ফিরে দেখা ২০২১
দু:সময়ে আশা জাগালো ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, বাংলায় আলোচিত কিছু সিরিজ
ছবি: সংগ্রহ
বিশ্ববাসীর মতো বাংলাদেশির কাছেও বিনোদনের সংজ্ঞাটা পাল্টে যাচ্ছে রাতারাতি। প্রেক্ষাগৃহ, মঞ্চ করোনাকালে দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার ফলে বাঙালি দর্শক মজেছে ওয়েব সিরিজে। করোনাকাল অভিশপ্ত বছর হলেও ওয়েব সিরিজের বাজার ছিল রমরমা। লকডাউনে দেশবাসীর কাছে সুস্থ বিনোদনের মাধ্যম বলতে ভরসা ছিল ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। একাধিক ওয়েব সিরিজ ও সিনেমাগুলি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে স্ট্রিমিং হয়েছে এবং বহু সিনেমা কিংবা সিরিজ দর্শকদের মনে ছাপ ফেলতে সফল হয়েছে।
ওটিটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এর দর্শক শ্রেণি শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। ভালো এবং যুগপোযোগি কন্টেন্ট হলে দেশের গণ্ডিও ছাড়াতে পারে। তেমনি শক্তিশালী কিছু বাংলা কন্টেন্ট এ বছর দেখতে পেয়েছেন দর্শক। এরই মধ্যে ‘চরকি’ সহ একাধিক নতুন প্লাটফর্ম আশা জাগানিয়া অবস্থান তৈরী করে ফেলেছে, বেশকিছু প্লাটফর্ম আছে পাইপলাইনে। এ ছাড়াও ভারতীয় কিছু প্লাটফর্ম নিয়মিত বাংলাদেশি নির্মাতা, অভিনেতা ও কলাকুশলীদের নিয়ে কন্টেন্ট নির্মাণ করছে। প্রতিনিয়ত সাড়াও ফেলেছে কন্টেন্টগুলো। এরমধ্যে আছে ওয়েব ফিল্ম, ওয়েব সিরিজ এবং অমনিবাস সিরিজ। শুধু বাংলাদেশি দর্শকদের মাঝে নয়, কলকাতা কিংবা বিশ্বের নানা প্রান্তের বাঙালি দর্শকদের মাঝেও সমান জনপ্রিয়তা পাচ্ছে কন্টেন্টগুলো।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশে পাঁচটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আছে। এ ছাড়া ভারতের তিনটি প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে ওয়েব সিরিজ, সিনেমা প্রযোজনা করছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের এমন জনপ্রিয়তায় সরকারিভাবে এ ধরনের একটি প্ল্যাটফর্ম খোলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ে সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স ম গোলাম কিবরিয়া।
বিজনেস ইনসাইডারের একটি জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালে পৃথিবীজুড়ে শুধু নেটফ্লিক্সই দেখেছে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ। নতুন নতুন সিনেমা, সিরিজ এই প্ল্যাটফর্মেই দেখা হয়েছে বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এগুলো নিয়ে আলোচনা ট্রেন্ডি ছিল। নেটফ্লিক্স, হইচইয়ের মতো বিদেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আর চরকির মতো দেশীয় স্ট্রিমিং সাইট বিচিত্র স্বাদের সিনেমা ও সিরিজ দিয়ে মানুষকে বিনোদন দিয়েছে। দেশে তৈরি সিনেমা ও সিরিজ দেখার প্রতি আগ্রহ দেখা গেছে অনেক বেশি।
২০২১ সালে বেশ কিছু বাংলাদেশি ওয়েব সিরিজ সাড়া জাগিয়েছে। ওয়েবের দর্শকদের জন্য বছরটা ছিল বেশ উষ্ণ। একের পর এক সিরিজ তাদের চাঙা রাখে বছরজুড়ে। তার মধ্য থেকে আলোচিত ৫টি ওয়েব সিরিজের কথা জানা যাক।
লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত প্রশংসিত ওয়েব সিরিজ ‘লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান’। বাংলাদেশের এই নির্মাতার প্রথম ওয়েবের জন্য প্রথম কাজ এটি। কর্মক্ষেত্রে নারীকে হয়রানি, বৈষম্যসহ বিভিন্ন স্তরের গল্প দেখানো হয়েছে ওয়েব সিরিজটিতে। নুসরাত ইমরোজ তিশার প্রযোজনায় নির্মিত এই ওয়েব সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফারিণ। এছাড়াও আরো অভিনয় করেছেন আফজাল হোসেন, হাসান মাসুদ, সাবেরী আলেম, পার্থ বড়ুয়া, ইরেশ যাকের, মোস্তফা মনোয়ার, শরাফ আহমেদ জীবন, মারিয়া নূর প্রমুখ। ৮ পর্বের এই ওয়ব সিরিজটি চলতি বছরের জুলাইয়ে জি-ফাইভে স্ট্রিমিং হয়। ক্রাইম থ্রিলার ঘরানার ভিড়ে এমন দারুণ গল্পে ওয়েব সিরিজ নির্মাণ করায় প্রশংসিতও হয়েছেন এই নির্মাতা।
মহানগর
