জেমস বন্ডের থিম সং নির্মাতা মন্টি নরম্যান আর নেই
তালিকাভুক্ত এবং চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন ‘ড. নো’ ছবিটির থিম বা মূল বিষয়বস্তুর জন্য গানটি লেখার জন্য, ১৯৬২ সালে। ছবিটির মাধ্যমেই ‘জেমস বন্ড’ সিরিজের চলচ্চিত্রে যাত্রা। সুরকার ও গীতিকার মন্টি নরম্যান ‘০০৭’র জন্য গানটি লেখার জন্য অনেক খেটেছেন। কেননা হতে হবে ভয় প্রদর্শনকারী আবার সামান্য যৌনাবেদনকারীও, তুলে ধরবে গোয়েন্দাকে।
নরম্যান শুরুর দিকের একটি সংস্করণের গানটি লিখলেন। সেটি জ্যাজ পিয়ানোবাদক ও একটি ব্যান্ডদলের প্রধান কাউন্ট বেইসি গেয়ে রেকর্ড করলেন। ‘খারাপ হয়নি’, পরে বলেছেন। তবে আওয়াজ যথেষ্ট ভয়াল হলো না। ফলে প্রযোজক অ্যালবাট আর. ব্রকলি ও হ্যারি সল্টজম্যান ভিন্ন ধরণের কিছু করতে চাপ দিতে থাকলেন তাকে। তেমন উৎসাহব্যাঞ্জক কিছু খুঁজে বেড়াতে লাগলেন।
অবশেষে দেখলেন, এ তো নাকের নীচেই আছে। একটি অব্যবহৃত গান, নিজেই লিখেছিলেন। ডেস্কের ওপরের ড্রয়ারে পড়ে আছে। টিউনকে বলা হয়েছিল, ‘ব্যাড সাইন, গুড সাইন’। প্রায় বছরখানেক আগে লিখেছিলেন ভি.এস. নাইপলের ‘দি হাউজ অব মিস্টার বিশ্বাস’ উপন্যাস থেকে উদ্দীপ্ত হয়ে। প্রডাকশন আকারে বেরুতে পারেনি। বলেছেন, ‘গানটিকে ভারতীয় স্টাইলের মেলোডি বলে নিন্দা করা হয়েছে।’ এই গানে আরো আছে পূর্ব ভারতীয় নায়কোচিত আবেশ। ০০৭’র সঙ্গে সামান্য মিলে যায়। গানটিতে তিনি আরো খুঁজে পেলেন আশ্চর্যজনক গুণ। ফলে গানটি নিয়ে কাজ করতে পারেন বলে তার ভেতরে বিশ্বাস জন্মালো।
মেলোডিটিকে তৈরি করে ব্যবহার করলেন তাতে, আলাদা, আলাদা নোটে এজন্য গানটিকে ভাগ করলেন। সেতার থেকে গিটার নিয়ে ভাগ করে সুর বসালেন। কাজ সেরেই জেনে গেলেন ০০৭’র জন্য থিম সংটি তৈরি করে ফেলেছেন। বলেছেন, ‘এই গানে আমি কথা ও সুরে এভাবেই তুলে এনেছি জেমস বন্ডের যৌনাবেদন, তার রহস্যময় জীবন, নির্মমতা। সবই কটি নোটের মাধ্যমে।’ গিটারের মাধ্যমে ‘ডাম ডা ডা ডাম ডাম’ সঙ্গে, সঙ্গে স্বীকৃতি পেয়ে গেল। পুরো গানটি হয়ে গেল বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ও সফল টিউনগুলোর একটিতে গড়া, একটি স্বাক্ষর-জেমস বন্ড সিরিজের।
টানা ছয় দশক ধরে মাতিয়ে চলেছে দুনিয়ার সব সিনেমাপ্রেমীকে। নায়ক হিসেবে অনন্যতা দিয়েছেন শন কনোরি থেকে ড্যানিয়েল ক্রেগ। তিনি গানের লেখক হিসেবে সিনেমায় আছেন।
