‘হাসপাতালে এত মানুষ, এদের মধ্যে চোরও আছে’
গেট দিয়ে ঢোকার মুখেই একটা রুম। ঢুকতে হাতের ডানে। দেখতে তথ্য কেন্দ্রের মতো। কিন্তু কোনো মানুষ নাই। ভেতরে উঁকি দিতেই দেখা গেল প্রস্রাবের তীব্র গন্ধ ও নোংরা। পাশেই লেখা আছে, ‘এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ’।
এটি রাজধানীর শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিত্র। শুধুমাত্র প্রবেশমুখেই এই অবস্থা। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল অবস্থা আরও খারাপ।
হাসপাতাল হলেও সিগারেটের দোকান বসতে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় একটি চক্রকে টাকা দিয়ে বসতে পেরেছেন বলে জানান দোকানিরাই। দেদারছে চা-সিগারেট বিক্রি চলছে। এই চিত্র খোদ জরুরি বিভাগের সামনেই। এ ছাড়া পুরো হাসপাতাল কম্পাউন্ডেই রয়েছে এ ধরনের দোকানপাটের অস্তিত্ব।
প্রচণ্ড ভিড় ও গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা রোগীদের এবং সঙ্গে আসা স্বজনদের। আছে দালালের উৎপাত। এ ছাড়া হাসপাতালে নিম্নপদে চাকরি করা সবাই দালালি করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
হাসপাতালে দালালের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন পরিচালক ডা. খলিলুর রহমানও। ঢাকাপ্রকাশ-কে তিনি বলেন, দালাল আছে। তবে আমরা পরিচয় নিশ্চিত হতে পারলেই ব্যবস্থা নিই।
অবৈধ দোকানপাটের বিষয়টি অস্বীকার করলেন ডা. খলিলুর রহমান। তার দাবি, এ ধরনের দোকানপাট নাই। আজও (২৮ আগস্ট, রবিবার) উচ্ছেদ করেছেন।
তবে তার সঙ্গে কথা বলার পরও দেখ গেল দোকানগুলো বহাল তবিয়তেই আছে। তার দাবির সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল পাওয়া গেল না।
হাসপাতাল কম্পাউন্ডে দেখা গেল নেশাখোরদের আনাগোনা। ডান্ডি থেকে শুরু করে হেরোইন আসক্তরা হাসপাতালের ঘোরাফেরা করছে। হাসপাতালে রোগীদের মোবাইলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র যে চুরি হয় তার একটা অংশ এই নেশাখোররা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘হাসপাতালে এত মানুষজন। এদের মধ্যে চোরও আছে। মানুষজনকে সতর্ক থাকতে হবে। এ ছাড়া চুরি গেলে মানুষ পুলিশের কাছে যায় না। আমরা পরামর্শ দেই জিডি করার। তাহলে পুলিশ এজহার ধরে তদন্ত করে।’
নেশাখোরদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেই ক্ষেপে যান ডা. খলিলুর রহমান। উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, আমাদের দায়িত্ব রোগী দেখা। হেরোইনচি ধরা না। এ ধরনের প্রশ্ন করবেন না। এ সময় তিনি এ প্রতিবেদকের দিকে তেড়ে এসে ক্যামেরা বন্ধ করতে উদ্যাত হন।
দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীদের ভোগান্তি দেখা গেল। এসব রোগী যেন অথৈ সাগরে পড়েছেন এমন মনে হলো। তারা বুঝতে পারছেন না কোথায় যাবেন।
জামাল নামের একজন বললেন, আগারগাঁও থেকে এসেছি। এখন থেকে চারবার আমার রোগী দেখানো হয়েছে। রোগীর কানে সমস্যা। তৃতীয়বারে আমারে এক্সরে দিয়েছে। করিয়েছি। এখন আবার গেলে এক্সরে রিপোর্ট দেখে বলছে অপারেশন করতে হবে। এজন্য আবারও কিছু পরীক্ষা দিয়েছে। ভোগান্তির মধ্যেই তো আছি।
নোয়াখালী থেকে শনিবার (২৭ আগস্ট) রাতে রোগী নিয়ে এসেছেন সুজন। সঙ্গে তার বোনও আছে। ক্যানটিন ভাত খেয়ে বের হয়ে তার বোন দেখেন ব্যাগে মোবাইল ফোন নেই। ক্যান্টিনের ম্যানেজারকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখাতে বলেছেন। ম্যানেজার সহযোগিতা তো করেনইনি উল্টো বুঝিয়ে দিয়েছেন এই ফুটেজ আমেরিকা থেকে দেখতে হবে। এখানে হবে না।
সুজন এই প্রতিবেদকের সহযোগিতা চান জিডি করার জন্য। তাকে জিডি করার পরামর্শ দিলে যান শের-ই-বাংলা নগর থানায়।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সুজন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ক্যানটিনে খেতে গেছি। সঙ্গে আমার বোন ছিল। আমি খাওয়া শেষে বোনকে নিয়ে বাইরে আসতেই দেখি তার ব্যাগ খোলা। মোবাইল নাই। ফোন দিলাম ওই নাম্বারে। দেখি বন্ধ। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখতে চাইলাম ক্যানটিন ম্যানেজারের কাছে। তিনি বললেন, এটা দেখতে হবে আমেরিকা থেকে। এখান থেকে দেখা সম্ভব নয়।
হাসপাতালে কর্তব্যরত একজন পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। উনি বললেন, ‘হাসপাতাল যেই থানার আন্ডারে সেই থানায় একটা জিডি করেন।’
রোগীদের ভোগান্তি প্রসঙ্গে সুজন বলেন, ভোগান্তি দেখছি। এখান থেকে ওখানে পাঠায়। এরকম করতেই থাকে। ১ তলা, ৫ তলা, ৩ তলা করতে করতেই দিন পার হয়ে যায়। আর শুধু টেস্ট দেয়। এই টেস্ট সেই টেস্ট। হয়রানি আর হয়রানি।
হাসপাতালে যে চোরের উপদ্রব রয়েছে সেটা রবিবার (২৮ আগস্ট) বেলা ১১টায় দেখা গেল। আনসার সদস্যরা একজন চোরকে ধরেছেন। তারপর তাকে পুলিশে দেওয়া হলো।
এ প্রসঙ্গে উপস্থিত আনসার সদস্যরা বলেন, এত চোর ধরি তারপরও এদের সঙ্গে পারি না। টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে এরা পকেট মারে।
বরিশাল থেকে রোগী নিয়ে আসা সজিব হোসেন বলেন, আমাদের স্ট্রোক করা একজন রোগী ছিলেন। আমার খালু। নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল থেকে রেফার করেছে। এখানে কয়েক দফা ফিজিক্যাল মেডিসিনের ডাক্তারের কাছে নিয়েছি। ওখান থেকে ভর্তিরুমে নিয়েছি। তারপর ফিজিওথেরাপি বিভাগে নিলাম। ওখান থেকে কিছু ব্যায়াম দেখিয়ে দিলো। বলল, ইনশাআল্লাহ ভালো হয়ে যাবে। আর কিছু করল না।
আরইউ/এমএমএ/