পাই। নিউজ পোর্টালে যখন দেখলাম তুমি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছ, তোমার ছবি দেখে মনে পড়েছে তোমাকে।
আমাকে চিনতে পেরেছেন!
ইশকুলে তোমার চেহারা ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। মিষ্টি হাসি। বড়ো বড়ো গভীর কালো চোখ। তোমার স্কিনে মেলানিনের পরিমাণ হালকা বেশি। তাতে তোমাকে ২০০৩র৪ থেকে ২৬০৩র্৮ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮০০র্১ থেকে ৯২০৪র্১ দ্রাঘিমাংশের ওদিককার বাসিন্দাদের মতো লাগত। সেজন্য আলাদাভাবে তোমাকে মনে আছে। তা ছাড়া তারা নিয়ে তোমার ছিল প্রচণ্ড কৌতুহল। একবার তুমি আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জ ছাড়িয়ে এন্ড্রোমিয়া ছায়াপথের তারামন্ডল নিয়ে অস্থির হয়ে পড়লে। ওই অতটুকুন বয়সে তোমার মাথায় কীভাবে এমন প্রশ্ন এসেছিল ভেবে অবাক হয়েছিলাম।
নিজের ভেতর অন্যরকম ভালো লাগছে আনিতির। শৈশবকে ছুঁতে এসে সে যেন পুরোপুরিভাবে তার শিশু বেলা ফিরে পেয়েছে। আনিতি চুপ করে আছে। তার গ্লাসের পানীয় শেষ হয়েছে। সে টেবিলে গ্লাস নামিয়ে রেখে বুক সেলফের দিকে তাকিয়ে আছে। কী বলবে ভাবছে। তার কত কথা বলার আছে। কিন্তু এখন মিস ফ্লোরার কাছ থেকে ছোটো বেলার আদর ছাড়া আর কিছুই যেন নেওয়ার নেই।
মিস ফ্লোরা বললেন, খেয়ে যাবে। আজ ছুটির দিন। আমি রিল্যাক্স করি। তোমাকে পেয়ে ভালো লাগছে। কার্লিউয়ের মাংস পুড়িয়ে খাব। পোচার্ডের মাংস শক্ত লাগে। বয়স হচ্ছে। রেডমিট বাদ দিয়েছি। সবই তো ফ্যাক্টরি প্রোডাক্ট। ক্যালরি মেপে বানানো। তবে কিয়োতির মতো ছোটো শহরে খাওয়ার জন্য এখনো কিছু জীবন্ত পাখি-পশু পাওয়া যায়। চাহিদা কম তাই পাওয়া যাচ্ছে। তোমাদের হোয়াইঝি শহরে সম্ভব না। সেখানে চাহিদা অনেক বেশি। (কার্লিউ আর পোচার্ড হচ্ছে তিতির, টার্কি জাতীয় পাখি। যার মাংস বেশ সুস্বাদু)।
মিস আপনি জেনেছেন আমরা প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে যাওয়ার সন্ধান পেয়েছি, হঠাৎ কথাগুলো বলেছে আনিতি। সে যেন মিসের বলা আগের কথাগুলো শোনেনি। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডস নিয়ে ভাবছিল।
প্যারালার ওয়ার্ল্ডস অসংখ্য। বস্তুর মূলে আছে ইলেকট্রন। সেই ইলেক্ট্রন যখন একই সময়ে দুই জায়গায় অবস্থান করতে পারে, তাহলে মানুষ কেন পারবে না। কেন ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি এই জগত একই সঙ্গে আরেক জায়গায় থাকবে না। মিস ফ্লোরা যেন নিজের মনে কথাগুলো বললেন। বুকের অতল গভীর থেকে উঠে আসা কথা।
আনিতি বলল, পৃথিবী থেকে মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পৃথিবী আরও শীতল হয়ে উঠবে। শক্তি উচ্চ তাপমাত্রা থেকে নিম্ন তাপমাত্রার দিকে প্রবাহিত হয়। শক্তির এই চলাচল ব্যবহার করে যান্ত্রিক কাজ আমরা চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু জীবজন্তুর মতো জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে মানুষ পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না।
মিস ফ্লোরা বিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছেন আনিতির দিকে। ভাবছেন সেই ছোট্ট মেয়েটি কত বড়ো হয়ে গেছে। আনিতি বলল, মহাবিশ্বের প্রসারণকে ত্বরান্বিত করছে রহস্যময় এক অ্যান্টিগ্রাভিটি। আর কয়েক বছর পর অনিবার্যভাবে মহাবিশ্ব পৌঁছাবে গভীর হিমশীতলতায়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং চলে যাবে তার চূড়ান্ত সীমায়। আমাদের পরিচিত সব প্রাণের অস্তিত্ব নিঃশেষ হয়ে যাবে।
অ্যান্টিগ্রাভিটি মহাবিশ্বকে ঠেলে আলাদা করে ফেলবে। দ্রুতগতিতে প্রসারিত হতে থাকবে ছায়াপথগুলোর মাঝখানের স্থান। এর গতি হবে আলোর গতির চেয়েও বেশি। তখন মহাবিশ্ব হয়ে উঠবে ভয়ংকর রকম নিঃসঙ্গ। তাপমাত্রা আরও কমে যাবে। হিমাঙ্কের নিচের স্থায়ী তাপমাত্রা মানুষকে চূড়ান্ত পরিণতির মুখোমুখি নিয়ে যাবে। সেটা হবে মানুষের ভয়ংকর হিমশীতল মৃত্যু।
হাহাকারের মতো করে মিস ফ্লোরা বললেন, পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করার বিকল্প পথের সন্ধান করা যেতে পারে।
আমরা ভেবেছি আমাদের রক্ত-মাংসের পলকা দেহ বাদ দিয়ে রোবটিক দেহ ধারণ করার কথা। রক্ত-মাংসের তুলনায় যান্ত্রিক দেহ ঠাণ্ডা বেশি প্রতিরোধ করতে পারে। কিন্তু যন্ত্রকেও তাপগতিবিদ্যার সূত্র মেনে চলতে হয়। তাই রোবটিক দেহ ধারণ করা মানুষের জন্য খুব কঠিন হয়ে উঠবে।
উঠে পড়েছেন মিস ফ্লোরা। কেন জানি তাঁর ভেতর অস্থিরতা কাজ করছে। তিনি স্থির হয় বসতে পারছেন না। বললেন, কার্লিউয়ের মাংস পোড়ানোর ব্যবস্থা করি। ভেড়ার দুধের চিজ আছে। তুমি চাইলে মাংসের সাথে গণ্ডারের দুধের চিজও খেতে পারো।
আনিতিও উঠে পড়েছে। সে মিসের পেছনে এসে দাঁড়াল। মিস কার্লিউয়ের মাংস বের করে গরম পানির বাটিতে ভিজিয়ে দিলেন। আনিতি বলল, স্বচ্ছ কাচের প্লাটফরমের ওপর একজন মেয়ে ব্যালে ডান্স দিচ্ছে। ঠিক তার ওপাশে আরেকজন মেয়েও একইভাবে ব্যালে নাচছে। তাদের দুজনের পা যখন একবিন্দুতে পৌঁছুবে সেটা হচ্ছে এক জগত থেকে আরেক জগতে যাওয়ার পথ। প্রতি বারো বছর পরপর টর্নেডোর লেজের মতো সরু অংশ পৃথিবীর ওপর দিয়ে চলে যায়। ফানেলের মতো সেই নলের আরেকপাশে আছে ভিন্ন জগৎ। ইলেকট্রনের স্পিন লাটিমের মতো হওয়ার জন্য একপাশের ইলেট্রনের স্পিন যদি ডাউন হয় তাহলে অপরপাশের স্পিন হবে আপ। ইলেকট্রনের এই স্পিনগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। আর সেটাই হচ্ছে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে যাওয়ার সংযোগ সেতু। পৃথিবী থেকে বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে যাওয়া ৩৬,০০০ মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তারা প্যারালাল ওয়ার্ল্ডেসের এই সংযোগ পথ দিয়ে আরেক জগতে চলে গেছে।
