টুটুলের স্বপ্নের সিনেমা ‘কালবেলা’ মুক্তি পাচ্ছে শুক্রবার
তার স্বপ্ন ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে একটা সিনেমা বানাবেন। কাজও শুরু করেছিলেন। আর মাত্র দুই দিন কাজ করতে পারলেই শেষ হতো শুটিং পর্ব। কিন্তু তার আগেই ২০১৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর মারা যান বরেণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুল। তারপর থেকেই সবার চিন্তা, সিনেমাটার কী হবে? টুটুলের মৃত্যুর পর তার অসমাপ্ত কাজটা শেষ করার উদ্যোগ নেন পরিচালকের স্ত্রী মোবাশ্বেরা খানম। সঙ্গে ছিলেন দুই মেয়ে ঐশী আনাম ও অমৃতা আনাম। আনন্দের কথা, কাজটা তারা শেষও করেছেন এবং নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুলের স্বপ্নের চলচ্চিত্র ‘কালবেলা’ মুক্তি পাচ্ছে আগামীকাল শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর)।
টুটুলের মৃত্যুর ৩ বছর পর মুক্তি পেতে যাচ্ছে ‘কালবেলা’। এ চলচ্চিত্র ১০ ডিসেম্বর ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্স ও ব্লকবাস্টার সিনেমা এবং চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে।
এ উপলক্ষে ছবিটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। বুধবার (৮ ডিসেম্বর) বিকেল ৫টায় অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ নির্মাতা মসিহউদ্দিন শাকের, মানবধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ। সেখানে তৈরি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ।
উদ্বোধনী প্রদর্শনী শেষে আগত অতিথিরা ছবিটির প্রশংসা করেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘সাধারণত এ ধরনের ছবিতে এক ধরনের স্থুলতা থাকে, কতগুলো তথাকথিত ব্যাপার থাকে। ওই বিভৎস জিনিসগুলো থাকে। সেগুলো না দেখিয়ে একটি মেয়ের জীবনে এ যুদ্ধ কতটা প্রভাব ফেলেছিলো, কীভাবে সে সংগ্রাম করেছিলো তা শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এক কথায় এ মেয়ে যেন আমাদের একাত্তরের বাংলাদেশ।’
নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, টুটুল আমার বন্ধু সেই ১৯৬৮ সাল থেকে। আমরা এক সঙ্গে অনেকটা পথ হেঁটেছি। ছবিতে যেমনটা দেখানো হয়েছে, একদল মানুষ পায়ে হেঁটে ভারত চলে গিয়েছিল। তেমনি আমরাও ভারতে গিয়েছিলাম, যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। বারবারই আমার সে সব স্মৃতি মনে পড়ছিলো। আমার মনে হয় আমাদের তরুণদের ছবিটা দেখা উচিত। তাদের জানা উচিত কী রকম নিরন্তন যাত্রার মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছিলাম সে সময়ে।
সাইদুল আনাম টুটুলের মৃত্যুর পর ২০১৯-এ চলচ্চিত্রটির প্রযোজক ও তার সহধর্মিনী অধ্যাপক মোবাশ্বেরা খানমের নেতৃত্বে শুরু হয় 'কালবেলা’র অসমাপ্ত কাজ। তারা ২০২০-এ এসে ছবিটির সকল কাজ শেষ করেন। তখন দেশে করোনা মহামারী দেখা দিলে ছবিটির মুক্তি আটকে যায়।
উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন মোবাশ্বেরা খানম। কান্না চেপে রেখে তিনি বলেন, আমি টুটুলের মতো করে বানাতে পারিনি৷ সেটা সম্ভব নয়। আমরা চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধের পাকিস্তানের প্রভাব এই দেশে পড়েছে তা দেখানো হয়েছে।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে সরকারি অনুদান পায় ‘কালকেলা’। শুটিং শুরু হয় ২০১৮ সালের জুলাইয়ে। পুরো অক্টোবর-নভেম্বর মাস শুটিং হয় খুলনা ও কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
'কালবেলা' ১৯৭-এ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে একজন নারীর সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে নির্মিত। এই চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে যুদ্ধকালীন সময়ে সাধারণ মানুষের আশ্রয়ের সন্ধানে অনিশ্চিত যাত্রা, অবরুদ্ধ শহরে কর্মজীবীদের বিপন্নতা, বিহারি ও পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম নৃশংসতা এবং যুদ্ধকালীন সামাজিক অস্থিরতা।
ছবিটির প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাহমিনা অথৈ এবং শিশির আহমেদ। অন্যান্য চরিত্রে রয়েছেন মাসুম বাশার, মিলি বাশার, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, লুৎফর রহমান জর্জ, শেখ মাহবুবুর রহমান, সায়কা আহমেদ, জুলফিকার চঞ্চল, কোহিনূর আলম, তানভীর মাসুদ প্রমুখ। চিত্রগ্রহণ করেছেন রিপন রহমান খান। সম্পাদনা করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সামির আহমেদ। ছবিটির সংগীত পরিচালনা করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ফরিদ আহমেদ। যিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে এ বছরের ১৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন।
সাইদুল আনাম টুটুলের জন্ম ১৯৫১ সালের ১ এপ্রিল একটি উদার প্রগতিশীল পরিবারে। শৈশব থেকে তিনি রেডিও এবং টেলিভিশনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং শরণার্থী শিবিরে সাংস্কৃতিক দলের কর্মী ছিলেন।
১৯৭৬ সালে পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে চলচ্চিত্র সম্পাদনায় ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ চলচ্চিত্র সম্পাদনার জন্য ১৯৭৯ সালে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ‘ঘুড্ডি’, ‘দহন’, ‘দুখাই’, ‘দীপু নাম্বার টু’সহ বেশ কিছু সিনেমা সম্পাদনা করেন তিনি।
এ ছাড়া তিনি বেশ কিছু টেলিভিশন নাটক নির্মাণ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘নাল পিরান’, ‘সুখের নোঙর’, ‘গল্পের শেষ আছে’, ‘দক্ষিণের ঘর’।
১৯৮২ সাল থেকে বিভিন্ন জাতীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট এবং জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন।
২০০০ সালে মুক্তি পায় তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘আধিয়ার’। তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত সিনেমাটি সব মহলে প্রশংসিত হয়।