ওয়াসীম পলাশ
শুকনো গোলাপের গন্ধ
শব্দ ও স্মৃতিরাও মনে হয় আস্তে আস্তে জীর্ণ হয়ে যায়। যেমন সুগন্ধি গোলাপ জীর্ণ হলে গন্ধটাও কেমন জানি জীর্ণ হয়ে যায়। ‘জীর্ণ গন্ধ’ বিষয়টা প্রফেসর রহমানের কাছে অনেকটা বেমানান লাগে। মহানবির নাকি সুগন্ধির প্রতি প্রবল ভালো লাগা ছিল, সে বিবেচনায় প্রফেসর রহমানের গোলাপ ও সুগন্ধির প্রতি এক গভীর অনুরাগ রয়েছে; কিন্তু এক শুকনো গোলাপ ও তার জীর্ণ গন্ধ তিনি গত পাঁচ দশক যে বয়ে বেড়াচ্ছেন তা ইদানীং তাকে আক্রান্ত করছে। এক দীর্ঘ জ্ঞানতাত্ত্বিক যাত্রায় প্রফেসর রহমানের বহুবিধ চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। এর বেশির ভাগই ছিল সংখ্যা। সংখ্যার প্রতি তার ভালো লাগা কবে শুরু হয়েছিল তা ঠিক নির্ণয় করতে না পারলেও তার একজন শিক্ষকের কথা খুব মনে পড়ে। দুলাল চন্দ্র স্যার। ছাত্ররা ও এলাকার সবাই তাকে দুলাল স্যার বা দুলালবাবু বলে ডাকতেন। আর্থিক অনটনের কারণে খুব বেশি লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। মুরুব্বিদের কাছে শুনেছিলেন দুলালবাবু উনিশশো চুয়ান্ন সালে বিএসসি পাস করেছিলেন। সে সময়ে একজন বিএসসি পাস সাত গ্রামে দেখা মিলত না। এর পরে নিজের এলাকায় স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। গণিত আর ছাত্রদের প্রতি তার সমান ভালো লাগা ছিল। মনোযোগী ছাত্র হিসেবে প্রফেসর রহমানও দুলাল চন্দ্রের অনেক স্নেহ ও যত্ন পেতেন। ক্লাসের বাইরেও মাঝে মাঝেই গণিতের খবরাখবর বলতেন ও বইপত্র পড়তে দিতেন।
গত চার দশকেরও অধিককাল প্রফেসর রহমানেরও গবেষণা ও অধ্যাপনার মূল বিষয় ছিল পরিসংখ্যান ও গণিত; বিজ্ঞানরে প্রতিও রয়েছে তার অপার আগ্রহ; কিন্তু শিল্প ও সাহিত্যের প্রতি তার এক ধরনের নিস্পৃহতা বরাবরই। এই নিস্পৃহতার কারণ তিনি অনেকবার খোঁজার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু আশানুরূপ কোনো উত্তর মেলেনি। কৈশোরে তার বেড়ে ওঠার সময়ে চারপাশে যে সাংস্কৃতিক ও আদর্শবাদী রাজনীতির চর্চা ছিল তাতে সেসব দিয়ে প্রভাবিত হওয়াটা তার মতো একজন ভালো ছাত্রের জন্য স্বাভাবিক ছিল। এগুলোকে পাশ কাটিয়ে মাঝের সোজা আলপথ বেয়ে তিনি চলে যেতে পারতেন তার স্বপ্নের মহাসড়কে; কিন্তু না যৌবনের শুরুতেই একটা ধর্মীয় বোধ অদৃশ্যভাবে লেপটে গেল তার অস্তিত্বে। তারপর আর বিচ্ছিন্ন হলো না। জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে জুড়ে গেল সত্তার সঙ্গে। এই জুড়ে যাওয়া ধর্ম বিশ্বাস ও চর্চা তার যৌক্তিক বিজ্ঞানচর্চার সাথে কখনো কখনো সাংঘর্ষিক হয়েছে; কিন্তু তিনি দুটোকেই চালিয়ে নিয়েছেন। কোনোটাই বাদ দেননি বা এড়িয়ে যাননি।
প্রফেসর হাবিবুর রহমান টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায়োগিক গণিতের শিক্ষক। শিক্ষকতার চেয়েও গবেষণা তার বেশি ভালো লাগে। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তিন দশকেরও বেশি সময় টরোন্টোতেই বসবাস করছেন। ছেলে অবশ্য আমেরিকার বোস্টনে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছে শিক্ষক হিসেবে বছর কয়েক হলো। মধ্যে কয়েক বছর মধ্যপ্রাচ্যের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেনও প্রায়োগিক পরিসংখ্যানের ওপর উচ্চতর গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রফেসর রহমান। পেট্রোডলারে উপার্জনটা ভালোই করেছেন, যদিও অর্থের প্রতি তার মোহ কোনোকালেই ছিল না। তার স্ত্রীও অনেকটা তার চেতনারই। দাম্পত্য জীবনের শুরুতে স্ত্রী একটু উচ্চাভিলাষী ছিলেন। নিজের শিক্ষা ও পারিবারিক মর্যাদা নিয়ে তার একটা গর্বও ছিল; কিন্তু আস্তে আস্তে স্বামীর জীবন ও চিন্তার সঙ্গে মানিয়ে নেয়াটাই তার মুখ্য কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ধর্মচর্চা করেন, স্বামীর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকেন ও তার কাজে সহায়তা করেন।
