ড. সাজ্জাদ বকুল
হাসান আজিজুল হক: প্রান্তজনের সখা
সাহিত্যচর্চা করতে গেলে কি কেন্দ্রেই আস্তানা গাড়তে হবে? কেন? যে-সাহিত্য রচনা করতে হলে প্রান্তেই বিচরণ করতে হবে, প্রান্তজনের মানুষের মাঝে মিশে যেতে হবে, সেভাবে রচিত মহৎ সাহিত্যের বহুল প্রচার, প্রসার বা মূল্যায়নের জন্য কেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো হাসান আজিজুল হককেও কখনো কখনো ভাবিত করে থাকবে। তবে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এই আক্ষেপ তাঁকে কখনোই করতে দেখিনি আমি। কেন্দ্র ছেড়ে রাজশাহীর মতো প্রান্তে বসে সাহিত্যচর্চা করে তিনি যে খুব ভুল করেছেন তাঁর তেমন উপলব্ধির কথাও জানতে পারিনি। বরং তিনি রাজশাহীতে থেকেই সাহিত্যচর্চা করতে ভলোবেসেছেন। তিনি যে মাপের সাহিত্যিক ছিলেন, কেন্দ্র তথা রাজধানী যে তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন করছে না, তা নিয়ে তাঁকে কখনো আক্ষেপ করতে শুনিনি।
এখানে মূল্যায়ন বলতে যদি শুধু পুরস্কার-সম্মাননার কথা ধরি, তবে সে মূল্যায়ন কিন্তু হাসান আজিজুল হক প্রান্তে বসেই আদায় করে নিতে পেরেছেন নিজ গুণে। রাজধানীর বাইরে বসেই ১৯৭০ সালে তিনি মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে অর্জন করেছেন বাংলাদেশের সাহিত্যে সম্মানজনক স্বীকৃতি ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’। এরপর থেকে শক্তিশালী কথাশিল্পীর স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সব পুরস্কার-সম্মাননা অর্জন করেছেন। দেশের বেসামরিক পুরস্কারের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ‘একুশে পদক’ পেয়েছেন ১৯৯৯ সালে। ২০১৯ সালে পেয়েছেন সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’।
প্রান্তে বসে সাহিত্যচর্চা করেও এমন স্বীকৃতি তিনি ঠিকই আদায় করে নিয়েছিলেন। মাত্র শ’খানেক ছোটগল্প আর দুটি উপন্যাস, কিছু প্রবন্ধ আর কিছু শিশুসাহিত্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী লেখক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন তিনি, যুগের পর যুগ হয়ে আসবেন। শুধু কি দেশের ভেতর? দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতের কলকাতা থেকেও সেখানকার সাহিত্যের খুব গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি ‘আনন্দ পুরস্কার’ অর্জন করেছেন ২০০৮ সালে; ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের জন্য। পশ্চিমবঙ্গেও তাঁর সাহিত্যের সমঝদার পাঠক রয়েছেন বহু। ১৫ নভেম্বর তিনি পৃথিবী থেকে শারীরিকভাবে চিরবিদায় নিলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী টুইটারে এক পোস্টে এই যশস্বী কথাসাহিত্যিকের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন। বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান।
এতো এতো স্বীকৃতির পরেও তবে কেন্দ্র-প্রান্ত প্রসঙ্গ আসছে কেন? আসছে মূলত গণমাধ্যমে হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুকে কীভাবে উপস্থাপন করা হলো তার নিরিখে। গণমাধ্যমে জীবিত হাসান আজিজুল হক যেমন সেভাবে ঠাঁই পাননি, মৃত্যুতেও তার ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল বাদ দিলে বেশিরভাগ গণমাধ্যমে হাসান আজিজুল হকের মৃত্যু ঘিরে সংবাদ বা অন্যান্য কনটেন্টে তাঁকে যেভাবে যে মাত্রায় হাজির করার কথা ছিল তা হয়েছে কি? সমকালীন বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো শক্তিশালী কথাকার ও রাজনীতি-সমাজসচেতন মানুষ কয়জন ছিলেন বা আছেন? তাহলে তাঁকে গণমাধ্যমে উপস্থাপনে এতো কার্পণ্য কেন?