শুধু ঢাকা কলকাতা নয়, বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে চলতি বছরে যে ওয়েব কন্টেন্টটি সাড়া ফেলেছে সেটি হলো আশফাক নিপুণের ‘মহানগর’। ভারতীয় স্ট্রিমিং অ্যাপ হইচইয়ে মুক্তি পাওয়া এই সিরিজটি তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়। ‘মহানগর’ এর গল্প, পারফরম্যান্স, কাস্ট, ক্রু সবকিছু নিয়ে পরবর্তীতে ইতিবাচক মন্তব্য লক্ষ্য করা গেছে সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে সিনেআলোচকদের মধ্যেও। ৮ পর্বের এই ওয়েব সিরিজে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন মোশাররফ করিম, জাকিয়া বারী মম, খায়রুল বাসার, মোস্তাফিজ নূর ইমরান প্রমুখ।
নেটওয়ার্কের বাইরে
চলতি বছরে দেশীয় প্লাটফর্ম হিসেবে যাত্রা শুরু করেই চমকে দিয়েছে ‘চরকি’। প্রথম বছরেই বেশকিছু কন্টেন্ট দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেছে প্লাটফর্মটি। বিশেষ করে তারুণ্যকে ধরতে এই প্লাটফর্মের অন্যতম সাড়া জাগানো ওয়েব কন্টেন্ট ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’ বিরাট প্রভাব ফেলেছে। ছোটপর্দার তারকা নির্মাতা মিজানুর রহমান আরিয়ান পরিচালিত এই ওয়েব ফিল্মটির গল্প, নির্মাণ এবং অভিনয়শিল্পীদের দুর্দান্ত অভিনয় ছুঁয়ে যায়নি এমন সিনেদর্শক খুঁজে পাওয়া মুশকিল! বন্ধুত্বের অন্যরকম গল্পে নির্মিত এই ওয়েব ফিল্মে অভিনয় করেছেন শরীফুল রাজ, ইয়াশ রোহান, খায়রুল বাসার, জুনায়েদ, অর্ষা, ফারিণ সহ অনেকে।
ঊনলৌকিক
দেশীয় প্লাটফর্ম চরকির সবচেয়ে প্রশংসিত উদ্যোগ ‘ঊনলৌকিক’ অমনিবাস সিরিজটি। রবিউল আলম রবি পরিচালিত শিবব্রত বর্মণের গল্প অবলম্বনে এর চিত্রনাট্য লিখেছেন শিবব্রত বর্মণ, রবিউল আলম রবি, সৈয়দ আহমেদ শাওকী, নেয়ামত উল্লাহ মাসুম, ও নাসিফ আমিন। মরিবার হলো তার স্বাদ, দ্বিখণ্ডিত, মিসেস প্রহেলিকা, হ্যালো লেডিজ এবং ডোন্ট রাইট মি- অভিনয় করেছেন মোস্তফা মনোয়ার, গাজী রাকায়েত, নাজিবা বাশার, সুমন আনোয়ার, আসাদুজ্জামান নূর, সোহেল মণ্ডল, ফারহানা হামিদ, নুসরাত ইমরোজ তিশা, চঞ্চল চৌধুরী, রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা, ইরেশ যাকের, শাহানা রহমান সুমী এবং ইন্তেখাব দিনার প্রমুখ। ভিন্ন স্বাদের পাঁচটি গল্পে নির্মিত অমনিবাস সিরিজ ‘ঊনলৌকিক’ এর প্রতিটি গল্প নিয়ে পরবর্তীতে দর্শক কথা বলেছেন মন খুলে। অসংখ্য ইতিবাচক পর্যালোচনাও দেখা গেছে সিরিজটি নিয়ে।
জাগো বাহে
‘ঊনলৌকিক’ এর মতো বছর শেষে আবারও দারুণ অমনিবাস সিরিজ উপহার দিয়েছে চরকি। স্বাধীনতা ও বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্য নিয়ে এই সিরিজ মুক্তি পায় চলতি ডিসেম্বরেই। লাইট ক্যামেরা অবজেকশন, শব্দের খোয়াব এবং বাংকার বয় নামে তিনটি পর্ব পরিচালনা করেছেন যথাক্রমে সালেহ সোবহান অনীম, সিদ্দিক আহমেদ এবং সুকর্ণ শাহেদ ধীমান। এরমধ্যে ‘লাইট ক্যামেরা অবজেকশন’ স্বল্পদৈর্ঘ্যটির প্রশংসা করেন সব শ্রেণির দর্শক। কারণ এই গল্পটি বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী চিত্রপরিচালক জহির রায়হানকে কেন্দ্র করে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান নির্মাণ করেছিলেন ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। তৎকালীন সেন্সর বোর্ড চলচ্চিত্রটি আটকে দিয়েছিল। সেই সময় বোর্ডের সঙ্গে যুক্তিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন জহির রায়হান। অজানা এমন ঘটনাকেই উপজীব্য করে ‘লাইট, ক্যামেরা…অবজেকশন’। এতে জহির রায়হানের চরিত্রে অভিনয় করছেন মোস্তফা মনোয়ার।
‘মরীচিকা’ হচ্ছে একজন হোঁচট খাওয়া পুলিশ অফিসারের স্ট্রাগলের গল্প, একজন ঘৃণ্য অপরাধীর অন্ধকার জীবনের গল্প, সর্বোপরি মরীচিকা এক নারীর ঘুরে দাঁড়িয়ে ‘না’ বলতে পারার গল্প। একটি হত্যাকাণ্ড কে ঘিরেই এই গল্প আবর্তিত হয়। শিহাব শাহীনের নির্মিত ওয়েব সিরিজ ‘মরীচিকা’। সিরিজটিতে অভিনয় করেছেন সিয়াম আহমেদ, আফরান নিশো, মাহিয়া মাহি, ফারহান আহমেদ জোভান, ফারজানা রিক্তা প্রমুখ।