উত্তর আমেরিকার এই জীবন বোধের সঙ্গে প্রফেসর রহমান কখনোই নিজেকে একাত্ম করতে পারেননি। খুব যে একটা চেষ্টা করেছেন তাও নয়। তিনি বরং মনোযোগী ছিলেন তার গবেষণা ও ক্যারিয়ার নিয়ে। এর ফলও তিনি পেয়েছেন। আজ তিনি তার ক্ষেত্রে একজন বিশ্বমানের গবেষক। ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে তার প্রচুর আর্টিকেল বের হয় এবং সেগুলোর সাইটেসনও অনেক। এসব বিবেচনায় তার ক্যারিয়ার অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়।
মধ্যপ্রাচ্যের সময়টা তার ভালোই কেটেছে। দুই কিস্তিতে তিনি আট বছরের মতো সেখানে ছিলেন। জ্ঞানচর্চার জন্য পরিবেশটা খুব অনুকূল না হলেও তার ধর্মচর্চার জন্য সুবিধাই হতো; কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের জীবনের অন্তঃজগতের এক স্থল বৈপরীত্য তার চোখে ধরা পড়ে। ফলে তার সেখানে থাকার আগ্রহটা চলে যায়। প্রফেসর রহমান একটি বিষয় বোঝবার চেষ্টা করেছেন দীর্ঘদিন থেকে যে তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের বড় অংশটা যে পরিবেশে ও সংস্কৃতিতে কাটল তার বাইরে তিনি প্রবাসে এর দীর্ঘসময় কীভাবে পার করলেন? মানুষের টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম লাগে; কিন্তু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য লাগে দীর্ঘ প্রস্তুতি ও জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা; কিন্তু জীবন সম্পর্কে গভীর বোধ তৈরি হওয়ার পর তা পরখ করে দেখার খুব বেশি সময় মেলে না। আজকাল এরকম কিছু ভাবনা প্রায়ই ভর করে তার মাথায়। মনে হয় খুব বেশি সময় আর হাতে নেই তার।
ইদানীং নিজের গ্রাম ও নদীটার কথা খুব মনে পড়ে। বছর তিনেক আগে একবার দেশে গিয়েছিলেন। ঢাকায় ভাগনির বিয়েতে অংশগ্রহণটা ছিল মূল উদ্দেশ্য। এছাড়াও দুই সপ্তাহের ভ্রমণে বেশ কিছু কাজ সেরেছিলেন। ঢাকায় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটো বক্তৃতা দিয়েছিলেন। দীর্ঘদিন পর দেশের তরুণ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে, তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। একটা বিষয় তার কাছে স্পষ্ট হয়েছিল এখানকার ছেলেমেয়েদের অ্যাভারেজ কোয়ালিটিটা বেশ নিচে নেমে গেছে। কিছু ছেলেমেয়ে ব্যতিক্রম। তারা বেশ ভালোই করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তার ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একটা পুনর্মিলনীতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেবার স্ত্রীও সঙ্গে ছিলেন। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নিজের গ্রামে ৩ দিন বেড়িয়ে এসেছেন। চাচাতো ভাইয়েরা সেখানে আছেন। গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল বর্তমান প্রধান শিক্ষক তার দেশে আসার কথা শুনে আরও কিছু প্রাক্তন কৃতী ছাত্রছাত্রীদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বর্তমান মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রধানের আয়োজন করেছিলেন। দীর্ঘদিন পর বহু পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হলো। নারায়ণের সাথেও দেখা হলো তার প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পর। নারায়ণ সরকারি কলেজের শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন বছর চারেক আগে। এখন রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে থাকে।
