নার্স-সিন্ডিকেট চক্র পাচার করছে লাখ লাখ টাকার ওষুধ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) বসেই সরকারি ওষুধ রোগীদের কাছে বিক্রি করছেন নার্স-সিন্ডিকেটরা। হাসপাতাল থেকে লাখ লাখ টাকার ওষুধ বাইরে পাচার করে দিচ্ছে এই সিন্ডিকেট চক্রটি।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, ওষুধের স্টোর কর্মকর্তা ও কর্মচারীও জড়িত রয়েছে এ চক্রের সঙ্গে। নিউজ পোর্টালে, পত্রিকা ও টিভিতে এসব ঘটনার সংবাদ বার বার প্রকাশ হওয়ার পরও হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের কোনো টনক নড়ছে না। এর কারণ কী সাধারণ মানুষ জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। হাসপাতালে এই রকম অনেক অহরহ ঘটনা ঘটছে। ধরা পড়লে জানা যায়, আর ধরা না পড়লে তাদের কার্যক্রম চলতেই থাকে।
এমনি একটি ঘটনা ঘটেছে, লক্ষ্মীপুরের চন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় লিভারের সংক্রমণে আক্রান্ত ফয়সাল হোসেনকে (১৯)। পরে চিকিৎসকের পরার্মশে ভর্তি হন মেডিসিন বিভাগের ৭০১ নম্বর ওয়ার্ডের এক্সটা-২০ নম্বর বেডে। চিকিৎসক তাকে দেখে হাই অ্যান্টিবায়োটিক মেরোপেনেম ইনজেকশন লিখে দেন। চিকিৎসকের পরামর্শে প্রতিদিন তাকে একটি করে ইনজেকশন দেওয়ার কথা। সরকারিভাবে এই ইনজেকশন বরাদ্দ রয়েছে। তবে ওই ওয়ার্ডের নার্স রোগীর স্বজনদের বলেন, এটা আমাদের এখানে সরসরাহ নেই। নার্স বলেন, টাকা দিলে তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন।
তারপর এক হাজার টাকা করে দু'টি ইনজেকশন রোগীর স্বজনের কাছে ২০০০ টাকায় বিক্রি করেন ৭০১ নম্বর ওয়ার্ডের ডিউটিরত সিনিয়র স্টাফ নার্স বিপ্রজিত মণ্ডল। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। এ বিষয়ে লিখিতভাবে ভুল স্বীকার করেন বিপ্রজিত মণ্ডল পার পেয়ে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোগী ফয়সাল হোসেনের ভাবী পলি আক্তার বলেন, আমার দেবর ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয় ১৯ সেপ্টেম্বরে ৭০১ নম্বর ওয়ার্ডের এক্সটা-২০ নম্বর বেডে তার চিকিৎসা চলছে।
তিনি বলেন, চিকিৎসক একটি হাই অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন লিখে দেন। পরে এখানে ডিউটিরত নার্স বিপ্রজিত মণ্ডল জানান, এক হাজার টাকা করে দিলে সে এই ইনজেকশন ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। পরে আমরা তার কাছ থেকে এক হাজার টাকা করে দুটি ইনজেকশন দুই হাজার টাকায় কিনে নেই। আমরা তো বুঝতে পারিনি এটা যে সরকারি ইনজেকশন।
তিনি সরকারি ইনজেকশন আমাদের কাছে বেচে দিয়েছেন। পরে বিষয়টি জানতে পেরেছি। বিষয়টি জানাজানি হলে নার্সদের সিনিয়র অফিসাররা এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন সিনিয়র স্টাফ নার্স বলেন, সরকারি ওষুধ বা ইনজেকশন কোনোভাবেই রোগীর কাছে বিক্রি হতে পারে না। সরকার যে ওষুধ ফ্রি দিয়েছে, সেটা তিনি কীভাবে বিক্রি করলেন। এটি একটি অনেক বড় অপরাধ। একটি দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এটি করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা জানতে পেরেছি, ভুল স্বীকার করে একটি লিখিত আবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছেন বিপ্রজিত।
তিনি আরও বলেন, আমরা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানাই। এ অপরাধে যদি সে বেঁচে যায় তাহলে অনেকেই এরকম অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। আর সাধারণ নার্সরা কেন এই দায় নেবে।
সরকারি ইনজেকশন রোগীর কাছে বিক্রির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ঢামেক হাসপাতালের নার্সিং সেবা তত্ত্বাবধায়ক লিখা বিশ্বাস বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনার এত ইন্টারেস্ট কেন?’
এরপর তিনি বলেন, ‘সে ভুল স্বীকার করে আমাদের কাছে লিখিত একটি আবেদন দিয়েছে। আবেদনে এমন ভুল আর কখনো হবে না বলে ক্ষমা চেয়েছে সে। আমরা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। পরবর্তী সময়ে এমন কোনো ঘটনা ঘটলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাকে ওই ওয়ার্ডে ডিউটিতে আর রাখব না। তাকে ঢামেক হাসপাতালের অন্য জায়গায় ডিউটি দেওয়া হবে। দুই দিনের জন্য পূজার ছুটিতে আছে।’
ছুটি শেষে এলে তাকে অন্য জায়গায় ডিউটি দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। লিখা বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা তাকে প্রথমবার সুযোগ দিয়েছি, দ্বিতীয়বার আর এই সুযোগ দেওয়া হবে না।’এ বিষয়ে জানতে সিনিয়র স্টাফ নার্স বিপ্রজিত মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তিনি এই ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হননি৷
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের একজন ওয়ার্ড মাস্টারের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলনে, হাসপাতালে এই সব সিন্ডিকেটের কারণে রোগীরা ঠিকমত ওষুধ ও অন্য কোনো জিনিসই পাচ্ছেন না।
কর্তৃপক্ষকে চোখের আড়াল করে তারা লাখ লাখ টাকার ওষুধসহ বিভিন্ন জিনিস পত্র বাইরে পাচার করে দিচ্ছে। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্হা নিতে পারছে না।
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো.নাজমুল হক এ বিষয়ে বলেন, ঘটনাটি শুনেছি, তবে রোগীর স্বজনরা লিখিত অভিযোগ দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই সব ঘটনা খুবই দুঃখজনক। তাদের জন্য আমাদের হাসপাতালের দুর্নাম হচ্ছে।
এএইচ/এমএমএ/