টনসিল অপারেশন কখন এবং কেন করবেন?
ছবি সংগৃহিত
টনসিল হলো আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থার একটি অংশ। যা আমাদের মুখের ভেতরে চারটি গ্রুপে অবস্থান করে। এগুলো হলো-লিঙ্গুয়াল, প্যালাটাইন, টিউবাল ও অ্যাডেনয়েড। এই টনসিলগুলোর কোনো একটির প্রদাহ হলেই তাকে বলে টনসিলাইটিস। অনেকেই টনসিলাইটিসের সমস্যায় ভোগেন। বিশেষ করে শীতকালে এটি নিয়ে বেশ ভুগতে হয়। শিশুদের এটি অন্যতম ও সাধারণ একটি সমস্যা। যা বছরে বারবারও হতে পারে।
আমাদের গলার ভেতর দিকের দুই পাশের দুটি গ্রন্থির নাম টনসিল। এই গ্রন্থি আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমের অংশ, যা প্রয়োজনে অ্যান্টিবডি তৈরি করে প্রাথমিক রোগপ্রতিরোধে সাহায্য করে। আর টনসিলাইটিস মানে হলো টনসিলের প্রদাহ।
সাধারণত কম বয়সী শিশুরা ভাইরাসজনিত কারণে (যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দ্বারা) টনসিলাইটিসে আক্রান্ত হয়। শীতের দিনে মৌসুমি ফ্লু হওয়ায় টনসিলাইটিসের প্রকোপ বাড়ে। এছাড়া ‘গ্রুপ এ বিটা-হেমলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস’ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুর টনসিলাইটিস হতে পারে।
টনসিলাইটিস দুই ধরনের হয়
১। একিউট টনসিলাইটিস: হঠাৎ করে একদিন হতে পারে। ৫ থেকে ৭ দিন পর চলে যায়।
২। ক্রনিক টনসিলাইটিস: এটা ঘনঘন হয়। কিছুদিন পরপরই সংক্রমণ হবে, ব্যথা হবে।
কখনও কখনও টনসিলের চারিপাশে ফোঁড়া হতে পারে, যেটাকে বলা হয় Peritonsillar Abscess. এ ক্ষেত্রে তৎক্ষনাৎ লোকাল এনেস্থিসিয়ার মাধ্যমে পূঁজ বের করে দিতে হয় এবং পরবর্তীতে এক থেকে দেড় মাস পর টনসিল অপারেশন করে ফেলে দিতে হয়।
রোগের লক্ষণঃ
১। গলাব্যথা, তীব্র বা মাঝারি ধরনের
২। মাথাব্যথা, জ্বর
৩। খাবার খেতে কষ্ট ও মুখ হাঁ করতে অসুবিধা হয়।
৪। কানেও ব্যথা হতে পারে।
৫। মুখ দিয়ে লালা বের হয় ও কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে যেতে পারে।মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হতে পারে।
৬। স্বরভঙ্গ, গলায় ঘাসহ টনসিল স্ফীতি, ঢোঁক গিলতে কষ্ট হয়, গলা ফুলে যাওয়া।
কারণঃ
টনসিল ইনফেকশন বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কিছু ভাইরাস সংক্রমণের কারনে হয়ে থাকে।
প্রাথমিকভাবে ভাইরাস সংক্রমণের সাথে সাথে কিছু ব্যাকটেরিয়া পরবর্তীতে টনসিলের ইনফেকশন বাড়িয়ে তুলতে পারে। পুষ্টির অভাব বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, আইসক্রিম, ফ্রিজে রাখা শীতল পানি বেশি পান করা, মুখ ঠিকমত পরিষ্কার না রাখা, ক্ষতিকর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ টনসিলের ইনফেকশনের কারন হতে পারে। স্যাঁতসেঁতে বাসস্থান, ঠান্ডা আবহাওয়া, শীতের প্রকোপ বেশি হলে, গরমে ঘাম বসে গেলে টনসিলের প্রদাহ বেড়ে যেতে পারে।
টনসিল ইনফেকশন কাদের বেশী হয়?