সেবার নারায়ণের কাছেই শুনেছিল অলকানন্দা দি’র কথা। তিনি এখন জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস। কেমব্রিজ থেকে পিএইচডি করে ফিরে এসে ওখানে যোগদান করেন। দীর্ঘদিন ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই আছেন। দিল্লিতে থাকেন। তার বড়দা আমাদের এলাকার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র পার্থদা এখন পৃথিবীখ্যাত অর্থনীতিবিদ। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। রায় পরিবার প্রফেসর রহমানের অঞ্চলের সবচেয়ে বনেদি পরিবার। কয়েক প্রজন্ম ধরে তারা বিত্তে, জ্ঞানে ও সংস্কৃতিতে অনেক অগ্রসর। রায় পরিবারের বেশির ভাগ মানুষই গ্রাম ও দেশ ছেড়েছিলেন সাতচল্লিশে। শুধু ছোট রায়বাবু রয়ে গিয়েছিলেন এ মাটি, জল, বাতাসের টানে। শেষ পর্যন্ত তিনিও টিকতে পারেননি। একাত্তরে এসে শেষ মানসিক শক্তিটুকুও হারিয়ে দগদগে, বিভৎস স্মৃতি নিয়ে এ মাটি ছাড়লেন শুধু প্রাণটা নিয়ে। সঙ্গে নিয়ে গেলেন স্ত্রী ও দুই মেয়েকেও। ছেলে আগেই কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন উচ্চ শিক্ষার জন্য। সেখান থেকে আরও উচ্চতায় পৌঁছার জন্য পাড়ি জমিয়েছিল আরও পশ্চিমে। এখনও পশ্চিমেই আছেন।
প্রফেসর রহমানের খুব বেশি বিষয়ে উৎসাহ নেই। চারপাশের মানুষগুলোর উন্নতিতে তিনি খুশি হন; কিন্তু বিস্তারিত শোনার আগ্রহ তার বরাবরই কম। তার আগ্রহ ধর্ম আর গবেষণায়; কিন্তু অলকানন্দা দি’র কথা শুনতেই তার ভেতরে যেন একটা মৃদু ঢেউ খেলে গেল। ফিরে গেলেন কৈশোরে। সবে বয়স বারো-তেরো হবে। তাদের আশপাশের কয়েক গ্রামে যেমন ছোট রায়বাবুর সুনাম তেমনি তার বড়মেয়ের। রূপে-গুণে মেধায় ও আচার-ব্যবহারে এমন সুসমন্বয় কালেভদ্রে মেলে। তাকে নিয়ে তাদের পুরো অঞ্চলটাই গর্ববোধ করত। এমন এক সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ তরুণীর কথা শুনলে যে কোনো কিশোর যুবকের ভেতরটা কেমন যেন নড়েচড়ে ওঠে। এরকমের নড়াচড়া রহমান সেই কৈশোরে টের পেয়েছিলেন। এ কম্পন বেশ অনেক দিন বহমান ছিল। একদিন কী যেন এক কাজে এক শিক্ষকের সঙ্গে তাদের বাড়ি গিয়েছিলেন। সেদিন অলকানন্দা দি’র ঘরবাড়ি ও পরিবেশ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। এমন অজপাড়াগাঁয় মানুষের এত গোছানো ও সুন্দর জীবন হতে পারে তা ভেবে ওই কৈশোরেই শিহরিত হয়েছিলেন। ঘর থেকে এনে দুটি পাকা কামরাঙ্গা দিয়েছিলেন অলকানন্দা’দি। কামাঙ্গা যে এত মিষ্টি হতে পারে তা রহমান সাহেবের কিশোর বয়সে ধারণায় ছিল না। তিনি মনে ভেবেছিলেন এত সুন্দরী তরুণীদের হাতের ফল বোধহয় এমন মিষ্টিই হয়।
সেই মিষ্টি কামরাঙ্গা, সুন্দর হাত ও পরিপাটি বিশাল বাড়ি কেমন যেন তার চৈতন্যে এখনও খেলা করছে। তার চৈতন্যের পরের ধাপটি ছিল ভয়ংকর। সেই বিভীষিকা তিনি সেই কৈশোরে ভালোভাবে আঁচ করতে পারেননি; কিন্তু একবার কিছুটা টের পেয়েছিলেন যখন শিকাগোতে পার্থদার সঙ্গে একটা কনফারেন্সে দেখা হয়েছিল। ষাটোর্ধ্ব বয়সী পার্থদার পাশে গিয়ে বসে তার সেই দক্ষিণবঙ্গের জন্মভিটার কথা মনে করিয়ে দিতেই এই পৃথিবীবিখ্যাত অর্থনীতিবিদের চোখে এক ছলছল করা লুকানো অভিমান টের পেয়েছিলেন। সেই ফেলে আসা গ্রাম,বাড়ি, প্রতিবেশী,স্বজন ও ছোট নদীটার প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। তার চেয়ে বেশি আগ্রহ আমার গবেষণা নিয়ে। আমার গবেষণা সম্পর্কে আগ্রহ নিয়ে বিস্তারিত শুনেছিলেন। সেই প্রথম ও সেই শেষবার দেখা তার সঙ্গে।