আশুরার তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারীরা আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছেন বলে পর্যবেক্ষণ করেছেন আদালত। এ সংক্রান্ত রায়ের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলেছেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তার খামখেয়ালির কারণে চাঁন মিয়াসহ চার আসামি হয়রানি এবং শারীরিক-মানসিক কষ্টের শিকার হয়েছেন বলেও পর্যবেক্ষণ করেন বিচারিক আদালত।

রায়ে আরমান ওরফে মনিরের ১০ বছর এবং কবির হোসাইন ওরফে রাশেদ ওরফে আশিফের ৭ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ৬ আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।

পর্যবেক্ষণে আদালত বলে, আসামি হিরন ও আলবানীর নাম পাওয়া গেলেও এ মামলায় গ্রেফতার হওয়ার আগেই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ায় পুলিশ তাদের নাম তদন্ত প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করেনি। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. সফিউদ্দিন শেখ কার কাছ থেকে বা কোথায় কীভাবে জানতে পেরেছেন যে, হিরন ও আলবানী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে, সে বিষয়েও পুলিশ প্রতিবেদনে কোনো উল্লেখ নেই। এ দুজনের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার সমর্থনে কোনো মামলার কাগজপত্রও আদালতে দাখিল করা হয়নি। হোসেনি দালান গ্রেনেড হামলার নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারী নোমানকে কেন আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, সে বিষয়েও তদন্ত কর্মকর্তা কোনো বক্তব্য দেয়নি। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মো. সফিউদ্দিন শেখ সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই আসামি চাঁন মিয়া, ওমর ফারুক, হাফেজ আহসান উল্লাহ মাহমুদ ও শাহজালাল মিয়াকে এ মামলায় আসামি হিসেবে অযথাই গ্রেফতার করে বিচারের জন্য পাঠান।

রায়ে আদালত বলেন, এক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা ‘মারাত্মক ভুল’ করেছেন এবং চরমভাবে দায়িত্বে অবহেলার পরিচয় দিয়েছেন। এর ফলে হোসেনি দালান গ্রেনেড হামলা মামলার মূল পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা ও হামলাকারীরা আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। কোনো প্রকার সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই এ চারজনকে আসামি করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তার খামখেয়ালির কারণে আসামি চাঁন মিয়াসহ চার আসামি হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং তারা শারীরিক ও মানসিক কষ্টের শিকার হয়েছেন।

পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আসামি কবির হোসেন এবং আরমানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা যায়, হোসেনি দালান গ্রেনেড হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা ছিলেন আলবানী এবং নোমান। হামলায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন রানা ও হিরন। এ মামলার নথিতে আরও দেখা যায়, আসামি জাহিদ হাসান ও রানা ঘটনার সময় শিশু ছিল বিধায় বিচারের জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইনে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরে তাদের বিচারের জন্য শিশু আদালতে পাঠানো হয়।
আদালতের রায়ে খালাস পাওয়া ৬ আসামি হলেন- ওমর ফারুক মানিক, হাফেজ আহসান উল্লাহ মাহমুদ, শাহজালাল মিয়া, চান মিয়া, আবু সাঈদ রাসেল ওরফে সোলায়মান ওরফে সালমান ওরফে সায়মন ও রুবেল ইসলাম ওরফে সজীব ওরফে সুমন।

২০১৫ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে আশুরা উপলক্ষে হোসেনি দালান এলাকায় তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে বোমা হামলা চালায় জেএমবি। এ ঘটনায় রাজধানীর চকবাজার থানায় এসআই জালাল উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি তদন্ত করে চকবাজার থানা পুলিশ। পরে এর তদন্তভার ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়।

তদন্ত শেষে ডিবি দক্ষিণের পুলিশ পরিদর্শক মো. শফিউদ্দিন শেখ ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ১০ জঙ্গিকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরপর মামলাটি ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলি করা হয়।

২০১৭ সালের ৩১ মে ১০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর পর ওই আদালতে মামলার বাদী মো. জালাল উদ্দিন সাক্ষ্য দেন। এরপর ২০১৮ সালের ১৪ মে মামলাটি সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বদলি হয়। বদলি হওয়ার পর থেকে বিচার গতি পায়। ট্রাইব্যুনালে আসার পর ১০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।

এরই মধ্যে অভিযোগপত্রভুক্ত ১০ আসামির মধ্যে জাহিদ হাসান ও মাসুদ রানার পক্ষে তাদের আইনজীবীরা আদালতে দাবি করেন, ওই আসামিরা নাবালক। এর সপক্ষে জন্মসনদ, পরীক্ষার সনদ জমা দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালে। আদালত সব কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাদের শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

এরপর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আইন অনুযায়ী, ওই দুই আসামিকে শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরপর বিচারের জন্য সম্পূরক অভিযোগপত্র নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

ওই হামলায় ১৩ জঙ্গি জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে ১০ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অভিযানের সময় তিন জঙ্গি ক্রসফায়ারে মারা যান। চার্জশিটভুক্ত আসামিরা সবাই জেএমবির সদস্য।

মামলার আসামিরা হলেন- কবির হোসেন, রুবেল ইসলাম, আবু সাঈদ, আরমান, হাফেজ আহসান উল্লাহ মাসুদ, শাহ জালাল, ওমর ফারুক, চাঁন মিয়া, জাহিদ হাসান ও মাসুদ রানা। আসামিদের মধ্যে আরমান, রুবেল ও কবির আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

মামলাসূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত আবদুল্লাহ বাকি ওরফে নোমান ছিলেন হোসেনি দালানে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। হামলার আগে ১০ অক্টোবর তারা বৈঠক করে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন।
বোমা হামলার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন জাহিদ, আরমান ও কবির। কবির ও জাহিদ ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করেন। হামলার পর আশ্রয়ের জন্য কামরাঙ্গীরচরে বাসা ভাড়া করেন আরমান ও রুবেল। ঘটনাস্থলে আরমান পরপর পাঁচটি বোমা ছোঁড়েন।

বাকি পাঁচজন- চান মিয়া, ওমর ফারুক, আহসানউল্লাহ, শাহজালাল ও আবু সাঈদ হামলার ভিডিও করা ছাড়াও হামলায় উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা করেন। আসামি মাসুদ রানারও হামলায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আগের দিন ঢাকার গাবতলীতে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে এএসআই ইব্রাহীম মোল্লাকে হত্যার সময় ঘটনাস্থলে গ্রেফতার হন তিনি।

এমএ/আরএ/