১। সাধারণত ছোট বাচ্চাদের (৫-১৫ বছর) ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া জনিত সংক্রমণ বেশী হয়।
২। বাচ্চারা খেলাধুলা করার সময় সহজেই জীবাণুর সংস্পর্শে চলে আসে।
৩। বেশী পরিমাণে ঠান্ডা খাবার ( আইসক্রিম, ফ্রীজের ঠান্ডা পানি ইত্যাদি) ও তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে টনসিল ইনফেকশন হতে দেখা যায়।
৪। নাক জ্যাম, নাকের মাংস বৃদ্ধি, এডিনয়েড বেড়ে গেলে মুখ দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার কারণে সহজেই ঘন ঘন টনসিল ইনফেকশন হতে পারে।
৫। নিয়মিত মুখ, দাঁত ও গলা পরিস্কার না রাখলে।
৬। কোন কারনে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে।
টনসিল ইনফেকশন হলে কি করবেন?
১। প্রচুর পরিমাণে কুসুম গরম পানি ও তরল খাবার খেতে হবে।
২। পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে যত দিন সুস্থ না হবে।
৩। মুখের হাইজিন (মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য) বা ওরাল হাইজিন ঠিক রাখতে হবে।
৪। বারবার কুলি বা মাউথ ওয়াশ (Viodin / Arodin Mouth wash 1%) করতে হবে।
৫। সাধারণ স্যালাইন বা লবণ মিশ্রিত গরম পানি দিয়ে বারবার কুলি করতে হবে।
৬। লেবু বা আদা চাও খেতে পারেন।
৭। গলায় ঠান্ডা লাগানো যাবে না।
যেহেতু তীব্র ব্যথা থাকে এবং জ্বর থাকে, সে ক্ষেত্রে প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ খেতে এবং পরবর্তীতে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হতে পারে।
নিয়মিত অসুধ খেলে, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও নিয়ম মেনে চললে রোগী সাধারণত ১-২ সপ্তাহের মধ্যে পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে।
তবে অপর্যাপ্ত চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে দীর্ঘ মেয়াদী ইনফেকশন বা ক্রনিক টনসিলাইটিস হতে পারে এবং কিছু অন্যান্য শারীরিক জটিলতা যেমন, কিডনি ও হার্টের বাল্বের সমস্যাও হতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি টনসিলাইটিসের চিকিৎসা সাধারণত অস্ত্রোপচার বা অপারেশন। যদি বারবার টনসিলাইটিস হয় বা এর জন্য অন্য কোনো জটিলতার সৃষ্টি হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে টনসিল ফেলে দেয়াই ভালো।
কখন টনসিলের অপারেশন করতে হয়!
১। দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক টনসিলাইটিস
২। টনসিল বড় হয়ে শ্বাসনালি বন্ধ হয়ে গেলে এবং নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা হলে।
৩। টনসিলে যদি ফোঁড়া বা পেরিটনসিলার এবসেস হয়।
৪। যদি বছরে তিন-চার বারের বেশি ইনফেকশন হয়।
৫। এসব কারণ ছাড়াও যদি দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক ক্রিপটোকঙ্কাল ইনফেকশন হয়।
৬। স্টাইলয়েড প্রসেস অপারেশন এর সময়
কখন অপারেশন করা যাবে নাঃ
১। অ্যাকিউট ইনফেকশন থাকলে টনসিলে অস্ত্রোপচার করা যাবে না। কারণ, তখন ইনফেকশন সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং রক্তপাত বন্ধ না-ও হতে পারে।
২। জ্বর বা ব্যথা থাকা অবস্থায় করা যাবে না।
৩। যদি কারও রক্তরোগ থাকে, যেমন থ্যালাসেমিয়া।
রক্তনালি এবং রক্তরোগ থাকলে টনসিলে অপারেশন করা যাবে না। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে না এনে অপারেশন করা যাবে না।