এ কি তবে হাসান আজিজুল হক প্রান্তের লেখক বলে? তিনি যদি রাজশাহী না থেকে রাজধানীতে থাকতেন তাহলে তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে আরো বেশি আয়োজন, মিডিয়ায় আরো বেশি তোলপাড় হতো না? আমি কারো সঙ্গে তুলনায় যেতে চাই না। শুধু তিনি যেভাবে পাদপ্রদীপের আলোয় থাকার মতো গুণের অধিকারী ছিলেন সেটুকু তাঁর ক্ষেত্রে করা হলো কিনা—সেই প্রশ্ন আমি তুলতে চাই। তাঁর মৃত্যুর পরের দু দিনের মিডিয়া কাভারেজ দেখে এটা মনে হতেই পারে, গণমাধ্যমের একটা বড় অংশ হাসান আজিজুল হককে প্রান্তের লেখক হিসেবেই বিবেচনা করেছে।
আমি দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর ধরে হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে দেখেছি, তিনি এসব নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাতেন না। তিনি শুধু নিজের কাজটা করে যেতেন। ২০১৯ সালে তাঁর আশিতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমি রাজশাহীতে একটা বড় আয়োজনের উদ্যোগ নেই। সেই আয়োজনে রাজশাহীর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ সর্বস্তরের মানুষ ছুটে এসেছিলেন। রাজশাহীর বাইরে পাবনা, নাটোরসহ দূর দূরান্ত থেকে মানুষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন।
কিন্তু আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ করেছিলাম, এ রকম একজন কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিকের ৮০তম জন্মবার্ষিকী পালনের কোনো উদ্যোগ কেন্দ্র থেকে কেউ গ্রহণ করেননি। অন্তত আমাদের আয়োজন নিয়ে বা হাসান আজিজুল হকের ৮০তম জন্মবার্ষিকী ঘিরে গণমাধ্যমগুলো যদি যথাযোগ্য কাভারেজ দিত তাতেও সান্ত্বনা পাওয়া যেত। কিন্তু কেন্দ্রের প্রায় সকল গণমাধ্যম আমাদের হতাশ করেছে। সেদিন বেশিরভাগ গণমাধ্যমেই আমাদের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই দিকপালের জীবনের এই স্মরণীয় দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার মতো কোনো আয়োজন আমার চোখে পড়েনি। একই ঘটনা ঘটল তাঁর মৃত্যুর পরেও। সংবাদপত্রগুলোর কিছু কিছু এই দুই দিনে সম্পাদকীয় পাতায় কিছু উপ-সম্পাদকীয় ছাপা ছাড়া ‘বিশেষ সংখ্যা’ বা এ ধরনের কোনো আয়োজন করেনি। আরো কয়েক দিন গেলে বোঝা যাবে তাদের তেমন কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা। কিন্তু আগের অভিজ্ঞতা বলে তেমন হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
সারাজীবন প্রান্তিক মানুষের জীবনের দুঃখ, কষ্ট, লাঞ্ছনা, সংগ্রামের কথা কতো দরদ দিয়ে লিখে গেলেন ‘ছোটগল্পের বরপুত্র’ হাসান আজিজুল হক। প্রান্তে বসে প্রান্তজনের মধ্যে বিচরণ করে বাংলা সাহিত্যের জগতে কিছু মহৎ সাহিত্য তিনি যোগ করে গেলেন। কিন্তু কেন্দ্র ছেড়ে প্রান্তে থাকার কারণেই হয়তো তিনি কেন্দ্রের মনোজগতে সেভাবে আঁচড় কাটতে পারলেন না। উদার মানসিকতার এই মানুষটা নিজে তার চেষ্টা কখনো করেননি। কিন্তু কেন্দ্রের তো সেটা করা উচিত ছিল, নাকি? আগে হয় নি। ভবিষ্যতে হলেও ক্ষতি কী?