হুমায়ুন ফরীদি না থেকেও রয়েছেন বসন্ত সৌরভে
কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। ঘোর লাগা ফাগুনের দিনে ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে সবাইকে শোকে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। বসন্তের দিনে আনন্দ উৎসব যেন শোক মিছিলে পরিণত হয়েছিল তাকে হারিয়ে। তার বিদায়ে কেঁদেছিলেন কোটি কোটি ভক্ত। আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি হুমায়ুন ফরীদিকে হারানোর দিন। তাই প্রিয় এই অভিনেতাকে হারানোর দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছেন সহকর্মী থেকে শুরু করে অগণিত ভক্তরা।
হুমায়ুন ফরীদির জন্ম ১৯৫২ সালের ২৯ মে, নারিন্দা, ঢাকায়। বাবা এটিএম নুরুল ইসলাম ছিলেন জুরি বোর্ডের কর্মকর্তা। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে ফরীদিকে মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুরসহ অসংখ্য জেলায় ঘুরতে হয়েছে। তার মা বেগম ফরিদা ইসলাম ছিলেন গৃহিনী।
ছোটবেলায় ফরীদিকে ‘পাগলা’, ‘সম্রাট’, ‘গৌতম’-এমন নানা নামে ডাকা হত।
প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রাম কালীগঞ্জে। মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাইস্কুল পাস করে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হন। এরপর ৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। নয় মাসের যুদ্ধ শেষে লাল-সবুজের পতাকা হাতে ঢাকায় ফিরলেও ঢাকা ভার্সিটিতে ফেরা হয়নি তার।
টানা পাঁচ বছর বোহেমিয়ান জীবন কাটিয়ে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিশিষ্ট নাট্যকার সেলিম আল দীনের সংস্পর্শে আসেন। এই ক্যাম্পাসেই ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লিখে নির্দেশনা দেন এবং অভিনয়ও করেন ফরীদি। ছাত্রাবস্থায়ই ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্য হন। জড়িয়ে যান মঞ্চের সাথে।
সেলিম আল দীনের ‘সংবাদ কার্টুন’-এ একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করে ফরীদি মঞ্চে উঠে আসেন। মঞ্চে তার অভিনীত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শকুন্তলা’, ‘ফনিমনসা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘মুন্তাসির ফ্যান্টাসি’, ‘কেরামত মঙ্গল’ প্রভৃতি। ১৯৯০ সালে ‘ভূত’ নাটকে নির্দেশনা দেন তিনি। এই নাটকের মাধ্যমেই শেষ হয় তার ঢাকা থিয়েটারের জীবন।
আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’ ফরীদির অভিনীত প্রথম টিভি নাটক। এরপর শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ (১৯৮৭-৮৮)-এ ‘কান কাটা রমজান’ চরিত্রে ফরীদির অনবদ্য করে তোলেন। এরপর ‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘নীল নকশার সন্ধানে’ (১৯৮২), ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ (১৯৮২), ‘বকুলপুর কতদূর’ (১৯৮৫)’, ‘মহুয়ার মন’ (১৯৮৬), ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’ (১৯৮৬) ‘একদিন হঠাৎ’ (১৯৮৬), ‘ও যাত্রা’ (১৯৮৬) ‘পাথর সময়’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’ (১৯৯৩), ‘চন্দ্রগ্রন্থ’ (২০০৬), ‘কাছের মানুষ’ (২০০৬), ‘কোথাও কেউ নাই’ (১৯৯০), ‘মোহনা’ (২০০৬), ‘ভবেরহাট’ (২০০৭), ‘জহুরা’, ‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’, ‘প্রতিধ্বনি’, ‘শৃঙ্খল’ (২০১০), ‘প্রিয়জন নিবাস’ (২০১১), ‘অক্টোপাস’, ‘আরমান ভাই দি জেন্টেলম্যান’সহ (২০১১) অসংখ্য আলোচিত নাটকে অভিনয় করেন এই খ্যাতিমান অভিনেতা।
নব্বইয়ের গোড়া থেকেই হুমায়ুন ফরীদির চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। প্রায় ২৫০টি সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। তার অভিনীত প্রথম সিনেমা তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’। এরপর ‘সন্ত্রাস’, ‘বীরপুরুষ’, ‘দিনমজুর’, ‘লড়াকু’, ‘দহন,’ ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘কন্যাদান’ (১৯৯৫), ‘আঞ্জুমান’ (১৯৯৫), ‘দুর্জয়’ (১৯৯৬), ‘বিচার হবে’ (১৯৯৬), ‘মায়ের অধিকার’ (১৯৯৬) ‘আনন্দ অশ্রু’ (১৯৯৭), ‘শুধু তুমি’ (১৯৯৭), ‘পালাবি কোথায়’, ‘একাত্তুরের যীশু’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘মিথ্যার মৃত্যু’. ‘বিদ্রোহ চারিদিকে, ‘ব্যাচেলর’ (২০০৪), ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৪), ‘রূপকথার গল্প’ (২০০৬), ‘আহা!’ (২০০৭), ‘প্রিয়তমেষু’ (২০০৯) সিনেমাগুলো উল্লেখযোগ্য।
তার অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র ‘এক কাপ চা’ ২০১৪ সালে মুক্তি পায়।
এএম/আরএ/