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে দিল্লিতে একটা আন্তর্জাতিক সেমিনারে পেপার উপস্থাপন করতে যাবেন প্রফেসর রহমান। এ নিয়ে কিছুটা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মি. রহমান। প্রায় বাইশ বছর আগে একবার হায়দরাবাদে একটা কনফারেন্সে যোগদান করেছিলেন। সেবার অনেক তরুণ গণিতবিদের সাথে পরিচয় হয়েছিল যারা পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে সুনাম কুড়িয়েছে। দিল্লি তার কখনো যাওয়া হয়নি। হঠাৎ সেদিন বিকেলে তার দিল্লির বিষয়টা মাথায় আসতেই অলকানন্দা দি’র কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল সেই সুশ্রী মুখখানি, ভেতরটা কেমন যেন একটা ধক করে উঠল। বাড়ির প্রশস্ত জানালা দিয়ে বরফ আচ্ছাদিত ম্যাপল লিপগুলোর কুঁকড়ে যাওয়াটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল তার সে প্যাকেটটার কথা। যে প্যাকেট দীর্ঘ পাঁচ দশক যাবৎ প্রফেসর রহমান বয়ে বেড়াচ্ছেন নিভৃতে।
তার স্ত্রীও বিষয়টা অবগত নয়। নিজের ব্যক্তিগত কাগজপত্রের মধ্যে তার ওই প্যাকেটটা আরও একবার দেখে নেয়। প্যাকেটটা খোলে, জীর্ণ গন্ধটা আরও একবার ছড়িয়ে পড়ে। অলকান্দা দি’র গন্ধটা যেন এসে লাগে শরীরে। কয়েক মিনিটে বাসার কলিং বেলে সম্বিৎ ফিরে পায় প্রফেসর রহমান। আবার সেভাবেই গুছিয়ে রাখেন প্যাকেটটি। স্ত্রী বাসায় ফেরার পর স্ত্রীর হাতটা একটু জড়িয়ে ধরেন। স্ত্রী কিছুটা বিস্মিত হন। মনে হয় প্রফেসর রহমান তার মনের স্থিরতা হারিয়েছেন। অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকান, তাকে বোঝার চেষ্টা করেন। প্রফেসর রহমান ওয়াশরুমের দিকে যান। হাতমুখ ধুয়ে গিয়ে জায়নামাজে বসেন কিছুক্ষণ।
ছাব্বিশে নভেম্বর টরোন্টো থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেন প্রফেসর রহমান। এবার সঙ্গে স্ত্রী নেই। দীর্ঘদিন পর স্ত্রীকে ছাড়া এত দীর্ঘ জার্নি করছেন। সবকিছুই স্ত্রী গুছিয়ে দিয়েছেন শুধু ঐ প্যাকেটটা তিনি নিজেই মনে করে নিয়েছেন। কনফারেন্স শুরু হবে আটাশ নভেম্বর। তিন দিন চলবে। প্রফেসর রহমানের প্রেজেন্টেশন দ্বিতীয় দিন অপরাহ্ণে। প্রথম দিনেই জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির দুইজন প্রফেসরের সঙ্গে পরিচয় হয়। লাঞ্চের সময় তাদের সঙ্গে বেশ আলাপও হয়। একজন গণিতের অন্যজন পদার্থ বিজ্ঞানের। একজন প্রবীণ অন্যজন মাঝ বয়সী। একফাঁকে প্রফেসর অলকানন্দা চ্যাটার্জি কথাও হয়। প্রফেসর রহমানরে সেই অলকানন্দা দি এখন অলকানন্দ চ্যাটার্জি বাঙালি অর্থনীতিবিদ অরিন্দম চ্যাটার্জিকে বিয়ে করে চ্যাটার্জি নামটা যোগ করেছেন। মি. চ্যাটার্জি নাকি ইন্ডিয়ান প্লানিং কমিশনে সিনিয়র অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করতেন। গত বছর মারা গেছেন; কিন্তু প্রফেসর অলকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলোতেই থাকেন। তারা প্রফেসর রহমানকে তার ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিয়েই খান্ত হলেন না। বিকেলের কফির বিরতীতে ফোনে কথা বলিয়েও দিলেন তার সঙ্গে।
সময়ের সংক্ষিপ্ততার কারণে ওই সময় বিস্তারিত কথা বলতে পারলেন না। হোটেল রুমে ফিরে এশার নামাজের পরে আবার ফোন করলেন। এবার বেশ কিছু বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলাপ হলো। নিজের ঠিকানাটা বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বললেন পরশু বিকেলে চলে আসুন। আগামীকাল কনফারেন্সের শেষ দিন। পরশু দিন পূর্ণ ফাঁকা। শুধু রাতে একটা ডিনারের নিমন্ত্রণ আছে। কথোপকথন সেরে চুপচাপ ভাবতে ছিলেন আজকের বক্তৃতার বিষয় ও অন্যান্য আলোচকদের মতামত নিয়ে। জীবনে প্রফেসর রহমান বহু দেশে বহু সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন; কিন্তু এবার তার মধ্যে একটি শঙ্কা তৈরি হলো। একটা মৌলিক প্রশ্ন তাকে ভাবিয়ে তুলল। তা হলো জ্ঞানচর্চার ভবিষ্যৎ প্রক্রিয়া। জ্ঞানের সাম্যবাদী চরিত্র কি হারিয়ে যাবে? এটা কি নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে কিছু প্রতিষ্ঠানের? নানান প্রশ্ন জড়ো হতে লাগল প্রফেসর রহমানের মাথায়; কিন্তু তিনি চিন্তা করতে ভালোবাসেন না, কাজ করতে ভালোবাসেন। বহু চিন্তাবিদের চিন্তার প্রকরণ ও পরিধি তাকে অনেকবার অসহায় করে দিয়েছে। এসব বিষয়কে পাশে রেখে মনস্থির করলেন স্ত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলবেন ঘুমোতে যাওয়ার আগে।