যদিও কম্পোজার জন ব্যারি ড. নো ছবিতে অ্যারেঞ্জার ছিলেন। তাকে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় গানটিতে জনপ্রিয় জ্যাজ ও পপের ফিউশন যুক্ত করায়। ‘গানের সুরগুলো বিচক্ষণতার প্রমাণ, যে চরিত্রটি সম্পর্কে আপনি জানবেন, সবকিছ্ইু তুলে ধরেছে’, কম্পোজার ডেভিড আরনল্ড, পাঁচটি বন্ড ছবিতে কাজ করেছেন, ভ্যারাইটিকে ২০০৮ সালে বলেছেন। আরো জানিয়েছেন, ‘এটি ছিল অতিশয় আত্মগর্বসম্পন্ন, বড়াই, আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ, অন্ধকার, বিপদজনক, উপদেশমূলক, যৌনাবেদনময়ী ও থামানো সম্ভব নয় এমন থিম।’
১১ জুলাই, ৯৪ বছর বয়সে গানটির গীতিকার ও সুরকার মন্টি নরম্যান মারা গিয়েছেন। শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন ইংল্যান্ডের ব্লাউয়ের এক হাসপাতালে। জায়গাটি লন্ডনের পশ্চিমে। তার স্ত্রী রিনা নরম্যান বেঁচে আছেন। বলেছেন, ‘অল্প কদিনের অসুস্থতার পর চলে গেলেন।’ নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করেননি।
মন্টি নরম্যান অধশতাব্দীর বেশি সময় জুড়ে সঙ্গীতজীবনে কাজ করেছেন। ১৯৫০’র দশকে ব্রিটেনের বড় ব্যান্ড দলগুলোতে গেয়েছেন। ভ্যারাইটি বা বিচিত্র ধরণের শোগুলোতেও পারফর্ম করে নাম করেছেন। তার সঙ্গে শোগুলোতে আরো ছিলেন বেনি হিল ও পিটার সেলাস। তারা সাহায্যও করেছেন ‘ইহমা লা দুস’ নামের একটি ফরাসী সঙ্গীতনাট্যকে হিট ইংরেজি ভাষার স্টেজ শোতে রূপদানে। মন্টি নরম্যান ১৯৬১ সালে একটি টনি অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেছেন এই বিষয়ের বই ও লিরিকসগুলো লেখায়।
সবকিছুর চেয়ে তাকে বেশি সাফল্য এনে দিয়েছে বন্ডের থিম সং। যে প্রকল্পটি তিনি প্রায় প্রত্যাখ্যান করছিলেন। তখন তিনি দুটি স্টেজ শো নিয়ে কাজ করছেন। তাকে ব্রকলি ছবিটিকে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। ইয়ান ফ্লেমিংয়ে জেমস বন্ড সিরিজের এই উপন্যাসটি সিনেমার জন্য বানিয়েছেন। নরম্যান ‘সিনেমার জন্য খুব ভালো হয়েছে’ উৎসাহ, প্রশংসা করলেন। ব্রকলি ও সল্টজম্যান স্ত্রীর কাছে লন্ডন থেকে জ্যামাইকা বিমানে উড়িয়ে নিয়ে গেলেন বলে বলেই কাজটি গ্রহণ করেছেন জানিয়েছেন নরম্যান। সেখানেই ছবিটির শুটিং শুরু হয়েছে। এ বন্ডের প্রথম ছবিটির গল্পও। ‘সেটি আমার জন্য একটি খিল আঁটা কাজ হয়েছে। এছাড়াও ভেবেছিলাম, ড. নোর জন্য যদি গালাগাল খাই, তারপরও ছবিটিতে তো আমরা দেখাতে পারব সূর্য, সাগর ও বালুকারাজি।’
