মুভি রিভিউ
আশ্রয়: জীবন পাল্টে দেয়ার মতো চলচ্চিত্র
সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমি তৃতীয়বারের মতো আয়োজন করেছিল স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র উৎসব ২০২১। তাতে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হয়েছে সারা বিনতে আফজল নির্মিত ‘আশ্রয়’ চলচ্চিত্রটি। পুরস্কারপ্রাপ্তির সংবাদ পড়ে সিনেমাটি দেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। গভীর আগ্রহ নিয়েই দেখেছি ‘আশ্রয়’; প্রথম সিনেমা হিসেবে অসাধারণ কাজ করেছেন নির্মাতা, ফুটিয়ে তুলেছেন জীবন পাল্টে দেয়ার মতো এক গল্পকে।
চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ছোটগল্প ‘খুনী’ অবলম্বনে। ‘খুনী’ অসাধারণ ছোটগল্প, যার মূলে একটি খুনের ঘটনা, খুনীর স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য নির্মম আর্তি। গল্পটিতে চর আলেকজান্ডার সোনাভাঙ্গা গ্রামের মৌলভীদের বাড়ির ছেলে রাজ্জাক একদিন ঝোঁকের মাথায় খুন করে কজু মিঞাদের বাড়ির ছেলে ফইন্যাকে। তারপর কিছুতেই আর সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে না। অথচ স্বাভাবিক জীবনের প্রতি তার আকাঙ্ক্ষা প্রবল। সে পালিয়ে বেড়াতে থাক একটু মুক্ত জীবনের খোঁজে। কিন্ত তার অপরাধবোধ মস্তিষ্ক তাকে তাড়িত করতে থাকে প্রতিমুহূর্তে। একরাতে ঘটনাচক্রে সে আবেদ দর্জির দোকানে উপস্থিত হয়। আবেদ দর্জি তার হারানো ছেলে মোমেনের পরিচয়ে তার বাড়িতে আশ্রয় দেয় রাজ্জাককে। সবকিছু ঠিকঠাক চলতে থাকলেও আপরাধবোধের কারণে সবসময় অস্থির থাকত রাজ্জাক। একসময় মোমেনের স্ত্রী জরিনা বিবিকে বিয়ে করে সংসার পাতার স্বপ্নও দেখে রাজ্জাক। হঠাৎ একদিন মোমেন বাড়িতে ফিরে এলে রাজ্জাকের সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। তার শেষ আশ্রয়টুকুও হারিয়ে ফেলে মুহূর্তের মধ্যে। তারপর তার অন্তরময় ঝলকে ওঠে তীব্র বেদনা।
চলচ্চিত্রটিতে রাজ্জাকের চরিত্রে অভিনয় করেন খ্যতিমান অভিনেতা ও মডেল সাঈদ বাবু। তার অভিনয় ছিল প্রাণবন্ত যা সহজেই দর্শকের নজর কাড়বে। খুব সহজ এবং সন্তর্পণে তিনি রাজ্জাকের চরিত্রটি তুলে ধরেছেন দর্শকের মাঝে। আরও ছিলেন অভিনয়শিল্পী ইকবাল আহমেদ, নাজমুন নাফিস খান, মৌসুমী মোশাররফ প্রমুখ।
ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষন থেকে বলা যায়, ২০ মিনিটের চলচ্চিত্রে স্বাভাবিক জীবনের আর্তিকে নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সারা বিনতে আফজল। এটিই তার প্রথম কাজ। বলা যায় প্রথম কাজ হিসেবে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। যতটা সম্ভব নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েই কাজ করেছেন। আশা করা যায়, আমরা ভবিষ্যৎতে সারার কাছে আরও সুন্দর সিনেমা পাব।
আমার সবসময়ই মনে হয়, সাহিত্যকর্মকে মঞ্চে কিংবা সেলুলয়েডে নির্মাণ সহজ নয়, এ বড়ো কঠিন কাজ। সারা সেই কঠিন কাজটা করেছেন দারুণভাবেই। ক্যামেরার ব্যবহার, আঞ্চলিক সংলাপ, লোকেশন বাছাই ছিল সত্যিই নান্দনিক। ক্যামেরার লেন্স, ফোকাস ও ডাইমেনশন ছিল দুর্দান্ত। স্মার্টলি তা পরিচালনা করেছেন নির্মাতা। ‘আশ্রয়’ দেখে মনে হয়নি, এ তার প্রথম সিনেমা। মনে হয়েছে, অভিজ্ঞ নির্মাতার কাজ যেন।
ওয়ালীউল্লাহ তার গল্পে ম্যাজিক ব্যবহার করেছন, সেটা রাজ্জাকের মনোজগৎ বের করে আকস্মিকভাবে। নির্মাতাও তা সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন, যখন নৌকার গলুইয়ে ভেসে ওঠে মোমেনের স্ত্রীর জায়গায় খুন হওয়া ফইন্যার রক্তাক্ত মাথা! এ সত্যিই দারুণ।
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আর ছোটগল্পের মধ্যে একটা দারুণ মিল রয়েছে। আমার মনে হয়, সেই মিলটা হলো দর্শকশ্রোতার আগ্রহ এবং কৌতুহলকে পরিপূর্ণভাবে মেটাবে না স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কিংবা ছোটগল্প। দর্শকদের মধ্যে একটা প্রশ্ন উদয় হবে, তারপর হঠাৎ শেষ হবে। ‘আশ্রয়’ হঠাৎ করে শেষ হয়েছে, কিন্তু দর্শকশ্রোতার মধ্যে মানবিকবোধের প্রশ্নও উদয় হয়েছে। শেষপর্যন্ত রাজ্জাকের কী হবে, কোথায় সে ‘আশ্রয়’ পাবে, দর্শকের মনে প্রশ্ন উদয় হবে। এ সিনেমায় একজন খুনী মূলত নায়ক, সেই পলাতক খুনীর মধ্যে কাজ করে অনুশোচনাবোধ, ফুটে ওঠে স্বাভাবিক জীবনের জন্য আর্তি, সিনেমায় তা দারুণভাবে উঠে এসেছে। আধুনিক বিশ্ব বলে যে, একজন খুনীরও মানবাধিকার রয়েছে, বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। ‘আশ্রয়’ কী আমাদের সেই বার্তাটি দেয়?
তরুণ নির্মাতা সারা বিনতে আফজল ‘আশ্রয়’ সিনেমার মাধ্যমে মানুষের মাঝে মানবিকতার আহ্ববান ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বলা যায় গল্পটি আপরাধবোধকে কাটিয়ে অনুশোচনার গল্প। এ সিনেমাটি মানুষের মানবিক অনুভূতিকে স্পর্শ করবে।