স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার চান বিশেষজ্ঞরা
স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠির কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে সরকার ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রেখেছে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। যা চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের তুলনায় চার হাজার ১৩২ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এর একটা বড় অংশ স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে ব্যবহার করা হবে।
আটটি বিভাগীয় হাসপাতালে ১০০ শয্যার ক্যান্সার ইউনিট স্থাপন প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০ শয্যার এবং জেলা সদর হাসপাতালে ১০ শয্যার ডায়ারাইসিস ইউনিট স্থাপনের প্রকল্প চলমান আছে। জেলা পর্যায় ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ৫ হাজার শয্যার আধুনিক বিশ্বমানের হাসপাতালে রূপান্তর করার ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রকল্পসহ এরকম আরও অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যে স্বাস্থ্য শিক্ষা খাতের উন্নয়নের কথাও বলেছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, সর্বস্তুরের জনগণকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় এনে এমডিজি লক্ষ্য অর্জনে তার সরকার সফলতা দেখিয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের পরিমান বাড়লেও সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা নিয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রীর কোন সুষ্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ আগামী বাজেটেও স্বাস্থ্যবীমা অবহেলিত থেকে গেছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যখাতের এই বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। তারপরও যেটি বরাদ্দ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে সেটির যেন যথাযথ ব্যবহার হয়। তারা বলছেন, অতীত অভিজ্ঞতা বলছে,বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে যে পরিমান বরাদ্দ গিয়েছে সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার হয়নি। ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিল। প্রান্তিক জনগোষ্ঠি স্বাস্থ্যসেবা থেকে বরাবরই বঞ্চিত। শুধুমাত্র অনিয়ম দুর্নীতি, লুটপাট এবং অব্যবস্থাপনার কারণে বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের সুফল পাননি বেশিরভাগ প্রান্তিকজনগোষ্ঠি।
সরকার বরাদ্দ দিলেও সেটি নানানকারণে প্রান্তিকজনগোষ্ঠির একটা বড় অংশের কাছে পৌঁছেনি। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে সেটিও যদি প্রান্তিকজিনগোষ্ঠির কাছে যথাযথভাবে না পৌঁছে তাহলে এর সুফল পাওয়া যাবে না- এমনটাই মনে করছেন স্বাস্থ্যখাতের বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলছেন, স্বাস্থ্য বাজেট যাই বাড়ুক এটা যেন প্রোফারলি ব্যবহার করা হয়। এর আগেও স্বাস্থ্য বাজেট যা ছিল এর পুরো টাকা কিন্তু ব্যবহার হয় নাই। এই টাকা ফেরত গেছে। শুধু তাই না, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা চুরি-চামারি এসব অভিযোগের কিন্তু শেষ নাই। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বাজেটে বরাদ্দ যাই বাড়ানো হয়েছে সেটির যেন প্রোফারলি, প্রত্যেকটা টাকা যেন সুন্দরভাবে , ভালোভাবে, সুস্ঠুভাবে প্রকৃত কাজে যেন ব্যবহার করা হয়। তাহলে জনগণ যতটুকেই পাক এর সুযোগ সুবিধা পাবে। সুফল ভোগ করতে পারবে। আর যদি প্রোফারলি ব্যবহৃত না হয় তাহলে তো বেশি বাজেট দিয়ে লাভ হচ্ছে না। এবিষয়টির উপর বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।
ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, আমি করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠির কাছে যেন ঠিকমত পৌঁছে সেদিকে নজর রাখা হয়। আর যেন কোনক্রমেই চুরি চামারি, দুর্নীতির অভিযোগ না উঠে। টাকার যেন অপপ্রোয়োগ না হয়। এব্যাপারটা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতিটা টোটালি বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাকে আরও ঢেলে সাজাতে হবে। এই কাজগুলো যদি করা হয় তাহলে জনগণ এর সুফল হবে। এর আগে বরাদ্দের টাকা ফেরত গেছে, আবার যতটুকু ব্যবহার হয়েছে এরমধ্যেও অভিযোগের শেষ নাই জনগণের। এখানে নজর দিতে হবে। এর সুফল যেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠি, নিম্ন আয়ের মানুষ, দরিদ্র মানুষ এরসুফল ভোগ করতে পারে।
