বিশেষ সাক্ষাতকার
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘মহানায়ক’ গানটি তৈরি করতে তিন বছর লেগেছে: মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী
সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা সাড়াজাগানো গান ‘মহানায়ক’। এ গানটি লিখেছেন খ্যাতিমান গীতিকার ও কবি মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী। তিনি পেশায় একজন ইজ্ঞিনিয়ার এবং রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক। কিন্তু গান ও কবিতা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তার লেখা গান গেয়েছেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কণ্ঠশিল্পী। সেসব গানে উঠে এসেছে স্বদেশ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং মা-মাটি ও মানুষের কথা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ‘মহানায়ক’ তার অন্যতম সেরা সৃষ্টি। মাল্টিমিডিয়া অনলাইন পত্রিকা ‘ঢাকাপ্রকাশ’-এর সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি ‘মহানায়নক’ লেখার প্রেক্ষাপট, গান লেখার অনুপ্রেরণা ও তার জীবন-স্বপ্ন নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। ‘এডিটর’স টক’ শিরোনামের অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন ‘ঢাকাপ্রকাশ’-এর প্রধান সম্পাদক, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল।
মোস্তফা কামাল: মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী, আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। সম্প্রতি আপনার লেখা গান ‘মহানায়ক’ মুক্তি পেয়েছে। এ গানটি গেয়েছেন ওয়ারফেজ ব্যান্ডের প্রাক্তন ভোকালিস্ট খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী মিজান রহমান। আলাপচারিতার শুরুতে ‘মহানায়ক’ লেখার অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জানতে চাই।
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী: এ গান লেখার মূলেই দেশপ্রেম। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বলেই আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। তার যে দীর্ঘ ঐতিহাসিক জীবন আমরা দেখেছি, সেটি বাংলাদেশের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। বাংলাদেশকে নিয়ে আমি ভাবি সবসময়ই। বেশ কয়েকটি শব্দ প্রায় সবসময়ই আমাকে গভীর ভাবে নাড়া দেয়। যেমন, বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযদ্ধা এবং বীরাঙ্গনা।
আমি মনে করি, একাত্তরের চেতনা ধারণ করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মূলত আমার সব গানই এই চেতনাবোধ থেকে লেখা। যেহেতু বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতার প্রধান নিয়ামক, তাকে নিয়ে তার এই জন্মশতবার্ষিকীতে একটা গান লেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার ছিলো। এ আকাঙ্ক্ষাই গানটি লেখার প্রধান কারণ।
মোস্তফা কামাল: গানটি কবে লিখেছেন এবং লিখতে আপনার কতদিন সময় লেগেছে?
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী: ২০১৯-এর শুরু থেকেই আমি গানটি লেখার চেষ্টা করছিলাম। এ কাজটি আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল। কারণ বঙ্গবন্ধুর মতো একজন ব্যক্তিত্বকে গানের লাইনে নিয়ে আসাটা সহজ কাজ নয়। গানের লাইনে তো সীমাবদ্ধতা থাকে। কমপ্লিট একটা গান লেখার ইচ্ছে আমার ছিল। ২০১৯ সালে অক্টোবর মাসে আমি ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসছিলাম, তখন আমার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লেখার তীব্র এক ইচ্ছে কাজ করছিল। ট্রেনে দীর্ঘ ৫ ঘন্টা আমি এই গানটি নিয়েই একাগ্রভাবে কাজ করছিলাম। ট্রেন যখন ঢাকা প্রবেশ করল, তখন গানটির যে অবয়ব তৈরি হয়, সেটিতে আমি মোটামুটি সন্তুষ্ট হয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, কিছুটা হলেও বঙ্গবন্ধুকে আমার গানে ধারণ করতে পেরেছি।
মোস্তফা কামাল: বঙ্গবন্ধুকে নিজের ভেতরে ধারণ না করলে এমন একটি গান রচনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান সৃষ্টির পরে আপনার অনুভূতি কেমন ছিল? আপনার কি মনে হয়েছিল যে আপনি বেশেষ কিছু রচনা করে ফেলেছেন?