একটি চাটার্ড বিমানে ২০ ঘন্টা যাত্রা করে তারা ক্যারিবিয়ানে পৌঁছালেন। এরপর ছবিটির জন্য কিছু পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের গান নিয়ে সেগুলোর রসে ভরা সঙ্গীত রচনা করলেন তিনি। সেসবের মধ্যে আছে ‘আন্ডারনেথ দি ম্যাঙ্গো ট্রি’, বন্ডের ভালোবাসার আগ্রহ প্রকাশ করেছে, কথাগুলো বলেছেন বন্ড উরসুলা আন্ড্রুজের প্রতি। হেনরি রাইডার চরিত্র করেছেন উরসুলা। লাইনগুলো গেয়েছেন তারা সৈকতে। উরসুলার কন্ঠে গেয়েছেন নরম্যানের তখনকার স্ত্রী গায়িকা ও অভিনেত্রী ডায়ানা কোপল্যাল্ড। এখন আর বেঁচে নেই।
মোটে এক মিলিয়ন ডলারের অল্প বাজেটের ছবি ড. নো. বক্স অফিসে রেকর্ড করলো। ৬০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে বিশ্বজুড়ে। শুরুতেই ড. নোতে তার থিম সংটি ব্যবহার করা হলো। চলছে আজও। একমাত্র পার্থক্য হলো তার সূচনা ও ভাবনার সঙ্গে মাতাল শন কোনারি একটি সিগারেট নিলেন ও বললেন, ‘বন্ড, জেমস বন্ড।’
ছবিগুলোর বাণিজ্যিক সাফল্য ও বন্ডের উন্মাদনা কয়েক বছর ধরে চলা থিম সংটি লেখার ক্ষেত্রে নরম্যানের অবদানের খ্যাতি ও সম্মানের বিতর্ক থামিয়ে দিতে সাহায্য করেছে। কিছু সমালোচক বলেছেন, গানটির প্রাথমিক কৃতিত্ব ব্যারির পাওয়া উচিত, যিনি প্রায় ১২টি বন্ড ছবিতে কাজ করেছেন ও তার অর্কেস্টাবাদন ছবিটির গানে রেকর্ড করা হয়েছে। গান ও সঙ্গীতের জন্য রয়ালিটি দাবী করেছেন ব্যারি। নরম্যান বাতিল করে দিয়েছেন ‘পুরোপুরি বাজে কাজ’ বলে।
১৯৯৭ সালে সিডনি টাইমস অব লন্ডন একটি লেখায় ছাপিয়েছে, ব্যারি এই থিমের আসল কম্পোজার। নরম্যান কুৎসা লেখার জন্য তাদের বিপক্ষে মামলা করেছেন। জিতেছেন। তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে ৩০ হাজার পাউন্ড। স্কটসম্যানকে পরে জানিয়েছেন, ‘এটি একটি পুরোনো বক্তব্য সিনেমা ভুবনে। কেউ কোনো ফ্লপের পক্ষে ওকালতি করেন না।’ ড. নোর পরে এই সিরিজ ছবিতে কাজ করার জন্য ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ ৮৫ হাজার পাউন্ড রয়ালিটি সংগ্রহ করেছেন মন্টি নরম্যান।
তাকে ড. নো’র জন্য স্বাক্ষরের পর ব্রকলি বলেছিলেন, ‘তুমি ভালো একটি থিম সং বানাতে পারলে আমরা আরো দুটি ছবি এবং একটি সিরিজ তৈরি করতে পারব। এ আমার জন্য যথেষ্টের বেশি ছিল।’ এরপর তিনি কাজে নেমেছেন। ২০১২ সালে স্কটসম্যানকে বলেছেন, ‘এ অবিশ্বাস্য যে, ৫০ বছর ধরে সিরিজটিতে আমার গান, সুর, আয়োজন চলছে। এও অবিশ্বাস্য আমি এখানে সুবর্ণজয়ন্তী করছি।’