তিনি বলেন, এই দুর্নীতি, অনিয়মন বন্ধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। যোগ্য লোককে যোগ্য জায়গায় বসাতে হবে। যোগ্য লোক যদি যোগ্য জায়গায় না বসে তাহলে তো এর ব্যবহার করবে না। এর আগে দরকার সর্বস্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সবকিছুকে সুন্দরভাবে সাজানো। তাহলে এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে। প্রয়োজনে এটা মনিটর করতে হবে,ফলোআপ করতে হবে, ভিজিটর টিম করতে হবে। তাহলে এর সুফল পাবে।
স্বাস্থ্যবীমার বিষয়ে এই বিষয়ে এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, স্বাস্থ্যবীমার দাবি আমি কয়েক বছর ধরে বার বার করে আসছি। বহু আগে থেকে বলে আসছি। স্বাস্থ্যবীমা অন্তত শুরু করা হোক। কারণ গরিব লোক, নিম্নআয়ের লোক, দরিদ্র লোক অনেকেরই স্বাস্থ্য বাজেটে কোন টাকা থাকে না। এসব মানুষ যখন সিরিয়াস কোন জটিল অবস্থায় পড়ে তখন আর চিকিৎসা চালাতে পারে না। যদি চালাতে পারেও তখন দেখা যায় তার সর্বস্ব জমিজমা বিক্রি করে চিকিৎসা চালাচ্ছে। তাও সামাল দিতে পারে না। আবার সর্বস্ব বিক্রি করে যদি চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে থাকে বা মারা যায় তখন তার পরিবার কিন্তু পথে বসে যায়।
এই জন্যই যদি বীমার আওতায় আনা হয়, অল্প অল্প করে যদি শুরু করা যায় তাহলে কিন্তু মানুষের চিকিৎসা বিশেষ করে যারা ক্রনিক রোগে ভুগেন যেমন ডায়বেটিস, প্রেসার, কিডনী রোগ, ক্যান্সার রোগি তাদের তো অনেকদিন চিকিৎসা চালাতে হয়। তাদের জন্য এই বীমা অনেকটা সুফল বয়ে আনত বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, এটা করা উচিত। যদি করা নাও থাকে তাহলে অন্তত ভবিষ্যতে এটা করার চিন্তা মাথায় রাখতে হবে। যদি পরিকল্পনা না থাকে তাহলে চালু করবে কোথা থেকে। এক কথায় এটা চালু করতে হবে। স্বল্প পরিসরে হোক, এলাকাভিত্তিক হোক শুরু করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অিধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রথমত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের ১০ শতাংশ থাকলে ভালো হয়। তাতে ধরেন আসে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা। এখন ৩৬ হাজার কোটি টাকা আছে এবং চলতি বছরের তুলনায় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।
তিনি বলেন, মেডিকেল শিক্ষার ক্ষেত্রে আরও বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। যাই হোক সরকারের সক্ষমতা এবং করোনার কারণে যে বাজেট হয়েছে এটা যেন প্রোফার ইউটিলাইজ করা যায় এদিকে নজর দিতে হবে। সেক্ষেত্রে নতুন মেডিকেল, আন্ডার গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট যারা পড়াশোনা করবে তাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে যত সরঞ্জাম আছে তার সঙ্গে যাতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় নতুন পোস্ট তৈরি করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসক নিয়োগ এবং ঢাকার আশপাশে থেকে শুরু করে ভোলার মনপুরা সব জায়গায় যেন একই ধরণের চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়, নিরাপত্তা দেওয়া হয়। সেখানে আমার মনে হয়, বাজেট বরাদ্দ যখন চূড়ান্ত হবে আমরা আশা করছি যে, আরেকটু বাড়লে ভালো হয়। চার হাজার কোটি টাকা বেড়েছে, সেটা যদি দশ হাজার কোটি টাকা বাড়ে তাহলে আমার মনে হয় ভালো হবে।
তিনি বলেন, দেখেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠি পর্যন্ত সেবা পৌছানোর চেষ্টা যে হয়না তা না। কিন্তু সবক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগণ শতভাগ পায়না। আমার মনে হয়, প্রোফারলি ইউটিলাইজেশন, ব্যবস্থপানা এবং সক্ষমতাটা আরেকটু বাড়ানোর ক্ষেত্রে ট্রেনিং প্রোগ্রামসহ যারা ব্যবস্থাপনায় থাকে তাদেরকে আরও সতর্ক হওয়া দরকার।
স্বাস্থ্যবীমার বিষয়ে বিএসএমএমইউ এর উপাচার্য বলেন,স্বাস্থ্যবীমা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে পাইলটিং করে কিছু কাজ করা হচ্ছিল। যেমন কালিহাতিতে একটা শুরু হয়েছিল। আস্তে আস্তে স্বাস্থ্যবীমাটা শুরু করা যেতে পারে। এটা এবারই করা যেতে পারে। যেমন ধরেন আমাদের যারা সরকারি চাকরিজীবী তারা যে টাকাটা মেডিকেল ভাতা হিসেবে পায় ওটা যদি সরকার জমা রাখে আর যারা মোবাইল ব্যবহার করে সারা দেশে তারা যদি বছরে এক হাজার টাকা জমা দেয় তাহলে যে অর্থটা আসবে সেটা দিয়েও আমরা কিন্তু স্বাস্থ্যবীমাটা চালু করতে পারি। আমার মনে হয়, এই বাজেটেই যদি সরকার এ ধরণের একটা প্রস্তাবনা চিন্তাভাবনা করে তাহলে এবার থেকেই আমরা স্বাস্থ্যবীমা শুরু করা যাবে।
এনএইচবি/এএজেড