ঘুরে দাঁড়িয়েছেন মিস ফ্লোরা। তাঁর মুখ শক্ত। দুচোখ পানিতে ভরে আছে। তিনি বললেন, এসব আমি জানি সোনা, তবে তুমি কেন, আমার বাচ্চা মেয়েটি! প্যারালাল ওয়ার্ল্ডসে যাওয়া হচ্ছে ওয়ান ওয়ে জার্নি। সেখান থেকে ফেরা সম্ভব নয়।
মিস ফ্লোরার আবেগ আনিতিকে স্পর্শ করেছে। তার গলার ভেতর মনে হচ্ছে সহসা কিছু আটকে গেছে। সেখানে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।
ভেজা গলায় মিস ফ্লোরা বললেন, পরমাণুর কেন্দ্রে ঠাসাঠাসি অবস্থায় থাকা প্রোটন আর নিউট্রনের চারপাশে নেচে যাচ্ছে ইলেকট্রন। তোমার ওই ব্যালে নাচের মতো। তুমি কীভাবে আশা করছ ইলেকট্রনের স্পিনগুলো তোমার ফিরে আসার পথ বানিয়ে এক জায়গায় দীর্ঘ সময় অবস্থান করবে। সে অবস্থান করবে না। নেচে নেচে দূরে চলে যাবে।
ঢোক গিলে আনিতি বলল, পৃথিবীতে মানুষের বিলুপ্তি ঠেকাতে আমি এই ওয়ান ওয়ে জার্নিতে যেতে রাজি হয়েছি। সেখান থেকে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার মডিউল বানানো হয়েছে। আমি ফিরে আসতে না পারি, পৃথিবীর মানুষকে জানাতে পারব প্যারালার ওয়ার্ল্ডস মানুষের বসবাসের উপযোগী কিনা।
মিস ফ্লোরাকে বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। তিনি গরম পানি থেকে কার্লিউয়ের টুকরো মাংসগুলো এক এক করে তুলে পানি ঝেড়ে শুকনো প্লেটে রাখছেন। তিনি খানিক বিরক্ত হয়ে বললেন, সেজন্য ন্যানোবট পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রুটিন ওয়ার্কের জন্য ভালো। কিন্তু সেগুলো মানবিক অনুভূতি দিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
মিস ফ্লোরা এবার বেশ জোর দিয়ে বললেন, কিন্তু এক জগৎ থেকে আরেক জগতে যাওয়ার যে সংযোগ সেতু তার ঘূর্ণনগতি আর তাপমাত্রার সঙ্গে মানুষ মানিয়ে নিতে পারবে না। সেই সুড়ঙ্গ পথ চুপসে যেতে পারে। সংযোগ পথেই মৃত্যু হবে অভিযাত্রীর। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে যদি প্রবেশ করাই সম্ভব না হয় তাহলে সেখানে যাওয়ার ব্যাপার বিজ্ঞান একাডেমি অনুমোদন দেয় কীভাবে?
আনিতি শান্ত গলায় বলল, বিশেষ স্পেসশিপ বানানো হয়েছে। তার আলোকরশ্মি, বিকিরণ, ভর, ঘুর্ণনগতি, তরঙ্গ এসব নিয়ন্ত্রণের ভেতর নিয়ে আসা হয়েছে।
হাতের মাংস প্লেটে রেখে মিস ফ্লোরা আনিতির দুহাত ধরলেন। ভেঙে পড়া গলায় বললেন, ছোট্ট মেয়ে আমার, পৃথিবীর মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া থেকে ঠেকানোর আর কোনো পথ নেই?
স্নেহের স্পর্শ আনিতিকে উতলা করে তুলেছে। সে নিজেকে কঠিন শাসনের ভেতর বেঁধে ফেলল। মনে মনে বলল, দুর্বল হলে চলবে না। তাকে যেতেই হবে। আনিতি হাসল। ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি মেখে বলল, পৃথিবীর মানুষ কয়েক হাজার বছরের জন্য হাইবারনেশনে চলে যেতে পারে। আবার যখন পৃথিবী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে তখন শীতনিদ্রা থেকে মানুষ জেগে উঠবে। আরেকটা পথও আছে। পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ যেমন বরফে ঢাকা পড়েছে অভ্যন্তরভাগ তেমন নয়। পৃথিবীর ভেতরটা এখনো উত্তপ্ত। ষেখানে চলে যাওয়া যেতে পারে।
মিস ফ্লোরা জানেন এ দুটোর কোনোটা সম্ভব নয়। তিনি বললেন, হেঁয়ালি কোরো না, মা। সত্যি কোনো পথ নেই?
আমরা অন্যগ্রহে বসবাস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি সেই প্রাচীনকাল থেকে। কোনো গ্রহের গ্রাভিটি আর বায়ুমণ্ডল মানুষের বসবাসের উপযোগী নয়। তাকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে তোলাও সম্ভব হবে না।
মিস ফ্লোরা আর কিছু বললেন না। তিনি ঘুরে কার্লিউয়ের টুকরো মাংসগুলো একটা একটা করে চিকন লোহার শিকে গাঁথতে থাকলেন।
আনিতি নরম গলায় বলল, আপনার স্মরণ আছে মিস, এ্যাকুয়ারিয়ামে পানিতে কয়েকটি গোল্ডফিসের সাঁতার কাটার কথা বলেছিলেন। মাছগুলো এ্যাকুয়ারিয়ামকে বাস্তব বলে জানে। এ্যাকুয়ারিয়ামের পৃষ্ঠতলে মাছদের নিখুঁত প্রতিলিপি থাকে। মাছ যখন পানিতে সাঁতার কাটে তখন তা এ্যাকুয়ারিয়ামের পৃষ্ঠতলে প্রতিফলিত হয়। এ্যাকুয়ারিয়ামে থাকা আর এ্যাকুয়ারিয়ামের পৃষ্ঠতলে থাকা উভয় মাছ ভাবে তারা বাস্তব মাছ। অন্যটাকে মনে করে বিভ্রান্তি। উভয় মাছই জীবন্ত আর তারা প্রকৃত মাছের মতো আচরণ করে। কারণ, গাণিতিকভাবে তারা সমতুল্য। আবার তাদের আলাদা করাও যায় না। আয়নার প্রতিবিম্ব কিংবা মানুষের ছায়ার মতো যদি একজন সবসময় আরেকজনকে আঁকড়ে থাকে তাহলে ফিরে আসা সম্ভব হলেও হতে পারে।
বুকের ভেতর আটকে রাখা দম ফেলে মিস ফ্লোরা বললেন, তাই যেন হয়।
আনিতি ঘুরে পাশের ঘরে যেতে যেতে বলল, যদিও আমি তেমন কিছু আশা করছি না।
দু’চোখ পানিতে ভরে গেছে আনিতির। সে যে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে সেজন্য নয়। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারটি সে মেনে নিয়েছে। মিস ফ্লোরার ভালোবাসা তাকে কাতর করে ফেলেছে। অনেক দিন পর আনিতি কাঁদল। তার দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ল গালে।
৩.
