প্রশ্ন করতেই তেড়ে আসেন পরিচালক
নেশাখোরদের আনাগোনা, রোগীদের ভোগান্তি, অবৈধ দোকানপাট, দালালদের দৌরাত্ম্য, আইসিইউ তালাবদ্ধ এবং এনআইসিইউ ব্যবহার করা হচ্ছে গুদাম ঘর হিসেবে। এই চিত্র রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের।
এসব নিয়ে প্রশ্ন করতেই রেগে যান হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান। ক্যামেরায় বন্ধ করতে তেড়ে আসেন বারবার।
রবিবার (২৮ আগস্ট) তিন ঘণ্টা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢাকাপ্রকাশ-এর টিম সরেজমিনে এমনটি ঘটে। এ সময় নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও ভোগান্তির চিত্র দেখা যায়। এসব বিষয়ে জানতে সবশেষে যাওয়া হয় হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার জন্য।
হেরোইনখোররা হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ঘোরাফেরা করে এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন কি না এমন প্রশ্ন করতেই ক্ষেপে যান পরিচালক। তিনি উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, ‘হেরোইন-খোর দেখার দায়িত্ব কিন্তু আমার না। এটা আপনাদেরও যেমন দায়িত্ব আছে তেমনি আনসার সদস্যরাও দেখছেন।’
হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে হাসপাতালের সার্বিক সব বিষয় দেখার দায়িত্ব আপনার কি না এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, কেউ যদি ‘হেরোইনচি’ দেখাতে পারেন তাহলে আমরা আইনের আওতায় আনতে পারি। ‘হেরোইনচি’কে সেটা খুঁজে বেরানোর দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের না।
এগুলো দেখার দায়িত্ব সাংবাদিকদেরও এমনটা দাবি করে পরিচালক বলেন, ‘এটা তো আপনাদের মাথার মধ্যে থাকার কথা যে, হেরোইনচি খোঁজার দায়িত্ব কি হাসপাতালের? আমরা রোগী খুঁজি। হেরোইনচি নয়। এ ধরনের প্রশ্ন করা কিন্তু অবান্তর। হেরোইনচির প্রশ্ন কেন আমার কাছে করবেন?’ এরপর তিনি রেগে যান। চিৎকার করতে করতে বলতে থাকেন, এ ধরনের প্রশ্ন করবেন না।
হাসপাতাল কম্পাউন্ডে অবৈধ দোকানপাট সম্পর্কিত প্রশ্নেও আপত্তি করেন পরিচালক। বলেন, ‘কোথায় দোকানপাট দেখেছেন? আজও দেখেছেন না ভেঙেছি? এইটার নিউজ করেছেন আপনারা? এটার নিউজ আগে করেন। তারপর আমার কাছে আসেন। যান আগে দেখে আসেন কোনো দোকানপাট আছে কি না। তারপর প্রশ্ন করেন। আসল খবর নেবেন না। শুধু কোথায় নেগেটিভ কথা আছে সেগুলো খোঁজেন।’
ক্ষেপে গিয়ে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-এর প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ’নেগেটিভের জন্য আপনাকে ইয়ে করা হয়েছে? প্লিজ আপনাদের রোগী বিষয়ক কোনো কথা থাকলে বলেন।’
এ সময় আরও প্রশ্ন করতে চাইলে পরিচালক আরও ক্ষেপে গিয়ে বলেন, আর কোনো প্রশ্ন করবেন না।
এক পর্যায়ে এ প্রতিবেদকের দিকে তেড়ে এসে ক্যামেরা বন্ধ করতে বলেন এবং হাত দিয়ে ক্যামেরায় ধাক্কা দিয়ে বলতে থাকেন, ‘আপনি আমার পারমিশন ছাড়া ভিডিও করতে পারবেন না। আমার পারমিশন ছাড়া কোনো কথা বলতে পারবেন না। আপনি এসেছেন এখানে ই করতে। হেরোইনচির দায়িত্ব কি ডাক্তারদের? এমন প্রশ্নর করবেন কেন?’
এ পর্যায়ে দ্বিতীয়বার ক্যামেরায় ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করতে উদ্যত হন পরিচালক। বলতে থাকেন, এটা কি ধরনের কথা। হেরোইনচি নিয়ে প্রশ্ন করবে? আমি এগুলো ধরব?
