অবিবাহিতদের নিয়ে মানুষ কেন রসিকতা করে? গবেষণা কী বলছে
ছবি: সংগৃহীত
জীবনের দীর্ঘ একটা সময় একাই কাটাতে হয়। পড়াশোনার হিসেব চুকিয়ে কর্ম জীবনে প্রবেশ করে তারপরেই সাধারনত বেশিরভাগ মানুষই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় । অনেকে আবার এতো কিছুর তোয়াক্কা না করেই আগেই করে ফেলে । কেউ জীবনে একাকী থাকতে চাইলে, অর্থাৎ প্রেম বা জীবনসঙ্গীর সাথে আবদ্ধ না হলে প্রায়ই তাকে অন্যদের থেকে কিছু কথা শুনতে হয়। বন্ধুমহলের অনেকেই তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করে এবং জীবনে একা থাকা নিয়ে মজার ছলে কটাক্ষ করে। এমনকি প্রায় সময়ই তাকে শুনতে হয়, "তুমি এখনো কেন একা আছো?"
এরমধ্যে অনেককে আবার সান্ত্বনার সুরে আশ্বস্ত করতে বলতে শোনা যায়, চিন্তার কোনো কারণ নেই খুব শীঘ্রই তুমি তোমার মনের মানুষ খুঁজে পাবে। কথাগুলো শুনে মনে হতেই পারে তারা তাদের বন্ধুদের ব্যাপারে ভাবেন এবং তাদের ভালোর জন্য কথাগুলো বলছেন। কিন্তু জরিপ বলছে, কথাগুলো সংবেদনশীল শোনালেও এটি আসলে সিঙ্গেলদের কটাক্ষ ও শেমিং করতেই বলা হয়, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে ও ক্ষতি করছে।
সঙ্গীহীন বা সিঙ্গেল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে একধরনের নেতিবাচক চিন্তা অন্যদের মনে কাজ করে। একাকী থাকা ব্যক্তিদের নিয়ে অন্যরা ভাবেন, এই মানুষটার জীবনে যেহেতু কোনো সঙ্গী নেই, তাহলে নিশ্চয়ই তার জীবনে সুখ নেই। অধিকাংশের ধারণা, একা থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো সমস্যা আছে, নাহলে কেন তারা জীবন সঙ্গী খুঁজে পায়নি বা পাচ্ছে না! ফলে সমাজে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা এই বদ্ধমূল ধারণাগুলো ও অন্যদের কথার রোষানলে পরে আমরা ভাবতে শুরু করি, জীবনে সুখী হতে হলেন অবশ্যই একজন মানুষকে বিয়ে করে সংসার করতে হবে এবং বাচ্চা নিতে হবে।
যদিও সামাজিকভাবে মেনে আসা এই ধারণাগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কয়েক দশক ধরে এর পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে এখনো সঙ্গীহীন মানুষদের তীব্র কটাক্ষের শিকার হতে হচ্ছে। 'বিবিসি ওয়ার্কলাইভ এই গবেষণাটি করতে গিয়ে লক্ষ্য করে, ডেটিং সাইটগুলো (যেখানে মানুষ নিজেদের সাথে মিল রয়েছে এমন কাউকে সঙ্গী হিসেবে খুঁজে নেয়) ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক ১ হাজার জনের মধ্যে ৫২ শতাংশ লোক জানিয়েছিল একাকী থাকায় তাদের কী পরিমাণ কটাক্ষের স্বীকার হতে হয়েছিল। এই কটাক্ষের মাত্রা আরও তীব্র আকারে বেড়ে গিয়েছিল মহামারীর সময় ঘরবন্ধি সময় কাটানোর সময়। তখন মানুষ চিন্তা করতে লাগলো বন্ধী এই সময়তে তারা কার ওপর ভরসা করতে পারে, কে তাদের একান্ত আপনজন। এরমধ্যে ৫৯ শতাংশ মানুষ ছিল যারা তাদের একাকিত্ব জীবনকে উপভোগ করছিলো জানানোর পরেও তাদেরকে অন্যরা নানারকম প্রশ্ন করতো, এমনকি এখনো তাদেরকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
কটাক্ষের শিকার হলে তা কী ক্ষতি করে
গবেষণাটি করতে গিয়ে গবেষকরা কটাক্ষের স্বীকার হওয়া ব্যক্তিদের কাছে জানতে চেয়েছিল, অন্যদের থেকে কোন কথাটি তাদের সবচেয়ে বেশিবার শুনতে হয়েছিল? তাদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ লোকের উত্তর ছিল, তাদেরকে অন্যরা বলতো, "চিন্তা কোরো না, শীঘ্রই তুমি কাউকে খুঁজে পাবে, দেখ।" ২৯ শতাংশ লোকেদের অন্যরা বলেছিল, "নিশ্চয়ই তুমি জীবনে খুব একা বোধ করো, তাই না?" আর ৩৮ শতাংশ মানুষকে অন্যের করুণার শিকার হতে হয়েছিল, যখন অন্যরা শুনেছিল তারা একা।