স্কট নিজের ঘরে নিউজ পোর্টালের ক্রিস্টাল মনিটরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান একাডেমি বিশ্বব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত সবাইকে নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করার নির্দেশ দিয়েছে। এমার্জেন্সি আর সিকিউরিটির দুটো অতিরিক্ত নম্বর দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে সেখানে কল করে জানাতে হবে। এমার্জেন্সি বা সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যের জন্য কেউ চলে আসবে।
আজ বিশেষ দিন। দুপুর বারোটা পয়ত্রিশ মিনিটে হোয়াইঝি শহরের ওপর দিয়ে টনের্ডো বয়ে যাবে। এমন টর্নেডো মাঝেমধ্যে হয়। বরফকুচি পাক খেতে খেতে আকাশে উঠে যায়। ওপরের দিকটা চওড়া গোলাকার আর নিচের দিকটা সরু লেজের মতো। ফানেলের মতো। ভীষণ জোরে ঘুরতে থাকে। টনের্ডোর লেজ মাটির সাথে লেগে থাকা বরফের ওপর দিয়ে যায়। তখন তার সাথে আশপাশের বরফ মাটি থেকে উঠে এসে ঘুরতে থাকে।
নিউজে জানাচ্ছে এটি সাধারণ কোনো টর্নেডো নয়। বিশেষ ধরনের স্পিন। প্রতি বারো বছর পরপর পৃথিবীর কোনো অঞ্চলের ওপর দিয়ে যায়। এটা প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে যাওয়ার পথ। পৃথিবী থেকে একজন মানুষ আজ সেই পথ দিয়ে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে যাবেন। যেখানে মানুষের বসবাসের সুযোগ আছে কিনা তা অনুসন্ধান করবেন। যিনি যাবেন তিনি আর কোনোদিন পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবেন না। তবে সেখান থেকে পৃথিবীতে তথ্য পাঠাতে পারবেন।
লম্বা এক স্পেসশিপে তিনি উঠে বসেছেন। বারোটা পয়ত্রিশ মিনিটে হোয়াইঝি শহরের যেখান দিয়ে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের স্পিন যাবে সেখানে স্পেসশিপ রাখা আছে। মানুষের বিলুপ্তি রক্ষা করতে স্পেসশিপে উঠে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে যিনি যাচ্ছেন তার নাম আর ছবি দেখানো হচ্ছে।
স্কট তাকে চিনতে পেরেছে। তারা বুড়িমার বাড়িতে সেদিন এই মানুষকে সে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। এর আগেও তার ছবি নিউজে দেখিয়েছে। তাই তাকে এত বেশি পরিচিত মনে হচ্ছিল। ধাঁধা এখন ধরতে পেরেছে স্কট। সে ক্রিস্টাল মনিটরের দিকে তাকিয়ে স্থিরভাবে বসে থাকল।
ধেয়ে আসছে টনের্ডো। স্পিন এগিয়ে আসছে হোয়াইঝি শহরের নির্দিষ্ট পথে। স্পেসশিপ বাতাসে দুলছে। দুলতে দুলতে স্পেসশিপ স্পিনের ঘূর্ণনের ভেতর ঢুকে পড়েছে। তাকে আর দেখা গেল না। টর্নেডোর লেজ অনেক দূরে যেতে যেতে হারিয়ে গেল।
নিজ বাড়িতে বহুদিন পর মিস ম্যাগনোলিয়া লিলিফ্লোরা প্রাচীন পদ্ধতিতে প্রার্থনা করলেন, আনিতি যেখানে থাকুক ভালো থাকুন। সে সুসংবাদ নিয়ে সুস্থ দেহে পৃথিবীতে ফিরে আসুক।
৪.
বিশাল বাগান। সেখানে শত বছরের পুরাতন গাছ। মোটা মোটা ঝুরি নেমেছে গাছ থেকে। তাতে অগোছালোভাবে জড়িয়ে আছে সবুজ পরগাছা।
বাগানের ভেতর সুক্ষ্ম নেট দিয়ে ঘেরা বেশ বড়ো লোহার খাঁচা। সেই খাঁচায় আটকে রাখা হয়েছে আনিতিকে। এ জগতে ঢুকতেই নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে ধরে ফেলেছে। বন্দি করে রেখেছে জনমানবহীন বাগানের ভেতরের খাঁচায়। স্পেসশিপ থেকে বের হয়ে আসতেই আনিতি ধরা পড়ে গেছে। বেশিক্ষণ সময় নেয়নি নিরাপত্তা কর্মীরা। দ্রুত দেহ তল্লাসী করেছে। পুরো শরীর আর ব্রেইন স্ক্যান করে তাকে নিয়ে এসে এই খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি বা প্রশ্ন করার প্রয়োজন বোধ করেনি। তারা নিশ্চিত স্ক্যান করা ব্রেইন থেকে সব জানতে পারবে। চলে যাওয়ার আগে নিরাপত্তা কর্মীরা তার সঙ্গে থাকা ডিভাইস নিয়ে গেছে। তাতে আনিতির পক্ষে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করার সকল সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। সে এখানে নেমে স্পেসশিপ থেকে পৃথিবীকে জানিয়েছিল, পৌঁছে গেছি।
খাঁচার এক কোনায় দুই হাঁটুর ভেতর মাথা দিয়ে বসে আছে আনিতি। তার মাথার ভেতর টনটন করছে। শরীর গুলাচ্ছে। পেটের ভেতর পাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখুনি বমি হয়ে যাবে। পানি খেতে পারলে ভালো লাগত। পিপাসা পেয়েছে। গলা শুকিয়ে আসছে।
আশপাশে কেউ নেই। খাঁচার দিকে দু’জন মানুষকে দৌড়ে আসতে দেখেছিল। তারপর দেখল মানুষ দু’জন খাঁচার কাছে আসার আগেই একটা নেকড়ে আর একটা শেয়াল ছুটে আসছে। তারা খাঁচার পাশ দিয়ে দূরে কোথাও চলে গেল। আবার সব শুনসান হয়ে গেল।
আনিতি বুঝতে পারছে তার ব্রেইন কোনো কারণে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। সে শেয়াল আর নেকড়ে দেখে মানুষ ভেবেছে। থেকে থেকে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। কর্কশ স্বরে ডাকছে পাখি। ভয়ংকর, রক্ত হিম করা ডাক। দূর থেকে মানুষ আর জীবজন্তুর সম্মিলিত চিৎকার ভেসে আসছে। পুরো ঘটনা কেমন বিশৃংখল এবং অস্থির বোধ হচ্ছে।
এই মেয়ে শুনছ? কেউ একজন তাকে ডাকছে। যে ডাকছে তার গলার স্বর রুক্ষ নয়, ভদ্র ও নরম।
ক্লান্ত মাথা তুলে আনিতি তাকাল। খাঁচার বাইরে অতি সুদর্শন একজন তরুণ দাঁড়িয়ে আছে। বয়স ৩২ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে হবে। গায়ের রং ধবধবে ফরসা। সবুজ চোখ। মাথা ভরতি কোঁকড়ানো চুল। খাড়া নাক। খাঁজকাটা বলিষ্ঠ শরীরের গঠন। তাকে দেখলে অনায়াসে ছবিতে দেখা প্রাচীন গ্রিসের কোনো তরুণের ভাস্কর্যের কথা মনে পড়ে যায়।
তরুণ বলল, এটা খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।
তরুণের হাতে রূপার তৈরি গ্লাস। তাতে পানি ভরতি মনে হচ্ছে। পানি দেখে আনিতির পিপাসা বেড়ে গেল। তরুণ খাঁচার একপাশের নেটের খুব ছোটো একটুখানি অংশ খুলে ভেতরে গ্লাস এগিয়ে দিলো।
আনিতি কোনো কথা না বলে গ্লাস হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিয়েছে। গ্লাসে পানির মতো স্বচ্ছ চেহারার কোনো ফল বা গাছের রস। স্বাদ অনেকটা তেঁতুলের মতো। তবে খেতে ভালো। শরবতটুকু খেয়ে আনিতির আরাম বোধ হচ্ছে। হুট করে তার মাথা ব্যথা চলে গেছে। বেশ হালকা লাগছে মাথা। বমি ভাব নেই। শরীরে সতেজ তরতাজা ভাব।
আনিতি বিনয়ী গলায় বলল, তোমাকে ধন্যবাদ। আমার নাম আনিতি। তোমার নাম জানতে পারি?