বছরের শেষ দিন, ৩১ শে ডিসেম্বর বিকেল চারটার দিকে হোটেল থেকে বেরিয়ে একটি ট্যাক্সি করে রওনা হলেন প্রফেসর অলকানন্দ চ্যাটার্জির বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায়। সঙ্গে নিলেন প্যাকেটটি। পথে একটা ফুলের দোকান থেকে কিছু ফুল কিনে নিলেন। ফুল কিনতে গিয়ে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত সেই নারীর পছন্দের ফুল কী হতে পারে। ঝুঁকি এড়িয়ে কয়েক ধরনের ফুল মিলিয়ে একটি মাঝারি গোছের তোড়া সাজালেন। তার বাসায় পৌঁছতে প্রায় আরও চল্লিশ মিনিটের মতো লাগবে। ট্যাক্সিতে চলতে চলতে বাঁ পাশের জানালা দিয়ে দিল্লির অনেক পুরনো ঐতিহ্য তার চোখে পড়ল। বেশির ভাগই মোগল আমলের। আর মাঝে মাঝেই স্মৃতিতে উঁকি দিচ্ছিল অলকানন্দ দি’র সেই সুশ্রী মুখখানি। এক তেরো বছর বয়সী কিশোরের চোখে সতেরো বছর বয়সী এক তরুণীর মুখ, হাত, চাহনি সেই মিষ্টি কামরাঙ্গা। এরপর পৃথিবীতে এসেছে অনেক যুদ্ধ, মহামারি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সেই অলকানন্দা আজ একজন খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী। কতটা পরিবর্তন তার ভেতরে এসেছে? কীভাবে প্রফেসর রহমানকে তিনি গ্রহণ করবেন? এমন নানান চিন্তা ঘুরপাক খেতে খেতে চল্লিশ মিনিট কেটে গেল। পৌঁছে গেলেন তার বাড়ির সামনে। নেমপ্লেট ও নম্বর দেখে নিশ্চিত হলেন, ট্যাক্সি থেকে নেমে সেই প্যাকেট ও ফুলের তোড়াটি নিয়ে আগালেন দরজার দিকে। প্রফেসর রহমানের মধ্যে কেমন যেন একটা অনুভূতি সৃষ্টি হলো। এটি গ্রাস করল তাকে। মনে হলো তিনি ফিরে গেছেন তার কৈশোরে। সেই কৈশোরে একবার অলকানন্দ দি’কে দেখার যে অনুভ‚তি তা যেন আবার ফিরে এসেছে। এরকমের একটা আবেগ কৈশোরে দীর্ঘদিন ঘিরে রেখেছিল প্রফেসর রহমানকে। এ আবেগটা দ্বারা আক্রান্ত হতে তার বেশ ভালো লাগছে।
দরজার সামনে দাঁড়ায় প্রফেসর রহমান। নিজেকে নিরপেক্ষ বানানোর চেষ্টা করেন। নিজেকে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করেন যে তিনিও একজন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটির অধ্যাপক ও গবেষক; কিন্তু এ মুহূর্তে কৈশোরের সে খোলস থেকে তার বের হবার ইচ্ছে হচ্ছে না। কৈশোর যেন তাকে টেনে ধরছে। দরজার বেলটায় চাপ দেয় ভেতর থেকে এক তরুণী এসে দরজা খোলে। প্রফেসর রহমান জিজ্ঞেস করেন, দিদি আছেন? তরুণী উত্তর দেয় জি আছেন, ভেতরে আসুন। ভেতরে ড্রইংরুমে বসেন প্রফেসর রহমান। ফুলের তোড়া আর প্যাকেটটি রাখেন কাঠের টি-টেবিলটার ওপর। মাঝারি গোছের একটা কক্ষ, সঙ্গে প্রশস্ত বেলকুনিও রয়েছে। বেশ আভিজাত্যে ঠাসা, প্রতিটি কানায় যেন সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের শৈল্পিক সমন্বয়।
মিনিট তিনেক পরে ধীরস্থিরভাবে একটা মিষ্টি গন্ধে ভরিয়ে দিয়ে এসে দাঁড়ায় প্রফেসর অলকানন্দ চ্যাটার্জি। প্রফেসর রহমানের অলকানন্দদি। সত্তুর ছুঁই ছুঁই শুভ্রকেশী; হালকা সোনালি একটা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ ও কপালে লালটিপ। ঘরটা যেন এক অদ্ভুত অলৌকিকতার স্পর্শ পায়। প্রফেসর রহমান দাঁড়ায় তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মুখে কোনো শব্দ নেই। প্রফেসর অলকানন্দ চ্যাটার্জি জিজ্ঞেস করেন কেমন আছো হাবিব? আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? ‘হাবিব’ ডাকটা শুনে আরও বিস্মিত হন এবং উত্তর দেন জি ম্যাডাম আমি ভালো আছি। আর আসতে কোনো সমস্যা হয়নি।