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী: আসলে গানটি লেখা শুরু করেছি অনেক আগে থেকে। ২০১৯-এর শুরু থেকে। আমি প্রথমে একটি লাইনও লিখতে পারছিলাম না। শব্দ লিখে যাচ্ছি কিন্ত মনে হচ্ছে যা লিখছি তাতে গান হবে না, যা বলতে চাচ্ছি বলা হচ্ছে না। ঠিকভাবে কিছুই প্রকাশ করতে পারছি না। এভাবে দিনের পর দিন গেছে। কিন্ত ট্রেনে ওইদিন যখন আমি শব্দগুলো বসাতে শুরু করলাম, প্রথম অন্তরার কিছু লাইন আমার উঠে গেল, তখন মনে হলে এইতো আমি পারছি। পরে ধীরে ধীরে প্রথম অন্তরা, দ্বিতীয় অন্তরা তৈরি হয়ে গেল। পরবর্তিতে আমাকে কিছু কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছে। ট্রেনে মনে হচ্ছিল যে, আমি যা চাচ্ছি তা গান থেকেই বের হবে। তখন আমার অনুভূতিটি ছিল দারুণ।
মোস্তফা কামাল: উদ্বোধনের আগ পর্যন্ত গানটি নিয়ে আপনার ভাবনার জায়গাটি কেমন ছিল? অর্থাৎ গানটিতে কে সুর করবেন, কিভাবে চিত্রায়িত হবে কিংবা গানটির যথাযথ মূল্যায়ন হবে কিনা এ বিষয়ে আপনার ভাবনা কেমন ছিল?
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী: গানটি তৈরি করতে প্রায় তিন বছর লেগেছে। এটি একটি সন্তান মানুষ করার মতো। অতীতে আমি লেখালেখিতে ছিলাম না। আমি অন্য পেশার মানুষ। গানের সঙ্গে আমার সখ্যতা কম। তো গানটিকে মনে হয়েছে অতি যত্নে রাখার মতো একটা বিষয়। আগের গানগুলো আমি সেভাবে করতে পারিনি। আমি অনেকদিন ধরে এমন একজন সুরকার খুঁজছিলাম, যাকে দিয়ে সুর করালে গানটি পূর্ণতা পাবে। যাতে করে গানের কথাগুলো নষ্ট না হয়। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে আমি সরকার রাজেশ ঘোষের সন্ধান পেলাম। তিনি দারুণ সুর করেন এবং অসম্ভব ভালো একজন মানুষ। আমরা গানটি নিয়ে কথা বলি। আমাদের আলোচনায় উঠে আসে যে এটি কথাপ্রধান একটি গান। গানটির কথাগুলো যাতে নষ্ট না হয়ে যায়, সেভাবেই সুর করতে হবে। সুরকার রাজেশ ঘোষ গানটিতে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা টাই করেছেন। সুর করার পরে গানটি গাওয়ার জন্য আমি বহু শিল্পীকে গানটি শুনিয়েছি। পরে শিল্পী মিজান রহমানকে পেলাম। তিনি তন্ময় হয়েও আমার গানটি শুনলেন। আমার মনে হচ্ছিলো সঠিক মানুষটিকেই আমি পেয়েছি। সুর তোলার আগেই করোনাকাল শুরু হলো। গানটিকে নিয়ে খুব চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম। পরে ২০২১-এর সেপ্টেম্বরে গানটিতে কন্ঠ দেয়া হয়। এ গানটিতে সবার যত্ন আছে। আমরা যারা এটি পরিপূর্ণভাবে তৈরি করার পেছনে কাজ করেছি, প্রত্যেকেই গানটিকে খুব ভালোবাসি।
মোস্তফা কামাল: বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার আর কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা?
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী: যে বাংলাদেশে আমরা বাস করছি এবং এ দেশ যাদের রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি, তাদের কিন্ত আমরা ভুলতে বসেছি। আমি আমার গানের মধ্য দিয়ে তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও আমার গান রয়েছে।
মোস্তফা কামাল: মুক্তিযুদ্ধ, বীরাঙ্গনা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখার বিষয়টি আপনি কিভাবে নিজের ভেতর ধারণ করলেন?