প্রচলিত আছে, আমাদের সমাজের বেশিরভাগের ধারণা সিঙ্গেল ব্যক্তিদের তুলনায় বিবাহিতরা বেশি সুখী। যারা সিঙ্গেল, তাদের জীবনে সুখের লেশমাত্র তেমন থাকে না এবং একা থাকতে থাকতে তারা একরকম স্বার্থপর হয়ে উঠে। কিন্তু কিছু গবেষণা এই ধারণাগুলোকে ভ্রান্ত ধারণা বলে উল্লেখ করেছে। ২০১৮ সালে করা জার্মান স্টাডি বলেছে, সমাজে কিছু বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে- একা থাকা ব্যক্তির জীবন দুঃখময় হয় আর বিবাহিতদের জীবনের সুখের হয়, কিন্তু এগুলো একেবারেই সঠিক নয়।
একা থাকতে চাওয়া ব্যক্তিদের কটাক্ষের শুরুটা হয় পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে। এটার পেছনে একটা দেশের সরকারের কিছু ভূমিকা থাকে, তারা বিবাহিতদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করে দেয়, যা একজন অবিবাহিত ব্যক্তিকে দেওয়া হয়না। কিছু মানুষের তখন মনে হতে শুরু করে বিয়ে করাটাই জীবনের সঠিক সিদ্ধান্ত হবে। এক্ষেত্রে যারা এই ধারার উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করে অর্থাৎ একা থাকার সিদ্ধান্ত নেয় তাদের জন্য এটাকে অন্যরা জীবনের ভুল সিদ্ধান্ত বলে গণ্য করে।
আমেরিকার কথাই বলা যাক, সেখানে একজন বিবাহিত চাকরিজীবী ব্যক্তি তার স্ত্রীর নামে স্বাস্থ্য সেবা পরিকল্পনা বীমা করতে পারেন। কিন্তু যে ব্যক্তি বিয়ে করেননি তিনি তার ঘনিষ্ঠ কেউ অর্থাৎ ভাই-বোন বা বন্ধুদের জন্য চাইলেই এই বীমা সুবিধা পাচ্ছে না। এমনকি বিবাহিতরা অফিসের ছুটির ক্ষেত্রে পরিবারের সাথে কাটাতে কয়েকদিন বেশি পেয়ে থাকে এবং বেশি বোনাস পায়।
অবিবাহিত নারী-পু্রুষের জন্য কটাক্ষের মাত্রা সমান হয় না
প্রতিটি সমাজেই অবিবাহিত নারী ও পুরুষদের কে সমানভাবে দেখা হয় না বা একই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না। নারীদেরকেই বেশি কথা শুনতে হয় এবং কিছু কিছু সমাজে নারীদের জোর করে বিয়ে দেওয়া হয় ও বাচ্চা নিতে বাধ্য করা হয়। ধরেই নেওয়া হয় অবিবাহিত নারীরা পুরুষবিদ্বেষী হয়, তাই তারা বিয়ে করেনি। যেখানে অবিবাহিত পুরুষদের বয়স নিয়ে কটাক্ষ করা হয় না, সেখানে ওই একই বয়সের কোনো নারী অবিবাহিত থাকলে তার বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে বলে নিন্দে করা হয়। অবিবাহিত পুরুষদের ক্ষেত্রে এটাও ভাবা হয়, নিশ্চয়ই পুরুষটি তার জীবন উপভোগ করতে একা আছেন এবং আনন্দের সাথে জীবনের একাকিত্ব কাটাচ্ছেন। কিন্তু অবিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটিকে দেখা হয় সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে।
সামাজিক ও ভৌগলিক অবস্থানের ওপরেও 'সিঙ্গেল শেমিং' নির্ভর করে। যেমন—চীন, কোরিয়া ও ভারতে বসবাসকারী অবিবাহিত একজন নাগরিককে যেভাবে কটাক্ষের শিকার হতে হয়, আমেরিকা বা মধ্য আমেরিকার একজনকে ওই একইভাবে কটাক্ষের শিকার হতে হয় না। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান নির্ধারণ করে দেয় সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকা ও কে কখন বিয়ে করবে।
সূত্র: বিবিসি