আমার নাম মারিস। তোমাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাকে। আমি সেন্ট্রাল কাউন্সিলের সিকিউরিটি হেড। আমার ওপরে আছেন সিকিউরিটি ডিরেক্টর এবং সিকিউরিটি জেনারেল। তোমাকে এ কথাগুলো এজন্য বলছি, আমার কাছে কোনো সহযোগিতা চেয়ে লাভ হবে না। হাই কমান্ডের নির্দেশ ছাড়া তোমাকে কোনো সহযোগিতা আমি করতে পারব না।
ছেলেটির কথা শুনে তাকে বয়সের চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক মনে হচ্ছে। সে বেশি বয়সের মানুষের মতো করে কথা বলছে। অনুনয় মেশানো গলায় আনিতি বলল, তোমার কাছে কোনো সহযোগিতা আমি চাইব না। শুধু তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও চলে যেয়ো না। এখানে আমার ভীষণ ভয় লাগছে।
আনিতির এই কথায় মারিসের ভেতর পরিবর্তন দেখা দিলো। কিছু একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। স্পার্ক করার মতো কিছু। মারিস পাশ থেকে গাছের ছোটো গুড়ি এনে তার পাশে বসল। আনিতির শরবত খাওয়া শেষ হয়েছে। মারিস গ্লাস ফেরত নেয়নি। সে নমনীয় গলায় বলল, তুমি পৃথিবীর মানুষ। হিমশীতল পৃথিবীতে আগামীতে মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাদের টিকে থাকার আবাস খুঁজতে এসেছ। তুমি আর কোনোদিন পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে না জেনেও এসেছ!
এসব কথা তুমি কীভাবে জানো?
সেন্ট্রাল কাউন্সিল আমাকে জানিয়েছে।
অবাক হয়ে আনিতি বলল, তোমার মতো আর কাউকে এখানে দেখছি না!
এটা নিম্ন শ্রেণির মানুষের বসবাসের স্থান। যারা অন্যের খাবার চুরি করে খায়। লুট করে। তারা থাকে এখানে। সেন্ট্রাল কাউন্সিল এখান থেকে অনেক দূরে।
আতঙ্কিত গলায় আনিতি বলল, রাতে তুমি আমাকে এখানে একা রেখে চলে যাবে!
মারিস অস্থিরতা বোধ করছে। বহুদিন সে কারও এমন শান্ত, নির্ভরশীল, আদরমাখানো উৎকণ্ঠিত চেহারা দেখেনি, কথা শোনেনি। আশ্বস্ত করার মতো গলায় বলল, এখানে কখনো রাত হয় না।
আনিতি তাকিয়ে দেখল চারপাশ বিকেলের নরম আলোয় ছেয়ে আছে। সে যখন এসেছিল তখন থেকে আবহাওয়া একই রকম। একটুও বদলায়নি।
বিস্মিত হয়ে বলল, এটা তোমরা করেছ?
আনিতিরি সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে মারিসের। সে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আমরা করেছি। প্রয়োজন হলে আমরা পুরোপুরি অন্ধকার করে দিতে পারি। দরকার হলে উজ্জ্বল আলোতে ভরে যাবে যতখানি জায়গা ইচ্ছে।
তোমরা আর কী করেছ?
তুমি যখন কোনোদিনই পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে না, আমাদের একজন হয়ে থাকতে হবে, তোমাকে বলা দরকার। আমরা সবদিক দিয়ে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছি। এখন আমাদের নতুনভাবে আর কিছু করার নেই। আমরা এখন যা ইচ্ছে তাই করি। আর এই যা ইচ্ছে তাই করতে গিয়ে শুরু হয়েছে চরম বিশৃংখলা।
মারিস চুপ করে আছে। মনে হচ্ছে সে কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। আনিতি বলল, ছোট্ট শহরে আমার জন্ম। আমার বয়স আট বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। শহরের পাশ দিয়ে নদী বয়ে গেছে। নদীর নাম দারিয়া। বরফে ঢাকা নদী। পুরু বরফের নিচে পানির স্রোত বয়ে যাওয়ার শব্দ শোনা যায়। আমার যখন ভীষণ মন খারাপ হতো, দারিয়ে নদীরপাড়ে গিয়ে বসতাম। বরফের নিচ দিয়ে নদীর বয়ে যাওয়া কুলকুল আওয়াজ শুনতে পেতাম। কোনোদিন পানির স্রোত বয়ে যাওয়া দেখতে পাইনি।
আনিতির চোখ ছলছল করছে। মারিসের ইচ্ছে করছে আনিতির কাঁধে হাত রাখতে। সে চুপচাপ বসে আছে। বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভ‚তি হচ্ছে। কেমন যেন এলোমেলো ভাব। দড়ি পাকানোর মতো মুচড়াচ্ছে।
মারিস বলল, তোমাকে পছন্দ হয়েছে। তুমি একজন দরদমাখানো স্নেহশীল মানুষ। আমাদের এখানে নদী আছে। নদীতে স্রোত বয়ে যায়। তোমাকে দেখাতে নিয়ে যাব।
ঝলমল করে উঠেছে আনিতি। যেন বানানো নয়, আন্তরিক। কিশোরীর আনন্দ নিয়ে বলল, সত্যি নিয়ে যাবে তুমি আমাকে নদীর স্রোত দেখাতে!
আচমকা কেন জানি মারিসের চোখ ভিজে এসেছে। এত অল্পে একজন মানুষ প্রবল খুশি হতে পারে! সে আর্দ্র গলায় বলল, সত্যি নিয়ে যাব।
যখন আমার আর পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, এখানেই থাকতে হবে, তাহলে আমাকে আটকে রেখেছ কেন?
তোমার নিরাপত্তার জন্য। এখানে যে জীবজন্তু দেখতে পারছ এরা বেশিরভাগ মানুষ। আমরা জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছি যেখানে নিজেদের দৈহিক গঠনের পরিবর্তন ঘটাতে পারি। ইচ্ছে করলে আমরা মানুষ থেকে ঘোড়া হতে পারি, বাঘ হতে পারি, পাখি, ছুঁচো যা ইচ্ছে হতে পারি।
আনিতি বুঝতে পারছে সে ভুল দেখেনি। দুটো মানুষ আসতে আসতে হঠাৎ নিজেদের বদলে ফেলে নেকড়ে আর শেয়াল হয়ে গিয়েছিল।
মারিস বলল, যে কারও ইচ্ছে হতে পারে তোমাকে নিয়ে খেলতে। ভাল্লুক হয়ে খামচে দেবে। বানর হয়ে গাছে ঝুলিয়ে রাখবে। সাপ হয়ে ভয় দেখাবে। তোমার খাঁচা নেট দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। যাতে কেউ ছুঁচো বা ইঁদুর হয়ে তোমার কাছে চলে যেতে না পারে।
আমার ভীষণ ভয় করছে, মারিস।
তোমার ভয় নেই, আনিতি। এখানে আমি আছি। তারা আমাকে ভয় পায়। এখানকার শাস্তি অতি কঠিন। দেখছ তো তারা কেউ এদিকে আসছে না।
তোমার তো অনেক ক্ষমতা!
২০ বছর বয়সে সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টে ঢুকেছি। ৪০ বছর হয়ে গেল এখানে কাজ করছি। একটু একটু করে অর্জন করেছি আজকের এই ক্ষমতা।
অবাক হয়ে আনিতি বলল, তোমার বয়স কত?
