রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছর আজ, হতাশায় বিচারপ্রার্থীরা
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছর পূর্ণ হলো আজ সোমবার (২৪ এপ্রিল)। ২০১৩ সালের এইদিন সকাল ৮টা ৪৭ মিনিটে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের বহুতল ভবনটি ধসে পড়ে। এতে হতাহত হন কয়েক হাজার শ্রমিক। এই ঘটনাকে অনেকেই 'কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড' হিসেবে অভিহিত করেছেন। অথচ এই দীর্ঘ ১০ বছরেও এই 'হত্যাকাণ্ডের' বিচার পাননি স্বজনেরা।
স্বজনেরা হারিয়েছেন বাবা-মা, ভাইবোনসহ নিকটজনদের। বেঁচে যাওয়া অনেকে পঙ্গু হয়ে গেছেন। নিঃস্ব-রিক্ত মানুষগুলো এই ১০ বছরে বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তারা শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করে চলেছেন। হতাহতের ঘটনায় করা হত্যা মামলার বিচারও এগিয়েছে খুব সামান্যই।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১ হাজার ১৩৬ জন, আহত হন ১ হাজার ৫২৪ জন। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ সময় পার হলেও শ্রমিকদের মেলেনি যথাযথ ক্ষতিপূরণ, হয়নি বিচার। সেদিনের সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো শ্রমিকদের স্বজনেরা যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাননি, তেমনি যথাযথ সহায়তা না পাওয়ায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে অনেক শ্রমিক ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর তদন্তকারী কর্মকর্তার দেওয়া অভিযোগপত্রের তথ্য মতে, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলায় পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। এর আগে বিজিএমইএর কর্মকর্তারা ভবন পরিদর্শন শেষে ভবন ব্যবহার বন্ধ রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু কারখানার মালিক, ভবনমালিক ও তাদের লোকজন শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। এরপরেই ঘটে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
অভিযোগপত্রের তথ্য মতে আরও জানা যায়, রানা প্লাজা একটি বাণিজ্যিক ভবন হলেও এর ভূগর্ভস্থ তলায় গাড়ি রাখার জায়গা, প্রথম তলায় ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়, দ্বিতীয় তলায় বিপণিকেন্দ্র এবং তৃতীয় থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত পোশাক কারখানা ছিল। এর ওপরের দুটি তলা খালি ছিল। ঘটনার দিন সকালে মার্কেটের বেশিরভাগ দোকানপাট বন্ধ থাকলেও, খোলা ছিল তৈরি পোশাক কারখানা।
ফলে দুর্ঘটনায় ইট-কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মুহূর্তেই হারিয়ে যায় হাজারেরও বেশি তাজা প্রাণ। আর সামান্য সৌভাগ্যক্রমে শত শত পোশাক শ্রমিক প্রাণে বেঁচে যান; কিন্তু তাদের বেশিরভাগকেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়।
দুর্ঘটনার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত এবং ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরও ১৯ জন। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৬ জনে। আহত হন ১ হাজার ৫২৪ জন। ২৯১টি মরদেহের পরিচয় শনাক্ত করা ছাড়াই ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। পরে ১৫৭টি লাশের পরিচয় শনাক্ত সম্ভব হয়েছে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতা রফিকুল ইসলাম সুজন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় আজ ১০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। অথচ এ ঘটনায় করা হত্যা মামলার বিচার এখনো তেমন এগোয়নি। এতগুলো প্রাণহানির ঘটনায় সোহেল রানারও বিচার হয়নি বরং আদালত তাকে জামিন দিয়েছে । যদিও সেই জামিন পরে স্থগিত করা হয়। তাছাড়া আজও আহত ও নিখোঁজ পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি।
এই বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় আরেক নেতা খাইরুল ইসলাম মিন্টু বলেন, ১০ বছর পার হলেও এই ঘটনার মূলহোতা সোহেল রানার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হয়নি। এখন পর্যন্ত হতাহত শ্রমিকদের দেওয়া হয়নি ক্ষতিপূরণ। করা হয়নি চিকিৎসার ব্যবস্থা। রানা প্লাজার ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের এখন পর্যন্ত বিচারের আওতায় আনা হয়নি। যখনই ২৪ এপ্রিল আসে বিচার নিয়ে কথা ওঠে। কিন্তু বাকি দিনগুলোতে কোন কথা হয় না।