হাসপাতালে রোগীদের টাকা-পয়সা থেকে মোবাইল ফোন নিয়মিত চুরি যাওয়া প্রসঙ্গে পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘শোনেন, হাসপাতালে নানা ধরনের লোকজন আসে। ফলে আপনি ধরতেই পারেন যেখানে লোকের আনাগোনা সেখানে চোরেরও আনাগোনা থাকবে। আমাদের আনসারদের এ রকম নির্দেশনা দেওয়া আছে যে যদি কোনো চোরকে চিনতে পারে তাহলে যেন আইনের আওতায় আনে। প্রায় প্রনিয়তই এখানে চুরি হচ্ছে।’
পরিচালকের দাবি, মানুষেরই এখানে সতর্ক থাকতে হবে। ধরেন চুরি হলে সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ক্যামেরার ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করি। এভাবে আসলে খুব বেশি ইফেক্টিভ হয়েছে বলে মনে হয় না।
পরিচালক বলেন, ‘যার চুরি গেছে সে যদি আইনের আওতায় গিয়ে জিডি করে তখন কিন্তু পুলিশ তদন্ত করে। তার আগে কিন্তু কেউ দায়িত্ব নেয় না। আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা তো কেবল সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আনসারদের দায়িত্ব দিতে পারি। কিন্তু আপনার মোবাইল হারালে আপনার তো একটা আইনগত দিক আছে। পুলিশের কাছে জিডি করেন। পুলিশ কিন্তু তখন এজহার নিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু চুরির শিকার কেউই পুলিশের কাছে যায় না। পুলিশের কাছে গেলে কিন্তু আমাদের জন্য সুবিধা হয়। কারণ, আমাদের ওই পরিমাণ আনসার নাই যে মানুষকে জনে জনে সার্চ করবে।’
দূরদূরান্ত থেকে যেসব রোগী আসে তারা কোন দিকনির্দেশনা না পেয়ে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায় এমন অভিযোগের জবাবে পরিচালক বলেন, ‘আমাদের অনুসন্ধান ডেস্ক আছে। সেখানে জিজ্ঞাসা করেন। তাদের বসিয়েই রেখেছি এসব দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য। আপনি যদি দালালের কাছে যান তাহলে তো হবে না।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই হাসপাতালে দালাল আছে। দালাল তো সারাক্ষণ হাঁটতেই থাকে। আমরা ব্যবস্থা নিই। দালাল চিহ্নিত করে দেন আপনারা। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব। এ ব্যাপারে আমরা জিরো টলারেন্সে।’
এনআইসিউ রুমকে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা প্রসঙ্গে পরিচালক বলেন, ’এনআইসিউ চালু হয়নি। অনেক আগের একটা প্ল্যান ছিল। আমারও আগের পরিচালকের সময় থেকেই এমন পরিকল্পনা ছিল। বর্তমানে এনআইসিইউ নাই। রুমটা ঠিক করা হয়েছিল। এনআইসিইউ চালু করতে হলে অনেক কিছু লাগে। রুমটাকে ঠিক করা হয়েছিল যে এনআইসিইউ হবে।’
যেহেতু ওটা করা হয়নি তাই এখন আমাদের যে আইসিইউ যেটা ৩০ বেডের হচ্ছে…আইসিইউয়ের জন্য কিন্তু একটা বড় স্টোর লাগে। কারণ, আইসিইউয়ের জিনিসপত্র যেমন ভেন্টিলেটর, আইসিইউ বেড সবসময় রিজার্ভ রাখতে হয়…তো আমাদের স্টোর ছিল না। এখন আমরা একটা বড় স্টোর তৈরি করে ফেলেছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এনআইসিইউ কখনোই ছিল না এই হাসপাতালে। তবে এখন ১০ বেডের আইসিইউ চালু আছে। ভবিষ্যতে আইসিইউ ৩০ বেডের হবে। আরও ২০ বেডের কাজ শেষ পর্যায়ে। এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) আন্ডারে হচ্ছে। ডব্লিউএইচও ইতিমধ্যে টেন্ডার করেছে। মালামাল আসার কথা ছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সেই মালামাল আসেনি। তারা আরও দুই মাস সময় চেয়েছে।’
এরপর লাগবে জনবল। আমরা জনবলও চেয়েছি। কারণ, আইসিইউ চালাতে গেলে জনবল লাগে। প্রশিক্ষিত জনবল, যোগ করেন তিনি।
আরইউ/এমএমএ/