মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী মোন্তাজ গ্রেপ্তার
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এবং দীর্ঘদিন যাবৎ পলাতক যুদ্ধাপরাধী আসামী মো. মোন্তাজ আলী ব্যাপারী ওরফে মমতাজকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৩)।
শনিবার (এপ্রিল) রাতে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানার চন্দ্রা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মোন্তাজ ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম চালাত।
রবিবার (৩০ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলির র্যাব-৩ এর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি জানান, গ্রেপ্তারকৃত আসামি মোন্তাজসহ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের একই মামলার পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ৪টি অভিযোগই প্রমাণিত হয়। ১৯৭১ সালে গঠিত জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষিত তালিকা মোতাবেক আসামি মোন্তাজ জামায়াতে ইসলামীর গাইবান্ধা সদর এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি আব্দুল জব্বার গাইবান্ধা সদর এলাকার শান্তি কমিটি এবং সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিলেন। জব্বারের সঙ্গে যোগসাজসে মমতাজ শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য হিসেবে অত্র এলাকায় লুটপাট ও বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম চালাতেন।
তিনি আরও জানান, ১৯৭১ সালের পহেলা জুন সকাল ১০টার দিকে মমতাজ, আব্দুল ওয়াহেদ, জাছিজার রহমান, আব্দুল জব্বার এবং রঞ্জু মিয়াসহ হেলাল পার্ক আর্মি ক্যাম্প হতে একদল পাক হানাদার ও রাজাকারের ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল গাইবান্ধা সদর থানার বিষ্ণুপুর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর পূর্ব পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হামলা চালায়। অম্বিকাচরণ সরকার এবং আব্দুর রউফ এর বাড়িতে পূর্ব শূত্রতার জের ধরে মমতাজ এবং তার সহযোগী ওয়াহেদ, জাছিজারসহ অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে। একপর্যায়ে তারা অম্বিকাচরণকে ধরপাকড় করে মুখে, মাথায় এবং সারা গাঁয়ে বাঁশ দিয়ে বেধড়ক মারপিট করে। আঘাতের ফলে অম্বিকাচরণ মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে থাকলে তারা তাকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে লুটপাট করা মালামাল নিয়ে স্থান ত্যাগ করে।
তিনি বলেন, আসামিরা এরপর রাজাকার ও পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে মমতাজ এবং ওই মামলার অপর আসামিরা একই গ্রামের দিজেশচন্দ্র সরকারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট চালায়। এ ছাড়া, ফুলকুমারী রাণী এবং সন্ধ্যা রাণীকে পাশবিক নির্যাতন করে জোড় করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায়। ওই ঘটনায় সেই বাড়ির মালিক দ্বিজেশচন্দ্র বাধা দিতে আসলে তারা তাকে গাইবান্ধা আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে এবং তার মরদেহ গুম করে দেন। এ ছাড়া তারা অত্র এলাকার অসংখ্য বাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালিয়ে পরিবারগুলোকে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করে।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের এই অধিনায়ক জানান, ১৮ অক্টোবর ১৯৭১ সকাল ৮টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দলকে সঙ্গে নিয়ে মমতাজ, রঞ্জু, জব্বার, জাছিজার ও ওয়াহেদ মিলে গাইবান্ধা সদরের নান্দিনা গ্রামে সশস্ত্র হামলা চালায়। সেই হামলায় তারা ওই গ্রামের আবু বক্কর, তারা আকন্দ, আনছার আলী এবং নছিম উদ্দিন আকন্দকে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ওই সময় আসামিদের নেতৃত্বে একই গ্রামের সামাদ মোল্লা, শাদা মিয়া, ফরস উদ্দিন ও সেকান্দার আলী মোল্লাকে বাড়ির সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। পাশাপাশি সেই দিনে মমতাজের নেতৃত্বে তারা ৪০ টিরও অধিক বাড়িঘরে ব্যাপক লুটপাট চালিয়ে সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে।
র্যাব জানায়, একই দিনে তারা ২৫ জন সশস্ত্র রাজাকার ও ৩০ জন পাকিস্তানি সেনা নিয়ে পাশের দৌলতপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে লাল মিয়া বেপারী, আব্দুল বাকী, খলিলুল রহমান, দুলাল মিয়া, মহেশ চন্দ্র মন্ডল’কে নৃশংসভাবে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়া, গাইবান্ধা সদর এলাকায় অবস্থিত বেশ কয়েকটি গ্রামে (নান্দিনা, মিরপুর, সাহারবাজার, কাশদহ, বিসিক শিল্প নগরী, ভবানীপুর ও চকগায়েশপুর) সশস্ত্র হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক, ইসলাম উদ্দিন এবং নবীর হোসেনসহ মোট সাতজনকে গুলি করে হত্যা করে।
মামলার রায় হওয়ার পর পলাতক অবস্থায় দুই আসামি (আব্দুল জব্বার এবং রঞ্জু মিয়া) মারা যায়। ইতিপূর্বে উক্ত মামলার পলাতক আসামি জাছিজার রহমান এবং আব্দুল ওয়াহেদ মণ্ডল’কে র্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তার করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মামলাটির সর্বশেষ পলাতক আসামি মোন্তাজ আলী ব্যাপারী ওরফে মমতাজ’কে গতরাতে র্যাব-৩ কর্তৃক গ্রেপ্তার করা হয়। উল্লেখ্য যে, মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া চলমান থাকাকালীন ২০১৬ সালে ধৃত মমতাজ তার নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে আত্মগোপনে থাকতে শুরু করেন। তিনি মাঝে মাঝে গোপনে তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতেন। ২০১৬ সাল থেকে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালীন তিনি কখনই আদালতে হাজিরা দেননি।
২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মামলার শুনানিতে হাজিরা না দেওয়ায় মমতাজের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এর পরপরই মমতাজ তার নিজ বাড়ি ছেড়ে গাইবান্ধা সদরে তার জামাতার বাড়িতে আত্মগোপন করে। সেখান হতে প্রায়ই স্থান পরিবর্তন করে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে তার বড় ছেলে শফিকুল ইসলামের ভাড়া বাসায় আসা যাওয়া করতেন। তার ছেলের ভাড়া বাসাটি নিজ জেলা হতে দূরবর্তী হওয়ায় সেখানে বেশি নিরাপদ ভেবে পরবর্তীতে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের দিকে স্থায়ীভাবে গাজীপুরের কালিয়াকৈর চন্দ্রা এলাকায় ছেলের বাসায় বসবাস করতে থাকেন।
কেএম/এমএমএ/