৬০ বছর।
তোমাকে দেখে ভেবেছি, ৩২ থেকে ৩৫ বছর হবে।
তোমার অনুমান ভুল নয়। আমরা অমরত্ব লাভ করেছি। বিশৃংখলা শুরু হয়েছে সেখান থেকে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর আমাদের ব্রেইন স্ক্যান করে রেখে দিই। হিংস্র পশুর ছোবলে কয়েকদিন আগে আমার মৃত্যু হয়েছিল। বিশ্বস্ত একজন সিকিউরিটি মেম্বারকে বলে গিয়েছিলাম ৩৫ বছরের দেহে যেন আমার ব্রেইন প্রতিস্থাপন করা হয়। তার জন্য তাকে বেশ মোটা অংকের ইউনিট দিয়ে গিয়েছিলাম।
তুমি তোমার স্ত্রী, সন্তান বা নিকট আত্মীয় কাউকে না বলে সিকিউরিটি মেম্বরকে কেন বললে?
মারিসকে বিষন্ন দেখোচ্ছে। সে বুকের ভেতর থেকে লম্বা শ্বাস টেনে এনে বলল, নিকট আত্মীয়রা কেউ চায় না যে ৬০, ৬৫ বা ৭০ বছর বয়সে মরে গেছে সে আবার ফিরে আসুক। তাতে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গা কমে আসে।
তারপর মরিস বলল, এখন ইচ্ছে করলে আমি আমার ৬০ বছরের ব্রেইন বদলে সেখানে ২০, ৩৫ বা ৪৫ বছরের ব্রেইন লাগিয়ে নিতে পারি। তাতে অবশ্য পরবর্তী বছরের অভিজ্ঞতাগুলো আলাদাভাবে জুড়ে দিতে হবে। এতে জীবনের উত্তেজনা অনেক কমে যায়। ২০ বছরের উচ্ছ্বলতাকে ৬০ বা ৭০ বছরের অভিজ্ঞতা কেবলই দমিয়ে রাখতে চায়। তখন আবেগের চেয়ে যুক্তি কাজ করে বেশি। জীবন হয়ে যায় গাণিতিক, যান্ত্রিক।
বাঃ, তুমি তো ভীষণ সুন্দর কথা বলো। অ্যাই মারিস, শোনো। এখান থেকে বের হয়ে কিন্তু আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। আমি তোমাকে ছাড়া আর অন্য কারও সঙ্গে থাকব না।
মারিসের ভেতরটা দুলে উঠেছে। আবেগে সে থরথর করে কাঁপছে। বিশৃঙ্খল ৬০ বছর কাটিয়ে এসে সে যেন প্রথম প্রশান্ত জীবনের স্পর্শ পেয়েছে। নিজের মনের ভাব প্রকাশ হতে দিলো না। স্বাভাবিক গলায় বলল, এখানে যত মানুষ দেখবে, সবাই একাধিকবার মরে ফিরে এসেছে। নতুন বয়সে, নতুন দেহে।
আনিতি এখানকার অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা করতে পারছে। সে জিগ্যেস করল, তুমি যখন মারা যাও, তখন তোমার শরীরের বয়স হয়েছে ৬০ বছর। সিকিউরিটি মেম্বার তোমার জন্য ৩৫ বছরের দেহ কোথা থেকে জোগাড় করল?
এখানে বিভিন্ন বয়সের দেহ বানানো হয়। সুন্দর গঠনের দেহের দাম খানিকটা বেশি। এলেবেলে দেহের দাম কম। সেসব দেহের ফিনিশিং ভালো না। কারও হাত বাঁকা, কোনো এক পা ছোটো। দুই কাঁধের মাপ ঠিক নেই।
আর তোমার দেহ।
সেটা মাটি চাপা দিয়েছে। কেউ বিক্রি করে দেয়।
আদুরে গলায় আনিতি বলল, আমাকে কবে নদীর স্রোত দেখাতে নিয়ে যাবে?
খুব শিগগিরি। সম্ভব হলে আজই সেন্ট্রাল কাউন্সিলকে জানিয়ে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করব।
বলে গাঢ় গলায় বলল, জানো আনিতি...।
বলো শুনছি।
দাদুর মুখে ছোটো বেলায় শুনেছি। বহু-বহুদিন আগে আমাদের এ জগতও হিমশীতল হয়ে বরফে ঢেকে গিয়েছিল। তারপর মানুষ আবিষ্কার করল সামারু গাছ। সেই গাছ আবার আমাদের জগৎকে আগের পরিবেশে ফিরিয়ে আনল।
কীভাবে হলো?
সেটা কীভাবে হলো বলেতে পারব না। তবে এখন খুব কম দেখা যায় সামারু গাছ।
আনিতি মনে রাখল সামারু গাছ। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, তোমরা আর কী করেছ?
মারিস বলল, সকলের জন্য লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছি। আমাদের এখানে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। কেউ বাড়িতে পড়তে পারে না। শিক্ষকতা বলে কোনো পেশা নেই। লেখাপড়া শিখলে নতুন ভাবনা মাথায় আসে। তারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কাউন্সিলের নিয়মকানুন মানতে চায় না। বিদ্রোহ করে। সমস্ত বইপুস্তক পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা শ্রমিক তারা অন্যদের দেখে কাজ শেখে। এখানে খাওয়ার কোনো অভাব নেই। তুমি নিশ্চয় জানো, ক্ষুধার্ত মানুষ মাত্রই বিক্ষুব্ধ মানুষ। এদের যখন খাওয়ার চিন্তা নেই তখন লেখাপড়ার চিন্তাও নেই। জোর করে ধরে এনে শ্রমিক বানানো হয়। আর কেউ যদি আইন মানতে না চায় তবে সিকিউরিটি মেম্বারদের বাঘ কিংবা নেকড়ে নাহয় কুমির বানিয়ে তাদের খাইয়ে দেওয়া হয়।
আনিতির আবার গা গুলিয়ে উঠেছে। এখানে মানুষ দিয়ে মানুষ খাওয়ানো হয়। মানুষকে শ্রম দিতে বাধ্য করে। নিয়ম মানবে না বলে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে। এখানে মানুষের স্বাধীনতা, শ্রদ্ধা, মর্যাদা কিছু নেই। তারা জন্ম থেকেই দাস।
আনিতি হাই তুলে ইচ্ছে করে বানিয়ে বলল, খাবার কথা শুনে আমারই তো ক্ষুধা পেয়ে গেল, মারিস।
অমনি মারিস ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ব্যস্ত গলায় বলল, দেখ তো, কথা বলতে বলতে তোমার খাবারের কথা ভুলেই গেছি। আমি এখুনি তোমার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছি।
আনিতি আবার আদুরে গলায় বলল, তুমি যেয়ো না, মারিস। আমার এখানে একা ভীষণ ভয় লাগবে।
আচ্ছা তোমাকে ছোট্ট একটা ডিভাইস দিয়ে যাচ্ছি। তুমি তাতে খেলা করো। ততক্ষণে তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসব। আশা করি খাবার তোমার পছন্দ হবে। একটু দেরি হতে পারে। ভয় পেয়ো না। খাঁচার ভেতর তুমি সুরক্ষিত। আর দারুণ উত্তেজনার গেম আছে দেখবে। খেলতে খেলতে কখন সময় চলে যাবে বুঝতেই পারবে না।
বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। আনিতি যেন এমন কিছু চাইছিল। মুখ ফুটে চাওয়ার আগেই তার হাতে ডিভাইস চলে আসছে।
নেটের একপাশ খুলে ছোটো মনিটরের মতো একটা ডিভাইস দিলো মারিস। বলল, তুমি খেলো, আমি আসছি।
নেটের খোলা অংশ বন্ধ করে দিয়ে মারিস চলে গেল।
আনিতি দ্রুত খাঁচার একপাশে গিয়ে বসে পড়ল। জায়গাটা ছায়াঘেরা। ডিভাইস ওপেন করে দেখে তার ভেতর মারামারি আর সব যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। ভালো লাগল না। সে সাবধানে হা করে মুখের ভেতরের এক দাঁতে পরানো ক্যাপ খুলে ফেলল। গোপনীয়তার জন্য আলাদাভাবে ন্যানোচিপস সে দাঁতের মাপে ক্যাপ বানিয়ে তার ভেতরে নিয়ে এসেছে। স্ক্যানিং মেশিন সেটা ধরতে পারেনি।
