‘নাইটিংগেল অব ইন্ডিয়া’
ভারতে তাকে বিবেচনা করা হয় সবচেয়ে মহান ও সম্মানিত শিল্পীদের একজন। তিনি এক হাজারের বেশি হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছেন ও ৩৬টির বেশি ভাষায় গেয়েছেন ভারতের সিনেমা ভুবনে।
তাকে বিশ্ববাসী ‘নাইটিংগেল অব ইন্ডিয়া’ নামে আদর করে ডাকে। দুঃখে গড়া গানের বুলবুলিটির জীবন। তার মা ছিলেন বাবা দীননাথের দ্বিতীয় স্ত্রী। মায়ের নাম শেবন্তি। জন্মের সময় তার নামটি রাখা হয়েছিল হেমা। তবে থিয়েটারের রচয়িতা বাবা পরে তার নামটি নিজের লেখা গীতনাট্য ‘ভাও বন্ধন’র লতিকা নামের একটি প্রিয় চরিত্রের নাম থেকে নিয়ে সংক্ষেপে রাখলেন ‘লতা’।
তিনি সবার বড়; ছোট চারটি ভাইবোন আছেন-মীনা খাদিকর, আশা ভোঁসলে, উষা মঙ্গেশকর, হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। দীননাথের প্রতিটি ছেলেমেয়েই গানের শিল্পভুবনে তাদের পেশাজীবনের জন্ম দিয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে লতার পর সবচেয়ে নাম করেছেন আশা। ভারতীয় হিন্দি ছবি ও নানা ভাষায় লতা মঙ্গেশকরের কাছাকাছি খ্যাতি পেয়েছেন। তাকেও হিন্দি ছবির ভুবনে সবচেয়ে সম্মানিত ও খ্যাতিমান গায়িকাদের অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৯৪২ সালে মঙ্গেশকর পরিবারের প্রভু, পারিবারিক বন্ধুও বটে বিনায়ক বাবা মারা যাওয়ার পর লতাকে তার পরিচালনার অধীনে নিয়ে আসেন। তাকে তিনি ওই বছরে একটি মাতৃভাষা এবং নিজের প্রদেশ মহারাষ্ট্রের মারাঠি ছবিতে গায়িকা ও অভিনেত্রী হিসেবে পেশাজীবন শুরু করতে সাহায্য করেন।
১৯৪৮ সালে বিনায়কের মৃত্যুর পর লতাকে কিংবদন্তী সঙ্গীত পরিচালক গোলাম হায়দার শিষ্যের মতো দেখভাল শুরু করেন। যখন বলিউডের সঙ্গীত পরিচালকদের একজন লতার কন্ঠকে ‘খুব বেশি চিকন’ বলে বাদ দিয়ে দিলেন; এটি প্রচলিত আছে যে, গোলাম হায়দার পরিচালক ও প্রযোজকদের সামনে বলেছিলেন যে, তারা এই মেয়েটির পায়ে পড়ে থেকে, তাকে ভিক্ষা করে ডেকে নিয়ে যাবেন তাদের ছবিতে গাইতে। তার এই ভবিষ্যতবাণী সত্যি হয়েছে।
ভারতের সিনেমা শিল্প সম্রাজ্যে লতা মঙ্গেশকর ইতিহাসের সবচেয়ে সফল প্লেব্যাক গায়কের একজন হয়ে উঠেছেন। ইতিহাস বদলে দেওয়া তার ছয় দশকের-১৯৫০ থেকে ২০১০ সালের গানের ক্যারিয়ারে অর্থের বিচারে সবচেয়ে সফল-আয়েগা আনেওয়ালা, আজ পেয়ার জেনা কি তামান্না, লাগ যা গালে, মোহে পাঙহাত পে, চলতে চলতে, কোরা কাগজ তাহ ইয়ে মন মেরা, রাইনা বেটি জায়ে, তেরে বিনা জিন্দাগী সে কোই, জাইয়া জালে ও কাভি খুশি কাভি গাম গানগুলো।
শামসাদ বেগম ও মোহামেম্মদ রাফির সঙ্গে একেবারে অল্প বয়সে সেই যে ক্যামেরার পেছনে গাওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছেন লতাজি, শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের খ্যাতি, যোগ্যতা ও সাফল্যের সঙ্গে গেয়েছেন উদিত নারায়ণ ও সনু নিগমের সঙ্গে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভারত ও বিশ্বের গায়ক-গায়িকা; গীতিকার, সুরকাররা তাকে সহযোগিতা করেছেন নিজের বয়সের একজন মানুষ মনে করে; অনন্য কন্ঠটির সাথী হতে।
এই কন্ঠ কেবল হলে হাসি, কান্না, তামাসা, অভিমান, রাগ ছড়ায়নি-স্বাধীন ভারতের প্রথম ও টানা ১৭ বছরের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে কাঁদিয়েছে। তিনি লতা নামের অল্প বয়সের মেয়েটির চমৎকার ও বিস্ময়কর কন্ঠসঙ্গীতে চোখের পানি ফেলেছেন। এই গল্পটি বলতে খুব ভালোবাসতেন লতা মঙ্গেশকর, ১৯৬৩ সালের ২৭ জানুয়ারি, ভারতের অন্যতম প্রধান স্বাধীনতা সংগ্রামীর একেবারে সামনে তিনি আয়ে মেরে ওয়াতান কী লোগো নামের দেশাত্মবোধক গানটি গেয়েছিলেন। এই গানের গীতিকার কাভি প্রদীপ; লেখা হয়েছে আগের বছর ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সৈনিকদের সম্মানে। এত ভালোভাবে গানটিতে দেশপ্রেমের ভাব ফুটিয়ে তুলেছিলেন লতা যে পন্ডিত নেহেরু আর থাকতে পারেননি।
এই কোকিলকন্ঠী জীবনে মোট তিনবার সারা ভারতের সেরা নারী প্লেব্যাক সিঙ্গার নিবাচিত হয়েছিলেন। তার সেই পদকটির নাম হলো-ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর দি বেস্ট ন্যাশনাল ফিমেল প্লেব্যাক সিঙ্গার। একই কারণে তিনি ফিল্ম ফেয়ারের অ্যাওয়াডটি লাভ করেছেন ১৯৫৯ সালে প্রথম। জীবনে মোট চারবার এই অত্যন্ত দামী সিনেমা ম্যাগাজিন সম্মাননাটি জয় করে নিয়েছেন এই কালো মেয়ে। তারপর তিনি এই পুরস্কার প্রদান করা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছেন, আমাকে আর নয়, এখন থেকে তরুণ প্রতিভাদের তুলে আনতে ওদের পুরস্কারটি প্রদান করুন। এটি ১৯৭১ সালের ঘটনা; বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ব্যস্ত। লতা মঙ্গেশকরের এই উদারতা ইতিহাস হয়ে আছে ভারতের গানের ভুবনে।
চলে গেলেন তার গানের জীবনের প্রথম দিকের অন্যতম সাথী; মহাতারকা দিলীপ কুমার। বলেছিলেন একবার, ‘যে কারণে কোনো ফুলের সুগন্ধের কোনো রঙ থাকে না, মৃদু বাতাস বা প্রবাহমান ঝর্ণা কোনো দেশের পরিচয় বহন করে না, একটি ছোট্ট শিশুর হাসি কোনো ধর্ম মানে না, তেমনিভাবে আমাদের লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠটি এই দেশের সৃজনশীলতায় অলৌকিকতা হয়ে আছে।’
(ডিএনএ ইন্ডিয়া অবলম্বনে)