করোনাকালীন টিনএজারদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন
টিনেজার বলতে সাধারণত বয়:সন্ধিকালের সময়টাকে ধরা হয়ে থাকে। সাধারণত শিশুদের ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়স সময়কালকে টিনএজ বলা হয়। এটা এমন একটা বয়সকাল যেখানে শিশুরা শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। তাই এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনেকে বুঝতে পারে না তাদের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে কিভাবে মানিয়ে নিতে হবে। তাই এই বয়সের বাচ্চারা নানা রকম মানসিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে থাকে।
এই সময়টাতে পরিবারের পাশাপাশি শিশুরা তার সমবয়সী বন্ধুবান্ধব এবং তারা যাদের পছন্দ করে থাকে এমন মানুষদের চিন্তা ও ব্যবহার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। যা শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিকতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শিশুরা যদি এই সময়টাতে পরিবার ও বন্ধুদের কাছে ইতিবাচক ব্যবহারও গ্রহণযোগ্যতা পায় তখন তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।
শিশু বিকাশের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে করোনার মহামারী ও তাদের মানসিক ও শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা তৈরিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যেহেতু পুরো বিশ্বব্যাপী শিশু-বৃদ্ধ সকলের জীবনযাত্রায় করোনার মহামারীর কারণে নানা পরিবর্তন ঘটেছে।
আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, শিশুরা অবসাদ, উৎকন্ঠা, মৃত্যু ভয়, মা-বাবাকে হারানোর ভয় এবং হসপিটালে একা থাকার ভয়ে ভুগছে, এই সবকিছু শিশুদের মানসিক বিকাশে খারাপ প্রভাব ফেলছে।
করোনার মহামারীর প্রতিরোধ করার জন্য অনাকাঙ্খিত লকডাউন সকলের দৈনন্দিন জীবনের ওপর প্রভাব ফেলেছে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রা রুটিন পরিবর্তন করে দিয়েছে, যার সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়েছে আমাদের শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর । সামাজিক দুরত্ত বজায় রাখার জন্য বেশির ভাগ স্কুল বন্ধ দেয়া হয়েছে, বাসা থেকে অনলাইনে ক্লাস করা হচ্ছে। হঠাৎ শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সামাজিক মেলামেশার এই পরিবর্তন শিশুদের মন মানসিকতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
স্ট্রেসের কারনে শিশুদের মাঝে অবসাদ,উদ্বেগ,পানিক আটাক,পিটিএসডি, মুড এর সমস্যা, ঘুমের সমস্যাসহ নানা উপসর্গ দেখা যাচ্ছে।বেশিরভাগ শিশু-কিশোর তাদের বন্ধু হিসেবে ডিভাইস যেমন- মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব, কম্পিউটার কে বেছে নিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে অনলাইন গেম ও ইন্টারনেট ব্যবহারে অনেক সময় পার করায় তাদের মধ্যে ডিভাইসের প্রতি আসক্তি দেখা দিয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে তাদের ব্যবহার, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের উপর।
এছাড়া তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা ও হতাশা দেখা দিয়েছে। বর্তমান জীবনের প্রতি গ্রহণযোগ্যতা কমে যাওয়ায়, শিশু-কিশোরদের মাদক দ্রব্যের দিকে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।
আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। শিশু-কিশোরদের কোন পরিস্থিতি মানসিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন– পরিবারে অর্থনৈতিক সমস্যা, লম্বা সময় বাসায় থাকার কারনে বাবা-মা এর বাসা থেকে কাজ করা, বাবা ও মায়ের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব, তাদের চাকুরি হারানোর ভয়, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা ও হতাশা,পরিবারের সদস্যদের অসুস্থ হওয়া, নিজের অসুস্থ হওয়ার ভয়, বাবা- মায়ের সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে কাজ করা ইত্যাদি ।