আনিতির পোশাকে ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে অতি হালকা ধাতব ন্যানোটিউবের সুতার ডিজাইন করা হয়েছে। সুতার ওপরে অদৃশ্য ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রামের প্রলেপ আছে। রূপার গ্লাস বিদ্যুৎ পরিবাহী। সে রূপার গ্লাসে ধাতব সুতা পেঁচিয়ে ন্যানোচিপসের সঙ্গে জোড়া দিলো। ধাতব সুতার মাথা সংযুক্ত করল মারিস দিয়ে যাওয়া ডিভাইসের সঙ্গে।
আনিতি প্রবলভাবে উত্তেজনা বোধ করছে। সে নেটওয়ার্কের সংযোগ পেয়ে গেছে। তবে তা খুব দুর্বল। পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে না। তাতে অসুবিধা আছে। পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে এখানকার সেন্ট্রাল সিকিউরিটি সেটা ধরে ফেলতে পারে।
ইন্টারনেটে আনিতি দ্রুত সামারু গাছের সন্ধান করল। সামারু গাছের তথ্য পাওয়া গেছে। সে তার চিপসে তথ্য কপি করে নিল।
সময়ের হিসাব জানা দরকার। হিসাব পাওয়া গেছে। আনিতি ঘাড় তুলে দেখল মারিস চলে এসেছে কিনা। মারিস এখনো আসেনি। সামনে দিয়ে দুটো খরগোশ দৌড়ে চলে গেল।
আনিতি এখানকার মানুষের খর্বাকৃতি ও স্থ‚লকায় হওয়ার প্রযুক্তি অনুসন্ধান করে পেয়েছে। সাথে খোঁজ করেছে ব্রেইন স্ক্যান করে রাখার ব্যাপারটা। সব তথ্য সে চিপসে কপি করেছে।
তারপর স্থানীয় আবহাওয়া জানতে চাইল। হকচকিয়ে গেছে আনিতি। টর্নেডো ধেয়ে আসছে। তার চোখ স্থির হয়ে গেছে। এটা টর্নেডো নয়, প্যারালাল ওয়ার্ল্ডসের সংযোগ সেতু। ইলেকট্রনের নেচে যাওয়া স্পিন।
সে টনের্ডোর গতি ও পথের ম্যাপ খুঁজে বের করল। তাকে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। সহজেই পাওয়া গেছে। এখান থেকে নেচে আসা স্পিনের দূরত্ব জানল। মনে মনে হিসাব করল কত কদম ফেললে কতক্ষণে সেখানে গিয়ে পৌঁছানো যেতে পারে।
শুকনো পাতায় মড়মড় শব্দ হচ্ছে। আনিতি মুখ তুলে তাকাল। খাঁচার জালের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে মারিস আসছে। সে তাড়াতাড়ি ডিভাইস থেকে চিপস খুলে ফেলল। সুতা দলা পাকিয়ে একপাশে ছুড়ে ফেলেছে। চিপস ক্যাপে রেখে দাঁতে আটকানোর আগেই মারিস চলে এলো।
আনিতি দাঁতের ক্যাপ, ন্যানোচিপস তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলে টাইকো নামে এক গেম বের করল। দুজন মানুষ ডুয়েল লড়ছে। মনোযোগ দিয়ে খেলথে থাকল।
মারিস বলল, একটু দেরি হয়েছে। আশা করি তুমি ভয় পাওনি এবং খেলা পছন্দ হয়েছে।
তার হাতে খাবার।
জালের জানালা খুলে খাবার মারিস খাবার এগিয়ে দিলো। খাবার নিতে নিতে আনিতি বলল, অসাধারণ সব খেলা। খাবারের সুন্দর গন্ধে ক্ষুধা আরও বেড়ে গেল। তোমার সাথে বসে খেতে পারলে ভালো হতো। আজ আমার বিশেষ একটি দিন।
কথাটা আনিতি ইচ্ছে করে বানিয়ে বলেছে। তাকে এই মুহূর্তে খাঁচা থেকে বের হতে হবে।
মারিস আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, আজ কী তোমার?
আজ আমার জন্মদিন।
ঝলমলে চোখে মারিস বলল, তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়া। অনেক বছর সুস্থভাবে আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকো তুমি।
তোমাকে ভালোবাসা।
আবার থরথর করে কেঁপে উঠেছে মারিস। তার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সে এলোমেলো অবস্থায় বলল, তোমাকে কিছু উপহার দিতে ইচ্ছে করছে।
আনিতি হেঁয়ালিভরা ঝাঁ চকচকে হাসি দিয়ে বলল, আমার ইচ্ছে আজকের দিনটি এখানে স্মরণীয় করে রাখতে।
কীভাবে?
যেখানে আমি প্রথম নেমেছি, ঠিক সেখানে একটি সামারু গাছের চারা লাগাতে চাই। যে পবিত্র গাছ এ জগতকে আবার আগের পরিবেশ ফিরিয়ে দিয়েছে।
থমকে গেছে মারিস। সে কিছুক্ষণ ভাবল। বলল, আগে খেয়ে নাও।
আনিতি আদুরে গলায় বলল, সামারু গাছ লাগানো হবে আমার প্রথম কাজ। তারপর খাওয়া। আশা করি তুমি আমার এই ভালোবাসাকে অবজ্ঞা করবে না!
মারিস বলল, আমাকে একটু সময় দাও, আমি আসছি।
মারিস চলে গেছে। আনিতি ক্যাপের ভেতর চিপস বসিয়ে দাঁতে আটকে দিলো। ডিভাইস রাখল খাবারের পাশে।
মারিস ফিরে এসেছে। তার হাতে লকলকে সুন্দর সামারু গাছের চারা। এই গাছের ছবি কিছুক্ষণ আগে আনিতি ইন্টারনেটে দেখেছে। পূর্ণ গাছ, গাছের চারা, ফুল, ফল, পরিচর্যা যাবতীয় বিষয়। মারিস আশপাশে অনেকখানি মাটিসহ গাছের চারা যতœ করে তুলে এনেছে।
খাঁচা খুলে দিয়েছে মারিস। আনিতির হাতে সামারু গাছের চারা। সে শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
মারিস বলল, এসো।
আনিতি খাঁচা থেকে বেরিয়ে এলো। মারিস তার হাতে সামারু গাছের চারা তুলে দিলো।
মারিস আগে আগে যাচ্ছে। তার পেছন পেছন যাচ্ছে আনিতি। বাগানের ভেতর সে সামারু গাছ দেখতে পেল। ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ বড়ো গাছ। গাছের পাতা অনেকটা আপেল গাছের পাতার মতো। তবে রোমশ।
বাগান পেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে মারিস বলল, ওই যে ওখানে তুমি নেমেছিলে। তাড়াতাড়ি করবে। ঝড় আসছে মনে হচ্ছে।
মাটি খোড়ার জন্য মারিস ছোট্ট একটা যন্ত্র নিয়ে এসেছে।
আনিতা দেখল তার স্পেসশিপ সেখানেই রাখা আছে। এখানকার কেউ স্পেসশিপের কোনো ক্ষতি করেনি। হয়তো এত তাড়াতাড়ি কিছু করার কথা তারা ভাবেনি। অথবা পুরো ব্যাপারটা অবহেলা করে গেছে।
আনিতির সঙ্গে মারিস স্পেসশিপের কাছে এসেছে। আনিতি ডানে তাকিয়ে দেখল টর্নেডোর মতো ইলেকট্রন স্পিন এগিয়ে আসছে। প্যারালাল ওয়ার্ল্ডেসের সংযোগ সেতু। কদম মেপে সে নির্ধারণ করতে পেরেছে স্পিন ঠিক কতক্ষণ পর কোন দিক দিয়ে যাবে। শুধু জানে না প্যারালাল ওয়ার্ল্ডসের এই সংযোগ পথ তাকে এখান থেকে কোন জগতে নিয়ে যাবে।
ভাবলেশহীন গতিতে ঠান্ডামাথায় আনিতি সামারু গাছের চারা হাতে স্পেসশিপে ঢুকে পড়ল। ইঞ্জিন চালু করে স্পেসশিপের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। উইন্ডশীল্ড দিয়ে তাকিয়ে দেখল মারিস অস্বাভাবিক স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে আছে। স্পেসশিপ ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। মারিস দৌড় শুরু করেছে। আনিতি শ্রদ্ধাভরা চোখে মারিসের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। যা করেছি তা পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করার জন্য করেছি।
প্রবল বাতাসের ঝাপটায় মারিস এগুতে পারল না। টনের্ডোর মতো দেখতে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডসে যাওয়ার সুড়ঙ্গ পথ স্পেসশিপসহ আনিতিকে তুলে নিল।
৫.
