করোনাকালীন সময়ে শিশুর মানসকি স্বাস্থ্যের যত্ন
জানুয়ারি ২০২০-এ করোনার প্রাদুর্ভাব হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে মহামারী ঘোষণা করে র্মাচ ২০২০। "করোনা" এমন একটি নতুন নাম যার সঙ্গে আমরা জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পরিচিত হয়েছি। আমরা সকলেই হয়তো বুঝতে পারছি না, কিভাবে মোকাবেলা করব এই কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে । শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল বয়সি মানুষই এই পরিস্থিতিরি সঙ্গে মোকাবেলা করছি । যার প্রভাব পড়ছে আমাদের শারীরিক ও মানসকি স্বাস্থ্যের ওপর। পরিবর্তন ঘটছে আমাদের জীবনযাত্রায়। বড়রা নিজেদের পরিবর্তনগুলি বুঝতে পারলেও শিশুরা খাপ খাওয়াতে পারছে না। ফলে সববয়সী মানুষকেই আতঙ্ক বা ভয় কিছুটা হলেও কাবু করছে। যারা আগে থেকেই মানসিকরোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে এর মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে গেছে।
শিশুদের মধ্যে প্রধানত দুশ্চিন্তা, বিষন্নতাসহ বিভিন্ন আচরণগত সমস্যা হয়। শিশুরা তাদের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা বড়দের মতো করে প্রকাশ করতে পারে না । ফলে সহজেই অস্থিরতা, রাগ, বিরক্তি, ভয় পাওয়া, ঘু্মের সমস্যা ইত্যাদি শিশুদের মাঝে দেখা যায়।
শিশুরা বড়দের পাশাপাশি টিভি/ ইন্টারনেট দেখেছে, কিন্তু তারা অনেক ইনফরমেশন বুঝতে পারে না। ফলে উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে । তাই বাবা-মা অথবা পরিবারে অন্যবয়স্ক মানুষরা যদি বয়স উপযোগী এবং সহায়ক মনোভাব নিয়ে বিষয়গুলি আলোচনা করে থাকে তাহলে তাদের বুঝতে সহজ হবে এবং উদ্বেগের মাত্রা অনেক কমে যাবে।
তাছাড়া পরিবারে বা আশপোশে কেউ করোনা আক্রান্ত হলে শিশুরা অনেক বেশি ভয় পেয়ে যাচ্ছে। শিশুদের মধ্যে অনিরাপত্তা ও অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে । তারা তাদের প্রায় মানুষদের নিয়ে আতঙ্ক অনুভব করছে এবং সঠিকভাবে তাদের অনুভূতিগুলি প্রকাশ করতে পারছে না। উদাহরণস্বরূপ- আমার একটি কস্টের হিস্ট্রি আছে। দেখা যায় যে, একজন মা তার সাত বছর বয়সি শিশুর উদ্বেগ, ঘুমের সমস্যা এবং প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের জন্য আমার শরণাপন্ন হন। হিস্ট্রি নিয়ে দেখা গেল শিশুটির দাদি মারা গেছে শ্বাসকষ্টে ভুগে তাই শিশুটি ভয় পাচ্ছে। তার মনে ভয় সেও একই কারণে মারা যায়।
শিশুটির অভিভাবক সঠিক সময়ে সাহায্যের জন্য নিয়ে আসাতে ওর সময়মত চিকিৎসা হয়। এই রকম অনেক শিশু বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে । বাবা–মা জিরো যেহেতু অনেক স্ট্রেসে আছেন,তারা হয়ত বাচ্চাকে যথেষ্ট মনযোগ দিতে পারছেন না।
ইউনিসেফ এবং হু এর ভাষ্যমতে শিশুদের কোভিড-১৯ সংক্ষিপ্ত নির্দেশিকা র্পযালোচনা করে দেখা যায় -
১। শিশুকে খোলাখুলি প্রশ্ন করে জানুন সে কোভিড-১৯ সর্ম্পকে কতটুকু জানে।
২। সৎ থাকুন-বিষয়টি শিশু বান্ধব উপায়ে ব্যাখ্যা করুন। তাদের প্রতিক্রিয়িা খেয়াল করুন এবং উদ্বেগের মাত্রা বোঝার চেষ্টা করুন এবং তাদের প্রতি সংবদেনশীল হোন। কোন কিছু বানিয়ে বলবে না। তাদের জানান মিডিয়ার সব তথ্য সঠিক নয়। বিশেষজ্ঞদের মতামত জানা প্রয়োজন ।
