সারা জেরিন তাসপিয়া
ভালো ফিচার লেখার কৌশল ও প্রাসঙ্গিক কথা
সাধারণত ফিচার নিয়ে তেমন ভালোমানের বই পাওয়া যায় না। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক জাহীদ রেজা নূরের সম্প্রতি প্রকাশিত গণমাধ্যম বিষয়ের বই ‘ভালো ফিচার লিখতে হলে’ পড়তে পড়তে পাল্টে গেছে অনেক ধারণা। বইটি হাতে নিয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম, এখানে হয়তো পাঠ্যপুস্তকের মতো একনাগাড়ে ফিচার লেখার কিছু নিয়ম বাতলে দেয়া হবে। কিন্ত বইটি আসলে পাঠ্যপুস্তকের মতো নয়।
দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংবাদিকতা করছেন জাহীদ রেজা নূর। বইটিতে রয়েছে তাঁর ২৩ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস। এই ২৩ বছরের সিংহভাগ সময়ই পত্রিকার ফিচার বিভাগে তিনি কাজ করেছেন। লেখক উল্লেখ করেছেন, এ বইয়ের লেখাগুলোর বেশিরভাগই তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল। এছাড়াও বইটিতে বিভিন্ন সময়ে তাঁর লেখা ফিচারের সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে।
আলোচনার শুরুতে আমার ছোট্ট একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। ফিচার বিষয়ক আমার তেমন কোন ধারণা নেই। কখনও কোথাও যদি ফিচার বিষিয়ক দু’একটি কথা বলতে বলা হয়, তখন সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পথ খোঁজাই হবে প্রধান কাজ। বইটি পড়ার পরে আমার সেই ধারণা এবং ভয় ক্রমশই দূর হয়ে ফিচার সম্পর্কে নিজের একটি চিন্তা-ভাবনার জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। সেই পালিয়ে যাওয়ার পথটি এখন আর খুঁজতে হবে বলে মনে করছি না।
লেখক শুরুতেই যে পরামর্শ টি দিয়েছেন তা হলো যে, নিয়ম করে লিখতে বসতে হবে। লিখতে হলে পড়তে হবে কিংবা জানতেও হবে খুব। নতুন লেখক যারা সংবাদপত্রে, বেতারে, টেলভিশনে কিংবা অন্যান্য গণমাধ্যমে কাজ করতে চান, তাদের জন্য অবশ্যই সহায়ক হবে বইটি।
এবার বইয়ের মূল বিষয়ের আলোচনায় আসা যাক। ফিচারের শুরুতেই যদি পাঠকের মন কেড়ে না নেয়, তবে তা সফল ফিচারের রূপ পাবে না। লেখক ফিচারকে ছোট গল্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং সেই ছোট গল্পটি এমন দক্ষতার সঙ্গে লিখতে হবে যাতে কোন ধরনের কল্পনার অবকাশ না থাকে। লেখক এর জন্য প্রথমে ফিচারের কাঠামোর গুরুত্বের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সংবাদ বা ফিচারের কাঠামোকে ধরা হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে। সংবাদপত্রের প্রথম যুগে সংবাদ কিংবা ফিচার কীভাবে লেখা হবে সে বিষয়ে কারোরই তেমন মাথা ব্যাথা ছিল না। কিন্ত তথ্য-প্রযুক্তির যুগে অসংখ্য পত্রিকার জন্ম হয়েছে এবং হচ্ছে। যার ফলে পত্রিকাগুলোর মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে একধরনের প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে অবশ্যই সংবাদ কাঠামোটি হতে হবে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সংবাদ রচনা পদ্ধতিটি হতে হবে সহজ। সংবাদ কাঠামোর সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি উল্টো পিরামিড নিয়ে লেখক খুব সুন্দর ভাবে আলোচনা করেছেন। উল্টো পিরামিড পদ্ধতির মূল বিষয় হলো, যা সবচেয়ে জরুরি সে কথা বলে দেয়া হবে শুরুতেই। এরপর ধীরে ধীরে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উঠে আসবে। এর ফলে শুরুটা পড়েই পাঠক আগ্রহ পাবে। অযথা ঘটনা না টেনে সংক্ষেপে সুন্দর করে পুরো বিষয়টিকে উপস্থাপন করা।
সাক্ষাৎকার ও বিড়ম্বনা অধ্যায় টিকে লেখক বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের কিছু অন্যায় প্রবণতার বিষয় উল্লেখ করেছেন। যেমন,শিল্পীর সঙ্গে কথা না বলেই তার সাক্ষাৎকার ছেপে দেয়া কিংবা শিল্পীর সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ছাড়াই তার সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়া। আবার কখনো দেখা যায় কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থেকেও নিজের মনের মতো করে সংবাদ লিখে পাঠানো। এ বিষয়গুলো পরিহারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একটি ভালো রিপোর্ট করার জন্য সাংবাদিকদের সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো, সংবাদের সঙ্গে নিজের দূরত্ব না রাখা। অর্থাৎ লেখক বুঝাতে চেয়েছেন যে, যে বিষয়ে রিপোর্ট লেখা হচ্ছে সে ব্যাপারে পুরোপুরি জেনেবুঝে তারপরই কাজে ঝাঁপ দেয়া। বিভিন্ন গল্প, ঘটনার মধ্যে দিয়ে লেখক ফিচার ও সংবাদ কাঠামো সম্পর্কে পাঠককে পুরোপুরি একটা ধারনা দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
যারা সত্যি সত্যই ফিচার লেখার কলাকৌশল শিখতে চান কিংবা ফিচার লিখতে চান, তাদের জন্য বইটি হবে সত্যিই শিক্ষণীয়। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, বইটির শেষে লেখক শুধু ফিচার নয়,যেকোন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করার জন্য কিছু পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি লেখালেখি নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন বিখ্যাত লেখকদের ভাবনা আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা এ বইটি পড়ে সত্যিই আনন্দ পাবেন। শুধু ফিচার নয়,আপনার যে কোন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করার পথটাকে আরও সুন্দর ও মসৃণ করবে এ বইটি।
ভালো ফিচার লিখতে হলে
লেখক: জাহীদ রেজা নূর
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ
দাম: ৩০০ টাকা