টাকা দিলেই আগে মেলে সেবা
সাত সকালে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেও টেস্ট করার জন্য টাকা জমা দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ১ নং স্টাফ কাউন্টারে টাকা দিলেই তা মিলছে। নামধারী স্টাফরা হুড়াহুড়ি করে কাউন্টারে টেস্টের টাকা জমা দিচ্ছেন। এতে ক্ষুদ্ধ দূর দুরান্ত থেকে আসা সাধারণ রোগিরা। তারা বলছেন, চিকিৎসা নিতে এসে হয়রানি কমছে না। তবে টাকা দিলে বা পরিচিত থাকলে তাড়াতাড়ি মেলে সেবা। গাইনী, মেডিসিনসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডেও রোগিদের ব্যাপক ভিড়। এই ভিড়ে ২টা সিরিয়ালের রোগি ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেলেও ১০টা স্টাফদের নামে সেবা নিচ্ছে।
এই ঘটনা যেনতেন কোনো প্রতিষ্ঠানের নয়। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড) বাস্তব চিত্র। দালালমুক্ত না হওয়ার কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন রোগী ও তার স্বজনেরা। বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর পুরাতন ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড হাসাপাতাল) অ্যান্ড হাসপাতাল সরেজমিন ঘুরে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এই হাসপাতালের ২ নং ভবনের বামে সকাল ৯টার পরই দেখা যায় কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন। তবে কেউ পরিচিত কাজে লাগাতে পারলে তাড়াতাড়ি পেয়ে যাচ্ছেন টিকিট। এ সময় মিজান নামে এক রোগি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘পায়ে আঘাত পেয়ে মঙ্গলবার সুত্রাপুর থেকে ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম। পায়ের এক্সরে পরীক্ষা দিয়েছিলো। কিন্তু তা করতে পারলেও রিপোর্ট পাইনি আগে। তাই আজকে এসেছি। অর্থপেডিক্স ওয়ার্ডে যাব।
ডাক্তাররা প্রয়োজন মনে করলেই সঠিকভাবে রোগ নির্নয় করতে রোগিদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে বলে। এ জন্য তাদের বিভিন্ন কাউন্টারে যেতে হয়। এ সময় ১ নং স্টাফ কাউন্টারে দেখা যায় হুড়াগুড়ি করছেন লুঙ্গিপড়া এক মানুষ। মাসুম আলী খান নামে কথিত এ স্টাফ বলেন, ‘আমি স্টাফ। ৭ তলায় চাকরি করি। কোনো ওয়ার্ডে আছেন চানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বাচ্চা ক্যান্সারের রোগি, জরুরিভাবে টাকা জমা দিব।’ আইডি কার্ড কোথায় বলা মাত্র লাইন পাল্টে অন্য লাইনে ঢুকার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ সময় এক আনসার তাকে বাধা দেয়। এ সময় দেখা যায় আরও একজন নামধারী স্টাফ এক আনসারের পকেটে গোপনে টাকা গুজে টেস্টের জন্য টাকা জমা দিচ্ছে। শুধু এই কয়েক জন নয়, অসংখ্য নামধারী স্টাফ টাকার বিনিময়ে সাধারণ রোগি ও স্বজনদের ভোগাচ্ছে।
এরপর এই ভবনের ২য় তলায় প্যাথলজি বিভাগে কথা হয় নবাবগঞ্জ মোল্লাগঞ্জ থেকে আয়েশা খাতুনের সঙ্গে। তিনি জানান, পরীক্ষা করতে দিয়েছেন। টাকা জমা দেওয়ার জন্য দেড় ঘন্টা থেকে দাঁড়িয়ে আছি। কোনো অসুখ হলে আগে থেকেই আসি।
মোটামুটি চিকিৎসা পাওয়া যায়। তাই এখানে এসছি। বাইরে গেলে বেশি টাকা লাগবে। কোথায় পাব? বাধ্য হয়ে এখানে এসেছি। কষ্ট হচ্ছে মেনে নিতে হচ্ছে। লোক থাকলে তাড়াতাড়ি সেবা পেতাম। প্যাথলজি বিভাগে শ্যামপুরের রোমান বলেন, ‘কাছে হাসপাতাল। তাই কোনো অসুখ হলে চলে আসি। হয়রানির স্বীকার আগে হতো। বর্তমানে কমে গেছে। তবে রিপোর্ট অনেক সময় দেরি হয়।
নিচতলায় মেডিসিন ওয়ার্ডের সামনে জুরাইনের নুর হোসেন ও সেনিয়া আক্তার বলেন, ‘ছোটকাল থেকে এখানে আসা। ডাক্তারের রুমে কোনো সিরিয়াল নেই। যে যারমতো ডাক্তারের রুমে ঢুকে যাচ্ছে। যাদের পরিচিত আছে, বা স্টাফ তারা ঢুকে যাচ্ছে। কিছু সমস্যা হচ্ছে। তাই সিকিউরি বৃদ্ধি করা দরকার। এ বিল্ডিং এ মেডিসিন ওয়ার্ডে একই চিত্র দেখা যায়। রোগিদের চাপ রয়েছে।
ভোগান্তির ব্যাপারে একই খেদোক্তি প্রকাশ করেন মহিলা ওয়োর্ডে নসিমন বেগম। তিনি বলেন, ‘এই যে দেখেন অপেক্ষা করছি। কখন ডাক্তারের দেখা পাব বলতে পারছি না। একটা বের হয় তো ২টা ঢুকে। পিছন থেকে আগেই চলে যায়। যাদের পরিচিত আছে বা হাসপাতালের লোকের আগে ঢুইক্যা যাচ্ছে।’ তবে এই ভবনে কার্ডিওলজি বিভাগে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। রোগি কম। তাই অন্য ওয়ার্ডের মতো ভিড় নেই। ডাক্তাররা বলছেন, ‘অন্য বিভাগে কি অবস্থা বলতে পারব না। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী আমাদের সব ডাক্তার আছেন। ভালোমতো চিকিৎসা দিতে পারছি।
তবে ভিন্ন চিত্র দেখা যায় ১নং মেইন বিল্ডিং এর নিচতলায় ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবেটিশন বিভাগে। দুর্ঘটনা বা অন্য কারণে কারো কোন কিছু কেটে বা ফেটে গেলে আসছেন এখানে। রোগিদের দীর্ঘ লাইন। তারা বলছেন, বিপদে পড়লে আসতেই হয়। এ সময় নবাবগঞ্জ থেকে আসা রজব আলী নামে একজন বলেন, ‘আমার মাকে নিয়ে এসেছি। সিটিস্ক্যান করতে হবে। বয়স্ক মানুষ। তাই বেশি সময় লাগছে।’ এই ভবনের নিচতলায় জরুরি বিভাগ, ক্যাজুয়ালিটি বিভাগ, ২য় তলায় আল্ট্রাসনোগ্রাম, এক্সরে করা হয়। সেখানেও রোগিদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বলে রোগিরা জানান। একটু এদিক-ওদিক হলেই পরের দিন আসতে হচ্ছে তাদের।
জেডএ/এএস