বসো। আমাকে ম্যাডাম ডাকতে হবে না। অলকানন্দদি বা অলোকাদি ডাকলেই হবে। ঘরটায় মুখোমুখি দুজন অধ্যাপক অথবা একজন কিশোর আর একজন তরুণী। কিশোরটি বাংলাদেশের একটা সাদামাটা নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারের সংগ্রামী মনোবৃত্তির মানুষ আর তরুণীটি এই বঙ্গের হাজারো বছরের বাঙালি সনাতন সংস্কৃতির উচ্চবিত্তীয় প্রতিনিধি। আজ তারা মুখোমুখি পঞ্চাশ বছর পর। হাবিব তাকায় তার অলকানন্দাদির দিকে। দীর্ঘ অনেক বছর হাবিব কোনো নারীর দিকে এভাবে তাকায়নি। হাবিব যেন কৈশোরে ফিরে গেছে। তার জ্ঞান, গবেষণা, অধ্যাপনা, গত পাঁচ দশক সব কোথায় যেন হারিয়ে গেছে মুহূতেই।
প্রফেসর অলকানন্দাও তাকিয়ে আছেন হাবিবের দিকে। লম্বা দাড়ি, বেশির ভাগই সাদা। চেহারায় সৌম্যসান্ত একটা ভাব, ধর্মের চর্চা ও ভাব দুটোই তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে ওঠে; কিন্তু প্রফেসর অলকানন্দের কাছে হাবিবের কৈশোরের কোনো স্মৃতি নেই। ওই স্মৃতি শুধু প্রফেসর হাবিব একাই বহন করছেন।
গতকালই নারায়ণের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তোমার কথা বিস্তারিত বলেছে। নারায়ণ মাঝে মাঝে ফোন করে একবার গ্রামে গিয়ে একটা অনুষ্ঠান করার কথা বলে। তারও ইচ্ছে হয় সেই গ্রাম, বসতভিটা, নদী স্কুল আর মানুষগুলোকে একবার দেখে আসতে; কিন্তু কেমন করে যেন হয়ে ওঠেনি। তার পার্থদার কেনো যেন এক ধরনের উদাসীনতা, সে জন্য তিনি আর তার ছোটবোন ও উৎসাহ পাননি। ছোটবোন এখন লন্ডনে থাকেন। জয়া নন্দা। ওখানে অধ্যাপনা করেন। মাঝে মাঝে দাদা আর জয়া দিল্লিতে আসেন।
হাবিব ফুলগুলো তুলে দেয় অলকানন্দাদির হাতে। ধন্যবাদ বলে একবার ফুলগুলোর গন্ধ শুঁকে রেখে দেয় পাশে। পেছনের দেয়ালে একটা ফ্যামিলি ফটো বাঁধানো। ছেলে, মেয়ে ও হাজব্যান্ডের সঙ্গে অলকানন্দাদি। ঘাড়টা বাঁকিয়ে বললেন আমার ছেলে অবিনাশ চ্যাটার্জি। সিলিকন ভ্যালির কম্পিউটার বিজ্ঞানী। লস এঞ্জেলসে থাকে। আর মেয়ে অবন্তী নায়ার। ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিসটারেটিব সার্ভিসে আছে। আর আমার হাজব্যান্ড ইকোনমিস্ট ছিলেন। দাদার বন্ধু একসঙ্গেই অক্সফোর্ডে ছিলেন। গত বছর করোনার শুরুতেই আক্রান্ত হন। ধকলটা সামলাতে পারেননি। অবসর জীবনে ছিলেন গত কয়েক বছর যাবৎ।
প্যাকেটটা তখনও টেবিলে রাখা। দু’একবার অলকানন্দাদিও তাকিয়েছেন প্যাকেটটার দিকে। হাবিব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জানালা দিয়ে তাকান বাহিরে। চোখে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মাগরিবের নামাজের সময়। হাবিব বলল দিদি আমি একটু নামাজটা পড়ে নেই। বলেই উঠলেন। অলকানন্দাদি হাবিবকে নিয়ে গেল পশ্চিম দিকটার বড় বারান্দায় বেশ প্রশস্ত। একটা সাদা ফর্সা কাপড় বিছিয়ে দিলেন। আর পশ্চিম দিকটা দেখিয়ে দিলেন। পাশের কক্ষে বাজতে থাকা রাগসংগীতের অডিওটা বন্ধ করে দিলেন।
মাগরিবের নামাজ শেষে হাবিব এসে আবার বসেন ড্রইংরুমে। অলকানন্দাদি ওখানেই বসে ছিলেন। হাবিবকে বললেন তুমি কিন্তু রাতের খাবার খেয়ে যাবে। হাবিব বলেন, দিদি কনফারেন্স কমিটির পক্ষ থেকেই একটা ডিনার আছে। ওখানে এটেন্ড করতে হবে। এর মধ্যেই বাসার তরুণী গৃহকর্মী একটি ট্রেতে করে চপ, পায়েস, মিষ্টি ও চা নিয়ে আসে। এগুলো রাখে টেবিলে। অলকানন্দাদি চপের প্লেটটি উঠিয়ে দেয় হাবিবের হাতে। হাবিব তাকায় দিদির ডান হাতের দিকে। হাতে একটা আংটি ও একটা সোনালি চুড়ি পরা যেন সেই তরুণীর হাত যে হাত দিয়ে একদিন হাবিবকে মিষ্টি কামরাঙ্গা দিয়েছিলেন। হাবিব ঘটনাটা মনে করিয়ে দেয়। দিদি হাসেন। দিদি জিজ্ঞেস করেন দেশের কথা, গ্রামের কথা, স্কুলের কথা, নদীটার কথা। অলকানন্দাদি আরও বলেন তুমি অনেক ভালো রেজাল্ট করেছিলে আমরা সে খবর পেয়েছিলাম। বাবা শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। এরপর তো আর দীর্ঘ দিন কোনো যোগাযোগ নেই।