বিজ্ঞান একাডেমির হলরুম। বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্ট নাওরিয়া সাভানা উপস্থিত আছেন। আজকের বিশেষ অনুষ্ঠানে এসেছেন পৃথিবীর বড়ো বড়ো নেতা, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পী ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। এই অনুষ্ঠান পৃথিবীর সবকয়টি নিউজপোর্টাল ভিডিয়ো চ্যানেলে একযোগে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে। আজ সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। পৃথিবীর কয়েক শত কোটি মানুষ আগ্রহ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে অনুষ্ঠান দেখছে। আনিতি জানাবে তার প্যারালাল ওয়ার্ল্ড থেকে ঘুরে আসার কথা।
গতকাল সন্ধ্যায় তুষারাবৃত পাহাড়ের একপাশে বরফজমা সমুদ্রের পাড়ে নিরাপত্তা কর্মীরা স্পেসশিপটি দেখতে পায়। তারা দ্রুত আঞ্চলিক বিজ্ঞান একাডেমিকে খবর দিয়েছে। আঞ্চলিক বিজ্ঞান একাডেমি যোগাযোগ করেছে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান একাডেমির সঙ্গে। তারা নিশ্চিত হয়েছে এটা আনিতিকে বহন করা স্পেসশিপ।
স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আনিতিকে নেওয়া হয়েছিল স্থানীয় হাসপাতালে। ডাক্তার জানিয়েছেন আনিতি শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন। তাকে বিশেষ ব্যবস্থায় রাতে হোয়াইঝি শহরে আনা হয়েছে। বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্ট রাতেই এই বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন এবং প্রেসকে বিষয়টি জানিয়েছেন।
ডায়াসের ওপর চওড়া পোডিয়ামের সামনে আনিতি দাঁড়িয়ে আছে। ছোটো টেবিলের মতো পোডিয়ামে রাখা গাছের চারা।
সকলকে অভিবাদন জানিয়ে আনিতি বলল, পৃথিবী থেকে প্যারালাল ওয়ার্ল্ডে যাওয়া এবং ফিরে আসা লম্বা কাহিনি। আজ আমি সে কাহিনি বলব না। আশা করছি খুব শিগগির আপনাদের সেখানকার ঘটনা জানাতে পারব।
হলরুমে উপস্থিত সকলে স্থির চোখে আনিতির দিকে তাকিয়ে আছেন। কেউ কোনো কথা বলছেন না। আনিতি কী বলে তারা শুনতে এসেছেন।
আনিতি বলল, শুধু এটুকু বলি, পৃথিবীর সমান্তরাল যে জগৎ থেকে আমি ঘুরে এলাম, এটুকু বলা যায়, সে জগৎ প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে গেলেও মানুষের বসবাসের উপযোগী নয়। তারা বিশৃঙ্খল জীবনযাপন করে। তাদের জীবন জীবজন্তু ও ইতর প্রাণীদের চেয়েও এলোমেলো ও জঘন্য। গামা রশ্মিকে কাজে লাগিয়ে তারা শারীরিক গঠনের পবির্তনকে সম্ভব করে তুলেছে। এজন্য তার পরমাণুর কেন্দ্র আর ইলেকট্রনের মাঝখানের ফাঁকা জায়গা সংকুচিত করে ফেলার প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে। যা তাদের জীবনে এক বীভৎস অবস্থার জন্ম দিয়েছে।
আনিতি চুপ করে আছে। সে মূল কথা কীভাবে শুরু করবে ভাবছে। তার হালকা নার্ভাস বোধ হচ্ছে। সহসা কেন জানি মনে হলো মারিস এখন তার পাশে থাকলে খুব ভালো হতো। মারিসকে বললে সে কি আসত পৃথিবীতে! মারিসের চিন্তা মাথায় বসতে দিলো না।
স্থির গলায় আনিতি বলল, সে কথা থাক, আজ শুধু আমি এ পৃথিবী থেকে মানুষের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কীভাবে রক্ষা করা যেতে পারে তাই জানাব। সমান্তরাল যে জগতে গিয়ে পৌঁছেছিলাম, বহুবছর আগে সেই জগতও পৃথিবীর মতো হিমশীতল হয়ে বরফে ঢেকে গিয়েছিল। এখন তারা বসবাস করছে স্বাভাবিক পরিবেশে।
সামারু গাছের চারা হাতে তুলে ধরেছে আনিতি। ক্যামেরার অজস্র ফ্ল্যাস লাইটে যেন চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ছবি তুলতে ফ্ল্যাস লাইট ব্যবহার করতে হয় না। কাছেও আসতে হয় না। বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্টের ইচ্ছে হয়েছে আজকের ছবি ফ্ল্যাসলাইটসহ সব রকমের টেকনোলজিতে তুলতে হবে।
আনিতি বলল, এই গাছ পৃথিবীর প্যারালাল ওয়ার্ল্ড থেকে নিয়ে এসেছি। তারা এ গাছকে বলে সামারু। এই গাছ লাগিয়ে তারা শীতল তুষারে ঢাকা জগৎ থেকে স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে এসেছে। আমরাও পৃথিবীতে এই গাছ লাগাব। পাঁচটা গাছের সঙ্গে একটা সামারু গাছ লাগাতে হবে। এখানে কমবেশি হওয়ার সুযোগ নেই। আর সেই পাঁচটা গাছ হতে হবে ফলজবৃক্ষ বা বড়ো গাছ, যার শেকড় অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। যে সমস্ত গাছ মাটির উপাদান নষ্ট করে ফেলে বা মাটির ভেতর অল্পকিছু চিকন দুর্বল শেকড় তৈরি করে সে সমস্ত গাছের সঙ্গে সামারু গাছ লাগিয়ে কোনো উপকার পাওয়া যাবে না। কারণ পাশাপাশি পাঁচটি গাছের শেকড় মাটির নিচে সামারু গাছের শেকড়ের সাথে সংযুক্ত হয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করবে। সেটাই প্রয়োজনীয়। সহজাতভাবেই পাশাপাশি গাছ সবসময় তাদের শেকড়ের মাধ্যমে পরস্পর সংযোগ স্থাপন করে থাকে। খাদ্যের অভাবে কোনো গাছ দুর্বল হয়ে পড়লে পাশের গাছ শেকড়ের সাহায্যে তার কাছে খাবার পাঠায়।
কিছুক্ষণ দম নিয়ে আনিতি বলল, সামারু গাছের ফুল গন্ধহীন। কাঁচা ফল গাঢ় সবুজ এবং বিষাক্ত। ফল পাকলে টকটকে লাল হয়। তবে পাখি বা পশু এই গাছের ফল খায় না। পাখির মাধ্যমে সামারু গাছের বংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। বীজ থেকে চারা উৎপাদন করে পুরো পৃথিবীতে এ গাছ ছড়িয়ে দিতে হবে। অবশ্য বিশেষ পদ্ধতিতে ডাল থেকে চারা বানানো যেতে পারে।
হলরুমে উপস্থিত বিজ্ঞানীদের অনেকগুলো প্রশ্ন আছে। শুধু বিজ্ঞানীদের নয়, সাংবাদিকসহ সকলেই কিছু প্রশ্ন করতে চায়। তাদের বলা হয়েছে আনিতির পুরো আলোচনা শেষে প্রশ্ন করা যাবে। এখন প্রশ্ন লিখে ড্রপবক্সে জমা দিতে হবে।
