এক মহামানবের অভ্যুদয়
কে জানত, যে পাকিস্তানি অত্যাচারী গোষ্ঠীর মরণের দূত জন্মাবে বাংলাদেশেরই গোপালগঞ্জ জেলায়? আহা! কি সুন্দর! কি সুন্দর তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, প্রতিবাদী মনোভাব, বদান্যতাপূর্ণ দেহপিঞ্জর। যেন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় বাঙালি জাতিকে রূপান্তরিত করল বীরের জাতিতে।
ইরা বিস্ময় ভরা চোখে আপাদমস্তক ঘুরে ঘুরে দেখছে গাছটা। অজস্র ডালপালা নিয়ে ৪৫ ডিগ্রি কোণে বাঘিয়ার খালের উপর ঝুঁকে আছে নিবিড় মমতায়।
“দাদু এটাই কি সেই গাছটা?” দাদুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল ইরা।
“হ্যাঁ, এটাই সেই হিজলগাছ। এর শাখায় উঠে বঙ্গবন্ধু ঝাঁপিয়ে পড়তেন বাঘিয়ার খালের পানিতে। এর গায়ে লেগে আছে সেই মহামানবের স্পর্শ।”
ইরা গাছটা ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করল, মুহূর্তে সে চলে গেল কয়েক যুগ অতীতে। দাদুর মুখে শোনা খোকার (বঙ্গবন্ধুর) জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত তার স্বচ্ছ মানসপটে ছবির মতো সজীব হয়ে উঠতে লাগল।
খোকা গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। বেলা পড়ে আসছে। মা রোজকার মতো খাকার প্রিয় বালিকা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। তার প্রতীক্ষায়। খোকা কখন ফিরবে। বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটা দুই মাইল দূরত্বের স্কুল। কিছুক্ষণ পরই মার চোখে পড়ল খোকা দীর পায়ে বাড়ির দিকে হেঁটে আসছে।
খোকা কাছে আসতেই মা কিছুটা হচকেগেলেন। তাঁর পাঞ্জাবি-পাজামা নেই। শুধুমাত্র চাদরটা শরীরে জড়িয়ে আছে।
খোকা বলল, “পথে একটা ছেলেকে দেখলাম তার জামা ছিঁড়ে গেছে। তাই আমার কাপড় তাকে দিয়ে এসেছে।”
এটাই প্রথম নয়, ইতিপূর্বে সে কাউকে নিজের ছাতাটা দিয়েও ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরেছে।
মা খোকাকে পরম স্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এত ছোট বয়স প্রশস্ত হৃদয়ের খোকাকে তিনি মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করলেন।
১৯৩৫ সালের গোড়ার দিকে খোকা বেরিবেরিতে আক্রান্ত হলো এবং এর থেকে পরবর্তীতে চোখে ‘গ্লোফুমা’ নামক এক জটিল রোগ ধরা পড়ে। বাবা লুৎফর রহমান ছেলেকে কলিকাতার চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. টি আহমেদ-এর মাধ্যমে সার্জারি করালেন। খোকা সুস্থ হলো। কিন্তু মাঝখানে মরা গাছের শুকনো পাতার মতো ঝড়ে গেল শিক্ষাজীবনের মূল্যবান ৪টি বছর। ততদিনে তাঁর সহপাঠীরা অনেকটা এগিয়ে গেছে। তাই তাকে ভর্তি করানো হলো গোপালগঞ্জ মথুরানাথ মিশন স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে। এ সময় তার জন্য একজন গৃহশিক্ষক রাখা হয়। তার নাম জাকি আবদুল হামিদ। তিনি ছলেন একজন দক্ষ সংগঠক। তিনি ‘মুসলিম সেবা সমিতি নামে একটি সংগঠন পরিচালনা করতেন।
তার কাছেই শুরু হয় মুজিবের প্রথম রাজনীতি পাঠ। সে সময় তার মধ্যে (বঙ্গবন্ধুর) নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে।
সময়টা ১৯৩৮ সাল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার স্কুল পরিদর্শনে আসছেন শুনে কিশোর মুজিব কয়েকজনের সমন্বয়ে একটি সংগঠিত দল নিয়ে তার পথ রোধ করে এবং হোস্টেলের ছাদ সংস্কারের জন্য ১২০০ টাকার অনুদান নিশ্চিত করে। এরপর থেকেই ক্রমে মুজিব সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক প্রিয়পাত্রে পরিণত হতে শুরু করে। শুরু হয় মুজিবের গভীরভাবে রাজনীতিতে পথ চলা।
এর মধ্যে ১৮ বছর বয়সে তিনি পরিণয় সূত্রে বিয়ে করলেন ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে। বেগম ফজিলাতুন্নেসার সংস্পর্শে তিনি রাজনৈতিক পরশ পাথরে পরিণত হন। ১৯৪৩ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হলেন। কলকাতায় তিনি ইসলামিয়া কলেজ হতে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে তিনি ‘কৃষি ও বন’ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ১৯৬৬ সালে তিনি লাহোরে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি পাকিস্তানি সেনা সদস্য কর্তৃক গ্রেপ্তার হন এবং প্রায় ২ বছর পর তিনিসহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে এই মামলা প্রত্যাহার করা হয়। একই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাাধি দেওয়া হয়।
এরপর ৭০ এর নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে। কিন্তু কচক্রী পাস্তিান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে গরিমসি করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর বোঝা হয়ে গেছে যে পাকিস্তানি হায়েনারা বাঙালিদের স্বাধীনভাবে বাঁচতে দেবে না। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। যে ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বলা প্রতিটি কথা বাঙালিদের মনে গেঁথে যায়। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের ইশারা দেন। পরবর্তীতে ইতিহাসে যুক্ত হয় ২৫ মার্চ কালরাত্রির অধ্যায় এবং বঙ্গবন্ধু ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ডাক দেন। এরপর ৯ মাসব্যাপী তুমুল লড়াইয়ের পর জন্ম নেয় বঙ্গবন্ধুর, কোটি বাঙালির স্বপ্নের বাংলাদেশ। এই পুরো সময় তিনি পাকিস্তানের বারাগারে অন্তরীন থাকেন। অতপর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি যুক্ত হয়ে তিনি ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে, মাত্র ৪ বছরের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ যখন বিশ্বের মানচিত্রে একটি রূপরেখা তৈরি করতে যাচ্ছে তখন ইতিহাসেযোগ হয় একটি কলঙ্ক গাঁথা অধ্যায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কিছু পথভ্রষ্ট সেনা সদস্যের হাতে বাংলাদেশের রূপকার বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেন। একই সাথে মৃত্যু হয় একরাশ স্বপ্ন ও একটি উন্নত চেতনার।
ইরা হিজল গাছ ছুঁয়ে থরথর করে কাঁপছে। তার দুচোখ বেয়ে টপটপ করে ঝড়ে পড়ছে স্বচ্ছ সাদা জল। দাদু পিছন থেকে তার কাধে হাত রাখলেন। আলতো স্বরে ডাকলেন, ‘ইরা... ইরা...।’
ইরা টলটলে জলভরা চোখে পিছন ফিরে তাকালো। তার স্ফটিকের মতো মসৃণ চোখে চিকচিক করছে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশের আগামী স্বপ্ন।
ঠিকানা: পূর্ব মনিপুর, যভহভ নসমযা- ৯২২/১
মিরপুর-২, ঢাকা।