অলকানন্দাদির স্মৃতিরা যেন তার কৈশোর তারুণ্যে যাত্রা শুরু করেছে। তিনি আবার লাগাম দিয়ে টেনে আনলেন এই ড্রইংরুমে। হাবিব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলে রাখে। ডান হাত দিয়ে প্যাকেটটা তুলে নেয়। অলকানন্দাদিও চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন। হাবিব বলেন এটা আপনার। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর আমি এটা বয়ে বেড়িয়েছি।
বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকায় প্যাকেটটার দিকে। আস্তে হাতে নেয় প্যাকেটটি। একটা ধূসর প্যাকেট স্কসটেপ দিয়ে মোড়ানো। একটা কাঁচি দিয়ে একপাশ কেটে খুব সাবধানে খোলে প্যাকেটটি। ভেতরে জীর্ণ মলাটে মোড়ানো একটা বই। বইটার কাভারটা শক্ত; কিন্তু সেলাই ও অন্য পৃষ্ঠাগুলো খুবই নাজুক। প্রথম পৃষ্ঠা উলটাতেই ভেসে উঠল :
অলকানন্দ রায়
জৈনকাঠী উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়
মাধ্যমিক উচ্চতর গণিত
দশম শ্রেণী, বিজ্ঞান বিভাগ
রোল নম্বর-১
ফাউনটেইন পেনের লেখাটা বেশ ঝাপসা হয়ে গেছে। আরও একবার পড়ার চেষ্টা করেন তিনি। অক্ষর ও শব্দরা যেন প্রফেসর অলকানন্দার সঙ্গে কানামাছি খেলছে। তার মনে পড়ছে অনেক কিছু। স্মৃতিগুলো যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে কার আগে কে আসবে তার মনে। শত শত স্মৃতি যেন অবশ করে দিচ্ছে প্রফেসর অলকানন্দার মগজ। স্মৃতির মধ্যে হাতরাতে থাকেন তিনি।
প্রফেসর রহমানের মনে একটা যৌক্তিক শঙ্কা দেখা দেয়। যদি অলকানন্দাদি জানতে চান তিনি কোথা থেকে বইটি পেয়েছে? কী উত্তর দিবেন প্রফেসর রহমান? প্রফেসর রহমান মিথ্যা বলতে পারেন না। তার ধর্মীয় শিক্ষা তাকে মিথ্যা বলতে নিরুৎসাহিত করে। সেদিনের সেই ঘটনার কথা মনে আসতেই তার ভেতরে একটা অপরাধ বোধ কাজ করে। সেদিন যদি তিনি কিশোর না হয়ে পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ হতেন তাহলে এ কাজে অন্যদের বাধা না দিলেও নিজে এ কাজ কখনোই করতেন না।
সেপ্টেম্বরের সেই বিকেলটা ছিল গুমোট। চারপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুটপাটের খবর আসছিল। এর পেছনের নগ্ন রাজনীতি ও প্রতিহিংসা কোনো কিছু বুঝে উঠবার আগেই সেই বিকেলে তাড়াহুড়ো করে কয়েকটা ভাত খেয়ে তার গ্রামের বেশ কয়েকজন বড় ভাইদের সাথে রায়বাড়ির লুটপাটের ঘটনা দেখতে গিয়েছিলেন। অন্যদের উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন কিশোর হাবিবের ক্ষেত্রে অতি উৎসাহটাই কাজ করেছিল। মাস ছয়েক আগে যে রায়বাড়ি তিনি দেখেছিলেন আর সেদিনের রায়বাড়ি দেখে তার হৃদয়টা আঁতকে উঠেছিল। আগুনে পুড়ে বেশির ভাগই শেষ। যা বাকি ছিল তাও চারপাশের কিছু প্রতিবেশীরা লুটপাট করে নিয়েছিল। সেদিন কিশোর হাবিবের চোখে চারপাশের মানুষগুলোকে বেশ অপরিচিত লেগেছিল। মানুষের চামড়া দ্বারা আবদ্ধ হাড়, মাংস, শিরা-উপশিরার মধ্যে যে কি পরিমান ঘৃণা, ক্ষোভ, লোভ ধারণ করে তার একটা অংশ সেদিন তিনি টের পেয়েছিলেন।
ভগ্ন হৃদয় নিয়ে কিশোর হাবিব একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেদিন দেখছিলেন পুড়ে যাওয়া সম্পর্ক। কামরাঙ্গা গাছটার নিচে বেশ কিছু আদপোড়া বই পড়েছিল। সেখান থেকে খুঁজে পেয়েছিলেন এই উচ্চমাধ্যমিক উচ্চতর গণিত বইটি। গণিতের প্রতি তার ভালোবাসা কিছুদিন আগেই শুরু হয়েছিল। অনেকেই অনেক কিছু লুটপাট করে সঙ্গে নিয়ে ফিরেছিল সেই ঐতিহ্যবাহী রায়বাড়ি থেকে। কিশোর হাবিব সেদিন সঙ্গে করে ফিরেছিলেন মানুষ সম্পর্কে কতগুলো নির্মম ধারণা ও উচ্চতর গণিতের বইটি।