আনিতি সামনে বসে থাকা সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, হলরুমে যারা উপস্থিত আছেন বা নিউজ পোর্টালে আমার কথা শুনছেন তাদের আনেকের কাছে আমার পরবর্তী শুরুর কথা বেসিক লেভেলের বলে মনে হবে। আমাকে মাফ করবেন। এই গাছ যেহেতু বিশ্বের সব জায়গায় লাগানো হবে তাই এর বৈজ্ঞানিক ব্যাপারটি সকলের বোঝার সুবিধার্থে সরলভাবে ব্যাখ্যা করতে চাই।
হলরুমে উপস্থিত কেউ কিছু বললেন না। বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্ট নাওরিয়া সাভানা মাথা দোলাচ্ছেন। তিনি অনুমতি দিয়েছেন। আনিতি বলল, সহজ কথায়, সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাছ নিজের জন্য খাদ্য উৎপন্ন করে। সালেকসংশ্লেষণে ক্লোরোফিল পানিকে ভেঙে হাইড্রোজেন আর হাইড্রোক্সাইড আয়নে পরিণত করে। এই হাইড্রোক্সাইড আয়ন ইলেকট্রন তৈরি করে। আর এই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার পর গাছ অনেক ধরনের বায়োলজিক্যাল এলিমেন্ট তাদের শেকড়ের মাধ্যমে ছেড়ে দেয়। ওদিকে মাটি থেকে গাছ প্রয়োজনীয় পানি ও খনিজ দ্রব্য সংগ্রহ করে। এ অবস্থায় বিক্রিয়ার মাধ্যমে পানির একটি অনুতে অক্সিজেনের নিঃসঙ্গ দুটো ইলেকট্রন জোড় গঠিত হয়। এর সাথে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, হাইড্রোক্সাইড সবারই ভূমিকা আছে।
ঘটনাটি সকলের জানা। তবু তারা চুপ করে আছেন। আনিতি শেষ পর্যন্ত কী বলতে চায় তারা শুনবেন। আনিতি লম্বা করে বুকের ভেতর বাতাস টেনে নিয়ে বলল, আমরা এটাও জানি যে, ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন-সকলের অ্যান্টি-ম্যাটার আছে। যেমন অ্যান্টি-প্রোটন, অ্যান্টি-নিউট্রন। ইলেকট্রনের যে অ্যান্টি-ম্যাটার সেটা হচ্ছে পজিট্রন। যখন একটি ইলেকট্রন আর একটি পজিট্রন এক বিন্দুতে মিলিত হয় তখন তৈরি হয় শক্তি বা তাপ।
আনিতি চুপ করে আছে। হলরুমে পিনপতন নিস্তব্ধতা। একঘর মানুষের নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। কেউ কেউ মনে হয় নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেছেন। সবাই কেমন যেন দম আটকে বসে আছে।
ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে আনিতি বলল, একই প্রক্রিয়ায় সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজের খাদ্য তৈরি করে সামারু গাছ। তবে এখানে সালোকসংশ্লেষণের পর যখন বায়ো মলিউকিউলগুলো বায়ো এলিমেন্টের ওপর ছড়িয়ে পড়ে তখন পুরো বিক্রিয়ায় শুরু হয় তীব্র আলোড়ন। একে অন্যকে আকর্ষণ করতে থাকে। আর তার মাধ্যমে সামারু গাছের শেকড়ে তৈরি হয় পজিট্রন। পাশাপাশি প্রোটন এবং পজিট্রন মিলে তৈরি হয় অ্যান্টি-হাইড্রোজেন।
হলঘর ভরতি মানুষ আটকে রাখা দম ফস করে ছেড়ে দিয়েছেন। হলরুমের ভেতর সোঁ সোঁ আওয়াজ হচ্ছে। আওয়াজ যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল।
আনিতি বলল, মাটির নিচে অন্যান্য গাছের শেকড়ের সাথে যখন সামারু গাছের শেকড়ের সংযোগ ঘটবে তখন ইলেকট্রন আর পজিট্রনের সংমিশ্রনে তৈরি হবে উত্তাপ। সেই উত্তাপ পৃথিবীর বরফ গলাতে সাহায্য করবে। তবে গাছ যেমন লাগাতে হবে খুব চিন্তাভাবনা করে, তেমনি বরফ গলা পানি চলাচলের ব্যবস্থাও প্রস্তুত রাখতে হবে। ভাবতে হবে পৃথিবী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে সামারু গাছের কী হবে? কত বছর ধরে পৃথিবীর উষ্ণতা ফিরিয়ে আনা হবে। কারণ জীবজন্তুকে আবার জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে তাদের পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে হবে।
বিজ্ঞান একাডেমির প্রেসিডেন্ট নাওরিয়া সাভানা উঠে এসেছেন ডায়াসে। হলরুম ভরতি মানুষ দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারা আনিতিকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট সাভানা বললেন, সকল কিছু বিবেচনায় নিয়ে এই গাছ যত দ্রুত সম্ভব পুরো পৃথিবীতে বিতরণের ব্যবস্থা করা হবে।
সকলে আনন্দে একসাথে তালি দিচ্ছে। এতক্ষণ তারা যেন বদ্ধ অবস্থায় ছিল। এখন মুক্তি পেয়েছে। হলঘরের ভেতর তালির আওয়াজ কয়েকগুন বেড়ে গেছে।
প্রেসিডেন্ট সাভানা হাত তুলে সবাইকে থামালেন। ভরাট গলায় বললেন, বিজ্ঞান একাডেমির সিদ্ধান্ত মতে, আনিতির নামের সাথে মিল রেখে এই গাছের নাম রাখা হলো, অনিন্দিতা।
৬.
মিস ম্যাগনোলিয়া লিলিফ্লোরা এক দৃষ্টিতে ভিডিয়ো নিউজ পোর্টালের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখ উপচে পানি পড়ে তার দুই গাল ভেসে যাচ্ছে। তিনি নিউজ পোর্টালে আনিতিকে দেখার পর থেকেই কাঁদছেন। অনেক প্রাচীন দর্শনের কথা মনে পড়ছে। এই দর্শনকে বলা হতো আইডিয়ালিজম।
কোনো বনের ভেতর একটা গাছ ভেঙে পড়ে গেলে, সেখানে ওটা দেখার মতো যদি কেউ না থাকে, তাহলে গাছটা আদতে পড়ে যায়নি। দেখার আগে কোনোভাবে জানাও যাবে না যে গাছটা পড়ে গেছে নাকি পড়েনি। তার মানে একই সঙ্গে গাছটি ৫০ ভাগ মৃত অর্থাৎ পড়ে গেছে এবং ৫০ ভাগ জীবিত অর্থাৎ পড়ে যায়নি। ছায়া দেখা যায় না বলে সে নেই তা সত্য নয়। আলোর পরিপ্রেক্ষিতে ছায়া বর্তমান। সে সর্বদা কায়ার সাথে থাকে।
আনিতি সমান্তরাল জগত থেকে ফিরে এসেছে এবং সে পৃথিবী আর পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় মানুষকে বাঁচিয়েছে এটাই সত্য।
পৃথিবীতে উল্লাস শুরু হয়েছে। পৃথিবীর মানুষ মুখে অর্ধেক আনিতি আর অর্ধেক অনিন্দিতা গাছের ছবি আঁকানো মুখোশ পরে উৎসবে মেতেছে।