দালাল-সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি পঙ্গু হাসপাতাল
রাজধানী ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) এখনো দালাল-সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি বলে দাবি করেছেন রোগীরা। সাধারণ রোগীদের অভিযোগ, যেকোনো রিপোর্ট করতে গেলে দালালরা বিভিন্নভাবে বিরক্ত করে।
রোগীদের অভিযোগ, দালালরা জানায় পঙ্গু হাসপাতালের টেস্ট রিপোর্ট ভালো হয় না। এজন্য তারা আশেপাশের বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে টানাটানি করে। এসব বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, রোগীর সঙ্গে থাকা লোকজন যদি সতর্ক হয়, তাহলে দালালদের খপ্পর থেকে কিছুটা রেহাই পাবেন তারা।
রোগীদের অভিযোগ, জরুরি ও বহির্বিভাগের গেট থেকেই ভর্তি পযর্ন্ত শুরু হয় রোগীদের ভোগান্তি। রবিবার (২৮ আগস্ট) সকাল থেকে দুপুর পযর্ন্ত রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক (পঙ্গু) হাসপাতালে ঘুরে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ সময় আজগর আলী নামের এক রোগী বলেন, ‘আমি তিন মাস আগে একটি ভবনের ছাদ থেকে পড়ে হাত ভেঙে যায়। এরপর এখানে ডা. শাহিন সুলতানাকে দেখাই। আমার হাত ঠিক হতে তিনি আমাকে ৬ মাস সময় বেধে দেন। আমি এই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। পরে ডা. রিয়াজের সহকারীর খপ্পরে পড়ে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পঙ্গু থেকে ছাড়পত্র নিই। আমি পরে বুঝতে পারলাম প্রতারণার শিকার হয়েছি। এরপর আমি আবার ডা. শাহিন সুলতানাকে দেখাই এবং বর্তমান ভালো আছি।’
মটরসাইকেলে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে গাজিপুর জেলার কাশিমপুর এলাকা থেকে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসছেন সাগর হোসেন। এ সময় সাগর হোসেনের বাবা বিপুল আলী বলেন, অ্যাম্বুলেন্সে আসার সময় গেটের বাইরে থেকে রাজু নামের এক দালাল আমাদের বলেন, প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী নিয়ে যেতে, আমরা বলেছি পঙ্গু হাসপাতালেই রোগীর চিকিৎসা করব।’
মহাখালী সাততলা বস্তি থেকে রফিক নামের এক ব্যক্তি রোগী নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি বলেন, দালাল-সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি পঙ্গু হাসপাতাল, দেখার কেউ নেই। এখানে স্টাফরা রোগীদের সহযোগিতা করে না।’
এ সময় শ্যামপুরের তাসলিমা নামের এক নারী অভিযোগ করে বলেন, রোগী ভর্ভির সময় নানান সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ধাপে ধাপে টাকা দিতে হয় অন্যথায় স্টাফ বা ট্রলিম্যানরা রোগী ধরতে চায় না।
ফরিদপুর থেকে রোগী নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ফাতেমা বেগম নামের আরেক নারী। তিনি অভিযোগ করেন, রোগীর প্রয়োজনে সঠিক সময়ে পাওয়া যায় না ডাক্তার, নার্স, ওষুধসহ সব কিছুই বাইরে থেকে কিনে নিতে হয়। প্রাইভেট হাসপাতালের মতো পঙ্গু হাসপাতাল। তার মধ্যে তো আছেই দালালদের দৌরাত্ম্য।
তিনি বলেন, ‘রাজধানী ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল (পঙ্গু হাসপাতাল) যেন এখনো দালাল সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।’
জানা যায়, বখশিশ ছাড়া কোনো কাজ হচ্ছে না পঙ্গু হাসপাতালে। চিকিৎসা সেবা প্রদানের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকলেও অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেটের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন রোগীরা। হাসপাতালে জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে কেবিন, ওয়ার্ড, প্যাথলজি বিভাগ, অপারেশন থিয়েটারসহ বহির্বিভাগ পর্যন্ত এ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। পঙ্গু হাসপাতালে টাকা ছাড়া কোনো রোগী ওয়ার্ডবয় ও আয়াদের কাছ থেকে ন্যূনতম সেবা পান না বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ সিন্ডিকেটের কাছে ডাক্তাররা পর্যন্ত অনেক সময় অসহায় হয়ে পড়েন। হাসপাতালের একাধিক নার্স ও ওয়ার্ডবয় জানিয়েছেন, দালালদের আগে দেখলে চেনা যেত। বর্তমানে তারা সিন্ডিকেটের যোগসাজশে দর্শনার্থীদের সঙ্গে এমনভাবে মিশে থাকে যে, দেখলে চেনার কোনো উপায় নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালকের সহকারী মোহাম্মাদ জাহিদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সিন্ডিকেটের চোখের ইশারায় রোগীদের টার্গেট করে। যেসব রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বহন করার সামর্থ্য আছে সেসব রোগী এবং তাদের স্বজনদের কাছে গিয়ে দালালরা পঙ্গু হাসপাতাল সম্পর্কে বিভিন্ন খারাপ ধারণা দিতে থাকে। তারা ওই সব রোগীদের অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে চাই। সবাই সর্তক হলে এসব কমে আসবে। আমাদের সেবার মান বেড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের (পঙ্গু) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল গনি মোল্লাহ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আগের মতো এখন আর পঙ্গু হাসপাতালে দালাল চক্রের সদস্যরা রোগীদের বিরক্ত করতে পারে না। আমরা পরিচ্ছন্ন পঙ্গু হাসপাতাল গড়ার চেষ্টা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে কিছু কিছু সময় রোগীদের ভুলের কারণে তারা ভাঙা হাত-পা দ্রুত ভালো করার আশার দালালের খপ্পরে পড়ে, ও অন্য প্রইভেট হাসপাতালে চলে যায়। পরে তারা বিভিন্ন ভোগান্তির শিকার হয় এবং পঙ্গু হাসপাতালে দোষ দেয়।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের মানুষ ঘোরাঘুরি করে। দেশের প্রতিটা সরকারি হাসপাতালে ভালো চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, রোগীরা যদি এসব বিষয়ে একটু সর্তক হয় তাহলে দালালের খপ্প থেকে তারা দূরে থাকবে।’
রোগিদের অভিযোগ দালাল-সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতাল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের মধ্যে এখন কোনো দালাল নেই। কেউ দালালি করলে আমাদের আনছার সদস্যরা তাদের আটক করে থানায় দেয়। যদি গেটের বাইরে থেকে কেউ দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে তাহলে আমাদের কী করার আছে বলুন?’
কেএম/এমএমএ/