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী: আমি অতীতে কখনও লিখিনি। মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কারণেই আমি গীতিকার হয়েছি। চেতনাটি এত গভীর যে আমার মতো অগভীর একজন মানুষের মধ্যেও অনেক শব্দ তৈরি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশের জন্য যারা জীবন দিয়ে গেছেন, তাদেরকে আমরা যথাযথভাবে স্মরণ করছি না। তাদেরকে আমরা মূল্যায়ন করছি না। এই চেতনা থেকেই আমি সবগুলো গান লিখেছি। আমার সবগুল গান এমনভাবে লেখা হয়েছে , যাতে করে গান শুনলে এ দেশের নাগরিকদের মনে হয় মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনাকে আমাদের সম্মান করতে হবে। এ দেশকে মূল্যায়ন করতে হবে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। তাহলেই একাত্তরের চেতনা কাজ করবে। এ চেতনাবোধ ও দায়িত্ববোধ থেকেই আমি দেশের জন্যে লিখি।
মোস্তফা কামাল: আপনার কবি ও গীতিকার হয়ে ওঠার নেপথ্যের কথা যদি বলতেন, আপনি তো অতীতে লিখতেন না। হঠাৎ করে লেখালেখিতে আসার পেছনের ঘটনাটি আমরা জানতে চাচ্ছি।
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকেই আমার লেখালেখিতে আসা। তবে ২০০৭ সালে চাকরিসূত্রে আমি বদলি হয়ে যাই রাজশাহীতে এবং প্রথম বারের মত আমি পরিবার ছাড়া ওখানে একা থাকি। একা থাকায় দায়িত্ব কম ছিল। প্রতিদিন অফিসেরকাজ শেষ করে পদ্মা নদীর পাড়ে হাঁটতে যেতাম। পদ্মার পাড় দিয়ে যখন হাটতাম, তখন পদ্মা নিয়ে আব্দুল আলীমের গান, নজরুলের গান মনে পরত । এ ভাবনাগুলোই সম্ভবত একসময় আমার মধ্যে কবিত্বের সৃষ্টি করে। এরপর থেকে আমি লিখেই চলেছি।
মোস্তফা কামাল: আমরা আশা করি, আপনার থেকে আরও ভালো গান পাব। আপনি সরকারি কাজ নিয়ে সবসময় অনেক ব্যস্ত থাকেন। লেখালেখির কখন করেন কিংবা লেখালেখির জন্য অবসর সময় পান কিনা?
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী: আমার লেখার জন্য অবসরের প্রয়োজন নেই। আমি তো গান লিখি। তাতে থাকে মাত্র কয়েকটি লাইন। যখন তখন মাথার ভেতরে শব্দ বা লাইনগুলো ঘুরতে থাকে, সেটি কাজ করতে থাকে, তখন বসে বসে কিংবা শুয়েও সম্ভব লেখা সম্ভব। যেহেতু আমি অনেক শব্দ দিয়ে বড়ো কোনো উপন্যাস লিখি না আপনার মতো, উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে আপনাকে অনেকগুলো প্লট চিন্তা করতে হয় এবং সেই প্লট ধরে এগুতে হয়। আমার সেই ঝামেলা নেই। আমি নির্দিষ্ট একটি ভাবনা নিয়ে থাকি। সেই ভাবনা বা মেসেজটি কোন কোন শব্দ দিয়ে তৈরি করে যেতে পারে এবং গানের অন্তরা যাতে ঠিক থাকে ও মানুষের কাছে যাদে মেসেজটি ঠিকভাবে পৌঁছায় এটিই আমার ভাবনা।
মোস্তফা কামাল: গান নিয়ে আমরা আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই?
মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী: দেশ ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গান আমি লিখে যাব। সবধরণের গান আমি শুনি, তবে আধুনিক গান সবচেয়ে বেশি শুনি। কারণ আধুনিক গান মানেই নতুন প্রজন্মের গান। আমাদের নতুন প্রজন্ম কী করছে, সংগীত জগতে নতুন প্রজন্ম কী কন্ট্রিবিউসন করছে এবং গান নিয়ে তাদের ভাবনা কী, এটি আমার জানার খুব ইচ্ছে। যখনই কোন ভালো একটি নতুন গান বের হয়, তখনই আমি খুশি হয়ে যাই। আমি অনেক গান লিখে যাব, তবে যা লিখব তা যেন বাংলাদেশের সংগীত জগতকে সমৃদ্ধ করতে পারে, সেই আকাঙ্ক্ষাই রইল।