৩। ছেলেমেয়েরা কিভাবে নিজেদের এবং তাদের বন্ধুদের রক্ষা করতে পারে তা দেখিয়ে দেন। হাত ধোয়া, হাঁচি কাশির সময় কিভাবে কনুই দিয়ে নাক মুখ ঢাকতে হবে তা দেখিয়ে দিন। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা, যাদের উপর্সগ আছে তাদের কাছে না যাওয়া এবং জর, কাঁশি, শ্বাসকষ্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে জানাতে বলুন।
৪। আস্বস্ত করুন ।
টিভি অনলাইনে মন খারাপ করা ছবি দেখে বাচ্চারা খুব ভয় পায়, তখন, বাচ্চাকে নিয়ে খেলাধুলা করে শান্ত করার চেষ্টা করুন। বলুন তাকে সুস্থ রাখার জন্যে বড়রা কাজ করছে।
শিশুকে বোঝান সে অসুস্থ হলে তাকে ঘরে বা হাসপাতালে থাকতে হবে। নিজের এবং অন্যদের ভালোর জন্যে, যদিও তা বোরিং।
৫। দেখুন শিশুরা কোন স্টগমার শিকার হচ্ছে কিনা ।
শিশুকে জানান যে কোভিড-১৯ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে যে কারো হতে পারে। যে বুলি অথবা কোন হুমকির শিকার হলে সে যেন অভিভাবক কে জানায়।
৬। সাহায্যকারীদের নিজের দিকে নজর দিন। সম্মুখযোদ্ধাদের কথা শিশুদের বলুন, সহৃদয় লোকজন পাশে আছে জানলে সে স্বস্তি পাবে।
৭। নিজের প্রতি যত্নশীল হোন।
বাচ্চারা বড়দের ব্যবহার খেয়াল করে, তাই নিজেদের মানসকি স্বাস্থ্যর যত্ন নিন। কোন সংবাদে নিজের উৎকণ্ঠা হলে কারও সঙ্গে শেয়ার করুন, সময় নিন। বাচ্চাকে বুঝতে দিন আপনি ঠিক আছেন। ।
৮। সতর্কতার সাথে আলোচনা শেষ করুন।
আলোচনা শেষ করার সময় বাচ্চার উদ্বেগের মাত্রা বোঝার চেষ্টা করুন। বাচ্চার শরীরি ভাষা, কথা বলার ধরন এবং শ্বাস-প্রশ্বাস এর স্বাভাবিকতা দেখা।
শিশুর মানসিক চাপ কমাতে যা করা উচিত।
-শিশুকে যথেস্ট সময় দিন। শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবং তার মনোভাব প্রকাশ করার সুযোগ দিন। শিশুর বয়স অনুযায়ী গল্প, ছবি অংক বা খেলার মাধ্যমে হতে পারে ।
-শিশুকে বাবা-মা এবং ফ্যামলিরি সদস্যদের কাছাকাছি রাখুন।
-পরিবারে নিয়মিত রুটিন বজায় রাখুন, কিন্তু বর্তমান সময়ে কিছুটা শিথিলতার সাথে পড়াশোনার রুটিন করা, বয়স উপযোগী বাসার কাজে সাহায্য করা, খেলাধুলা করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা।
-উদ্বিগ্ন শিশুরা বাবা মায়ের কাছে ঘেঁষে থাকতে চায় এবং বেশি আবদার করে। বাবা-মা অনেক যত্ন সহকারে বাচ্চার কথাটি শোনে এবং বাচ্চার জায়গা থেকে বিষয়টি চিন্তা করে তাকে বুঝিয়ে দেয়।
বাচ্চার অভিভাবকদের প্রতি যে বিষয়গুলি নজর রাখতে বলছে তারা যেন তাদের বাচ্চাদের মানসকি স্বাস্ব্যের প্রতি আরও সর্তক ও যত্নশীল হয় এবং বাচ্চাদের ব্যবহার প্রতি জনে একটু নজর আরোপ করা। যে কারণে বাচ্চারা তাদের ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে তাদের সমস্যাগুলি প্রকাশ করে থাকে।
সবশেষে বলা যায় বাচ্চা যদি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়,তাহলে দয়া করে অনলাইনে বা সরাসরি চিকিৎসকের সাহায্য নিন। আমরা যদি মানসকিভাবে ভাল থাকি তাহলে সকল শারীরিক প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে সক্ষম হই। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, মনের যত্ন নিন।
লেখক: শিশু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