স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে প্রফেসর অলোকানন্দ চ্যাটার্জি। আরও একটি পৃষ্ঠা উলটায়। একটা জীর্ণ গোলাপ প্রায় চ‚র্ণবিচ‚র্ণ হওয়ার উপক্রম। পৃষ্ঠার সাথে কোনভাবে লেপটে আছে। আরও একটা স্মৃতি ধূসর থেকে রঙিন হয়ে ওঠে। তার হৃদয়টা ফুলটার মতোই চ‚র্ণ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। টেবিলের একপাশে অপরাধ বোধে সংকুচিত হয়ে যাওয়া প্রফেসর রহমানের মন আর একপাশে প্রফেসর অলোকানন্দার হারিয়ে যাওয়া দুঃসহ স্মৃতি। মুখোমুখি বসে থাকা দুটি হৃদয় যেন দুটো জগতে হাতড়ে বেড়াচ্ছে যে দুঃখের একই উৎস। এই মুহূর্তে ভাষারা যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
চূর্ণবিচ‚র্ণ হয়ে যাওয়া শুকনো গোলাপটা আঙুল দিয়ে আলতো করে স্পর্শে করেন প্রফেসর অলোকানন্দা। জীর্ণ গন্ধটাও একবার স্পর্শ করতে ইচ্ছে হয় তার । চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। শীতের সন্ধ্যাটা যেন কেমন ভারী মনে হয়। প্রফেসর অলোকানন্দা ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে বেলকুনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরের লাইটগুলো অন্ধকারের সঙ্গে অদৃশ্য এক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি তাকান দূরে, তার দৃষ্টি ঐ দূরের বৃক্ষদের, টিলা ও জনপদ পেরিয়ে চলে যায় ওই দূর নক্ষত্রে। তার চোখে ভেসে ওঠে বাবলু ভাইয়ের মুখটা। বাবলু ভাই ছিল তার কৈশোরের হিরো ও যৌবনের প্রেমিক। কয়েক গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। ভবানীপুর হাই স্কুলের হেডমাস্টার ফজলু স্যারের ছোট ছেলে। এলাকার স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে। ঢাকায় গিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে ছিল তার অবিচল আস্থা। সাম্যবাদী রাজনীতি করতেন। দেশে এলেই নাটক ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। তাকেও নাচতে আর আবৃত্তি করতে উৎসাহিত করেছিলেন। একটা মানুষের কীভাবে এত প্রাণশক্তি থাকে তা ঐ কিশোরী বয়সে তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। যৌবনের শুরুতে কিছুটা বুঝেছিলেন তার সঙ্গ পেয়ে। তার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে শেষ স্মৃতিটা।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে গ্রামে এসেছিলেন। এলাকার তরুণদের উৎসাহিত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য। যে কয়েকদিন ছিলেন এর মধ্যে একটি নাটকও মঞ্চস্থ করেছিলেন, একটি দেয়াল পত্রিকা বের করেছিলেন। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাতে একদিন তাদের বাড়ি এসেছিলেন বাবার সঙ্গে কিছু বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য। সেবারই এই ফুলটা নিয়ে এসেছিলেন পাঞ্জাবির পকেটে করে। ফিরে যাওয়ার সময় আমি পুকুরের ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চুপি চুপি আমাকে গোলাপ ফুলটি দিয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন চিঠি লিখতে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কোন ঠিকানায়? তিনি হেসে হেসে বলেছিলেন সমস্ত বাংলাদেশই আমার ঠিকানা। এরপর চলে গেলেন দৃষ্টিসীমার বাইরে। আর দেখা হয়নি।
দেশ ছেড়ে আসার বেশ কয়েক মাস পর শুনেছিলেন ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সম্মুখ যুদ্ধে শহিদ হন বাবলু ভাই; দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে। অলোকানন্দা শুকনো গোলাপের চূর্ণগুলো হাতে নেয়, জীর্ণ গন্ধটা আরও একবার নিঃশ্বাস ভরে নেয়। দূর আকাশের দিকে তাকায়। সব নক্ষত্রেরা যেন আরও জ্বলজ্বল করছে। বাবলু ভাইয়ের শেষ কথাটা মনে পড়ে তার সমস্ত বাংলাদেশই আমার ঠিকানা।