নরম্যান মা-বাবার একমাত্র সন্তান। জন্ম ১৯২৮ সালের ৪ এপ্রিল। ইহুদি অভিবাসী পরিবারে। ভালো নাম মন্টি নোসেরোভিচ। লন্ডনে জন্ম, পূর্ব লন্ডনে বেড়ে উঠেছেন। বাবা কেবিনেট নির্মাতা, মা শিশুদের পোষাক বানাতেন। তাদের পরিবারের সঙ্গীতের ইতিহাস আছে। খালুরা শখের অপেরাবাদক ছিলেন। ১৬ বছর বয়সে মা তাকে প্রথম গিটার কিনে দিলেন। গিবসন গিটারটি এক দশকের বেশি বাজিয়েছেন।
তাদের পরিবার সেন্ট অ্যালবানসে চলে এলো। গিটার শিখতে শুরু করলেন বার্ট উইডেনের কাছে। হারবার্ট মরিস উইলিয়াম উইডেন ওবিই একজন ইংরেজ গিটারবাদক। তার স্টাইলটি জনপ্রিয় এবং অনুপ্রেরণাদায়ক ১৯৫০ ও ১৯৬০’র দশকে। ১৯৫৯ সালে প্রথম ব্রিটিশ ইংরেজ গিটারবাদক হিসেবে একটি হিট রেকর্ড করেন, যেটি ব্রিটেনের সিঙ্গেল চার্টে উঠেছে। তার সবচেয়ে ভালো শিক্ষাদানের গিটারবাদন হলো ‘প্লে ইন অ্যা ডে’। অসম্ভব বিক্রি হয়েছে। রেকর্ডটি ইন্সট্রাকশন ম্যানুয়াল। এরিক ক্লাপটেন, ব্রয়ান মে ও পল ম্যাকার্টনির মতো গায়কদের অনুপ্রেরণা। ২০০১ সালে সঙ্গীতে অবদানের জন্য ‘ওবিই’ লাভ করেছেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ সঙ্গীতবিদ ছিলেন।
তার কাছ থেকে উৎসাহ লাভ করে ছাত্র নরম্যান জ্যাজ গ্রুপগুলোতে গাওয়া শুরু করলেন। বড় দলগুলোতে এরপর ডাক পেলেন। সিরল স্টেইপলটন একজন জ্যাজ ব্যান্ডদলনেতা ও ভালোলিনবাদক। তার দলে গান গেয়েছেন ও গিটার বাজিয়েছেন নরম্যান। স্টানলি ব্ল্যাক ও টেড হিথের দলে কাজ করেছেন।
১৯৫০’র দশকে গীতিকার হিসেবে জীবন শুরু করার আগে নিজের সলো ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। লন্ডনের ইস্ট এন্ডে তার এই জীবনে সংস্পর্শে এসেছেন ও তিনি কাজ করেছেন লেখক জুলিয়ান মোর ও মঞ্চ পরিচালক পিটার ব্রুকের সঙ্গে। কদিন আগে পিটার ব্রুক চলে গিয়েছেন। তার সঙ্গেই বিখ্যাত ‘ইহমা লা দুস’কে ইংরেজি সংস্করণ করেছেন তিনি। তার আরো সঙ্গীত রচনার মধ্যে আছে ‘এক্সপ্রেসো বঙ্গো’। সঙ্গীত ভুবন নিয়ে স্যাটায়ার। পরে ছবি হয়েছে। অভিনয় করেছেন ক্লিফ রিচার্ড। পোটোবেলো রোডে এন্টিক কেনাবেচা নিয়ে রচনা করেছেন ‘মেক মি অ্যান অফার’।
বন্ড বাদে আরো ছবিতে কাজ করেছেন। আছে ১৯৬০ সালের ছবি ‘দি টু ফেইজের অব ড. জ্যাকেল’, ব্রকলির সঙ্গে কাজ করেছেন ১৯৬৩ সালে ‘কল মি বোয়ানা’তে। ১৯৭৯ সালে অলিভার অ্যাওয়ার্ড জয় করেছেন।
কোপল্যান্ডের সঙ্গে তার বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে। ২০০০ সালে রিনা চেজারিকে বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে তার মেয়ে আছে সোশানা কিচেন। তার দুই নাতনী আছে।
ওএস।