মিন্টু আরও বলেন, এখনও রানা প্লাজার যেসব শ্রমিক জীবিত আছেন তারা এই দিনে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আসতে চাইলে কারখানার মালিকরা ছুটি দেন না। সরকার ও কারখানার মালিকরা এই দিন ভুলিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠ বিচার চাই।
রানা প্লাজা মামলায় অগ্রগতি কতদূর
রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনায় এ পর্যন্ত ভবনের মালিক রানা, তার পরিবার, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়রসহ বিভিন্ন জনের নামে পাঁচটি মামলা হয়। এরমধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিনটি মামলা দায়ের করে। ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন সাবমিশন মামলায় রানার তিন বছর কারাদণ্ড হয়। এ মামলায় তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
২০১৮ সালের ২৯ মার্চ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমের ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন আদালত।
এছাড়া ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের আরেকটি মামলা চলমান আছে। তবে ভবন ধসের ঘটনায় মূল মামলার বিচারে অগ্রগতি নেই।
২০১৬ সালে ১৮ জুলাই হওয়া মূল মামলার বিচার শুরু হয়। এদিন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন। তবে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে দীর্ঘদিন আটকে ছিল বিচার কাজ। পরে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।
এর আগে, ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে রানার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়। রানা প্লাজা ধ্বস হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবনের মালিক সোহেল রানা। বাকি আসামিদের মধ্যে জামিনে আছেন ৩২ জন, পলাতক ছয়জন এবং মারা গেছেন দুইজন।
এদিকে এই হতাহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও দোষীদের বিচারের দাবিতে প্রতিবছরই এই দিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন সংগঠন। রানা প্লাজা ধসের আট বছর পূর্তিতে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের এক জরিপে বলা হয়, দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকদের ৫১ শতাংশ ২০১৯ সালে বেকার ছিলেন। ২০২০ সালে করোনাকালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ শতাংশ, যা আগের ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এরমধ্যে আহত পোশাক শ্রমিকদের সাড়ে ৯ শতাংশের কোনো আয় নেই। আর সাড়ে ১০ শতাংশের আয় ৫ হাজার ৩০০ টাকার নিচে।
জরিপের ফলাফলে আরও বলা হয়, রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিকদের মধ্যে ৯২ শতাংশই করোনাকালে সরকারের কোনো সহায়তা পাননি। মাত্র ৮ শতাংশ শ্রমিক অল্প কিছু সহায়তা পান। এছাড়া ১৪ শতাংশ শ্রমিকের স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। সাড়ে ১২ শতাংশ শ্রমিক মানসিক ট্রমার মধ্যে আছেন। ২০১৯ সালেও এই সংখ্যা ছিল সাড়ে ১০ শতাংশ। এর মানে ২ শতাংশ শ্রমিকের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের দুই বছর পরেও শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তন নেই। বিচার না পাওয়ার পাশাপাশি যথার্থ সহায়তা না পাওয়ায় বেশরিভাগ শ্রমিক এখনও দুঃখ-কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।
এই ঘটনায় ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। আগামী ১৪ মে মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। এখন পর্যন্ত মামলার ৫৯৪ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৩৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।
এদিকে গেল বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) বিচারপতি আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি শাহেদ নুরুউদ্দিনের হাইকোর্টে একটি বেঞ্চ নির্দেশনায় জানান, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে হতাহতের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাকে জামিন দিচ্ছে হাইকোর্ট। অন্যদিকে রবিবার (৯ এপ্রিল) আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড সুফিয়া খাতুনের একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে সোহেল রানার জামিন স্থগিত করা হয়। সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সাইফুল আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
আরইউ/এএস