‘তিনি ভারতের সঙ্গীত ও কাব্যের একটি অংশ’
গল্পের চেয়েও উত্তেজক তার জীবন। অভাব ঠেকাতে ১৩ বছর বয়সে পথে গাইতে নামলেন। মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন কম বয়সের কাউকে পদক দিলে। জুতো পরে কখনো গাননি কোথাও লতা মঙ্গেশকর।
২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ সালে জন্মেছিলেন তিনি ব্রিটিশদের শাসনাধীন অখন্ড ভারতবর্ষে। মহারাষ্ট্র প্রদেশের ইন্দোরের মেয়ে লতা মঙ্গেশকর। দীননাথের পাঁচটি ছেলেমেয়ের সবার বড়। বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর একজন ক্লাসিক্যাল ভারতীয় মিউজিশিয়ান ও থিয়েটার কম্পানির মালিক। তার থিয়েটারের প্রযোজনাগুলোতে মোটে পাঁচ বছর বয়সে বড় মেয়েটির গান গাওয়ার শুরু হলো। ছেলেবেলার বেশিরভাগ সময় রাস্তাঘাটে কাটাতে হয়েছে লতাকে। যেহেতু নিজের দলটিকে নিয়ে সারা দেশজুড়ে কাজ করতে হতো বাবাকে। তবে মোটে ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারালেন মেয়ে। এরপর থেকে ছোটভাইবোনদের খাবার যোগাড় করতে তাকে জোর করে কাজে নেমে যেতে হলো।
১৯৪৫ সালে চূড়ান্তভাবে তাদের পরিবার চলে এলো ভারতের মুম্বাইতে। বলিউডে ক্যারিয়ার গড়বেন বলে ভাগ্য পরীক্ষায় জন্য এলেন লতা। এখানে একটি দীর্ঘতম ক্যারিয়ার থাকলেও ক্যামেরার সামনে স্বাচ্ছদ্য বোধ করেননি। ফলে অন্যান্য অভিনেত্রীদের মুখে গান তুলে দেওয়ার কাজ শুরু করলেন। রেকর্ডিং করতে শুরু করলেন। তার প্রথম প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে ছবি বেরুলো ১৯৪৯ সালে, নাম ‘মহল’। ১৯৫০ সাল থেকে লতা মঙ্গেশকরের উঁচুতে নিক্ষেপ করা ও চওড়া বিন্যস্ত রমণীয় কন্ঠস্বরটি তাড়াতাড়ি বলিউডের কিছু সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমার সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান হয়ে গেল। এই ছবিগুলোতে জীবনের শেষ পর্যন্ত তার সেই প্রবল জনপ্রিয় গানগুলো সিনেমার গল্পগুলোর চেয়েও স্মরণীয়, গানগুলোকে হিট করতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে গিয়েছে। তিনি তার কন্ঠের জাদুতে পরিচিত হয়ে গেলেন ‘কুইন অব মেলেডি’ নামে। সঙ্গীত পরিচালকরা প্রায়ই মঙ্গেশকরকে মাথায় রেখে গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন। আর এই সময়ে অন্য প্রযোজকরা প্রতিযোগিতা করেছেন তাদের ছবিগুলোকে তাকে সাইন করাতে। তার সবচেয়ে বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘পেয়ার কিয়া তোহ ডরনা কিয়া’ ও ‘চলতে, চলতে’।
তার জন্য গান লিখেছেন ভারতের অস্কার জয়ী সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমান। বলেছেন, ‘লতাজির মতো একজন আইকন কেবল নন, তিনি ভারতের সঙ্গীত ও কাব্যের একটি অংশ। তার শূণ্যতা সবসময় থাকবে।’
আপন ছোট বোন আশা ভোঁসলের সঙ্গে; যার বয়স এখন ৮৮ বছর এবং নিজেকে একজন সুপারস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, মহাতারকা লতা মঙ্গেশকর ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতের সবচেয়ে বড় সিনেমা শিল্পভুবন বলিউডকে গানে শাসন করেছেন। তাকে অনেকে ভারতীয় সিনেমা শিল্পের সর্বকালের সবচেয়ে বড় প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে মান্য করেন। তিনি ভক্তিমূলক ও ক্ল্যাসিকাল অ্যালবামগুলোও রেকর্ড করে বের করেছেন। নিজের গানগুলোর সঙ্গীত পরিচালকের কাজ করেছেন কটি ছবিতে। তার বাদেও ভারতের সেরা এই গায়িকা প্রতিটি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে, তাদের জন্য পারফর্ম করেছেন ক্যারিয়ারে। তিনি দেশ ছাড়িয়ে এই সময়ে সারা বিশ্বে চলে গিয়েছেন।
এই মেয়েটিই ছিল লেখাপড়া থেকে ঝড়ে পড়া একটি শিশু। তারপরও আপন আগ্রহ, যোগ্যতা ও সুযোগে লতা মঙ্গেশকর নিজেকে গড়ে নিয়েছেন। তিনি কয়েকটি ভাষায় অনগল কথাও বলতে পারেন। তার গানের শিল্পসম্ভার প্রায় ২৭ হাজার গানে ছড়িয়ে আছে। এই গানগুলো তিনি গেয়েছেন প্রায় ১২টি ভাষায়। ভাষাগুলোর মধ্যে আছে ইংরেজি, রাশিয়ান, ডাচ এবং সোহাহিলিও।
লতা মঙ্গেশকার তার লাইভ পারফরমেন্স বা উন্মুক্ত গানের অনুষ্ঠানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এর বাদে নিজের অদ্ভুত মুদ্রা দোষের জন্যও নাম করেছিলেন লতাজি। তিনি কোনোদিনও কোথাও পায়ে জুতো পরে গান গাননি। প্রতিটি গানই রেকডিং করতে যাবার আগে হাতে লিখে নিতেন।
ভারতের এই কোকিলকন্ঠী কোনোদিনও বিয়ে করেননি। বলেছেন ‘আমার জীবন সঙ্গীতে সমপর্ণ করেছি’। তাছাড়াও কোনোদিনও তিনি তার পারিশ্রমিক বাড়ানোর সময় অবস্থান নিতে কুষ্ঠাবোধ করেননি। এছাড়াও তাকে গানগুলোর রয়ালিটির টাকা ভাগাভাগির প্রশ্ন করা হলে নিজের অবস্থান জানাতে পিছপা হননি। আবার কোনো জুনিয়র প্রতিভাকে তার মতো একই সম্মাননা প্রদান করলে সেটি মাটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন লতা মঙ্গেশকর।
১৯৮০’র দশক পুরোটা সময় জুড়ে কাজ অব্যাহতভাবে করে গিয়েছেন লতা। বৃদ্ধ বয়সে অনন্য কন্ঠস্বরটিকে তিনি জুনিয়র অভিনেতা, অভিনেত্রীদের ধার দিয়েছেন। ৫০ বছরেরও কম বয়সের অভিনেত্রীদের অনন্য কণ্ঠে গান উপহার দিয়েছেন।
ভারত তাকে সম্মান জানিয়েছে ১৯৮৯ সালে সিনেমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘দাদা সাহেব ফালকে’ প্রদান করে। ২০০১ সালে লাভ করেছেন ‘ভারত রত্ন’।
(গার্ডিয়ান অবলম্বনে)
ছবি : অভিনেত্রী মীনা কুমারীর সামনে তার জন্য স্টুডিওতে গান রেকর্ড করছেন লতা মঙ্গেশকর।