শিশু-কিশোরদের সুস্থ মানসিক বিকাশে কিভাবে সহযোগিতা করা যেতে পারে-
মা–বাবা/ অবিভাবকেরা নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিলে ভালভাবে তাদের শিশুদের যত্ন নিতে পারবেন। তারা শিশুদের সঙ্গে কোভিড-১৯ নিয়ে কথা বলবেন, এক সঙ্গে বসে টিভি দেখবেন; তাতে করে কোভিড-১৯ এবং কোয়ারেন্টাইন নিয়ে শিশুদের ভয় অনেক কমে যাবে। শিশুরা বাবা মা/অবিভাবকদের চোখে মুখে উৎকণ্ঠা দেখলে তারাও সেভাবে আচরন করবে।
বাবা-মা/ অবিভাবকগন তাদের বয়ঃসন্ধিকালের শিশুদের ভাল থাকার জন্য নিজেরা হু এর নির্দেশিকা অনুসরণ করতে পারেন -
১) সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা
২) ভাল হাইজিন বজায় রাখা- হাত ধোয়া,মাস্ক পরা
৩) টি ভি,সামাজিক মাধ্যমে বেশি সময় খবর না শোনা বা দেখা- কারন এতে স্ট্রেস অনেক বেড়ে যায়।
৪) নিয়মিত ব্যায়াম ,ইয়োগা, মেডিটেশন করা ,সুশম খাবার খাওয়া এবং পর্যাপ্ত ঘুমানো।
৫) অ্যালকোহল বা মাদক দ্রব্য গ্রহন না করা।
বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী টিনএজাররা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের জন্য যা করতে পারে-
১) উদ্বিগ্ন হওয়াকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়া। মহামারির সময়ে উদ্বিগ্ন হওয়া খুব স্বাভাবিক, এটার হাত থেকে নিজেদের প্রটেক্ট করতে আমরা কিছু বিষয় খেয়াল রাখব যেমন-হাত ধোয়া, ভিড় এড়িয়ে চলা এর মধ্য দিয়ে নিজেকে এবং অন্যকে সুস্থ রাখতে পারি।
গুজবে কান না দেয়া। ভয় পেলে বাবা-মা এর সাথে কথা বলা। কোভিড ১৯ শিশুদের জন্য মারাত্বক নয় চিকিৎসার মধ্য দিয়ে আমরা নিজেকে সুস্থ করতে পারি। এ বিষয়ের উপর খেয়াল রাখলে ও জানলে তা আমাদের উৎকণ্ঠা কমাতে সাহায্য করে।
২) অন্য কাজে মনোনিবেশ করা
যেমন– হোম ওয়ার্ক করা, মুভি দেখা বা গল্পের বই পড়া ইত্যাদি।
৩) বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম যেমন- সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা। অভিভাবকের মতামত নিয়ে সীমিত সময় ব্যবহার করা। কারন অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম অনেক ক্ষতির কারণ হতে পা্রে।
৪) নিজের প্রতি মনযোগ দেয়া। নতুন কিছু করা যেমন- নতুন কোন বই পড়া, নতুন কিছু শিখা।এই পরিবর্তিত সময়ে নতুন কিছু করে নিজের মানসিক সাস্থের যত্ন নেয়া যেতে পারে।
৫) নিজের অনুভুতিকে বোঝা।পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানো, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, শখ মেটানো, খেলাধুলা করতে না পারলে মন খারাপ হওয়া সাভাবিক, এটা মেনে নিলেই ভাল হয়। তখন বিভিন্নভাবে অনুভুতিকে প্রকাশ করা যায়। যেমন–আঁকা ,বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে সবকিছু মনের মত নাও হতে পারে, আমরা সুন্দর চিন্তার মধ্য দিয়ে তা মনের মত করে নিতে পারি।
৬) নিজের এবং অন্যের প্রতি সদয় হওয়া
করোনার ও অন্যান্য সময়ে লক্ষ্য করলে দেখা যায় কিছু টিনএজরা স্কূলে বুলিং এর শিকার হচ্ছে। এবিষয়টিতে তারা তাদের বন্ধুদের বা বড়দের সাহায্য নিতে পারে।পরিবারকে এই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
আমাদের সবার সুন্দর মন আছে। সুন্দর মনের অনেক গুণাবলী আছে। সেই জায়গা থেকে আমরা অন্য কাউকে হয়রানি হতে দেখলে তাকে সাহায্য করতে পারি । আমাদের একটি সুন্দর ব্যবহার ও একটি সহানুভুতির কথা অন্য কারো জীবনে অনেক পরিবর্তন আনতে পারে।
এমন কোন কথা বলবো না যা দিয়ে অন্যের মনে আঘাত আনতে পারে। আমরা মনের কথাটি বুঝিয়ে বলতে পারি।
এছাড়া টিন এজ শিশুরা বাবা-মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করতে পারে। আবার সামাজিক দুরত্ত বজায় রেখে বয়স্ক প্রতিবেশিদের সাহায্য করতে এগিয়ে যেতে পারে। কারন ভালো কাজ করার মধ্য দিয়ে নিজের মন ভাল রাখতে পারে।
লেখক: বয়স্ক ও শিশু মনরোগ বিশেষজ্ঞ