মাথাপিছু আয় বাড়ছে, মানুষ ছুটছে টিসিবি’র ট্রাকের পিছে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে যা ছিল ২ হাজার ২২৭ ডলার। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩২৭ ডলার।
এদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) তথ্যমতে, করোনাকালে তরুণদের ২৫ শতাংশ বেকার হয়েছে। বিবিএসের তথ্য মতে, এপ্রিল –জুলাইয়ে বেকারত্ব ১০ গুণ বেড়েছে। আর বিআইডিএস’র তথ্য মতে করোনায় আয় কমেছে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষের। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে আয় বাড়ল কার?
রাজধানীতে টিসিবির নিত্যপণ্যের ট্রাকের পিছনে লাইন দিন দিন লম্বা হচ্ছে। বাজার থেকে কিছু কম দামে চাল, ডাল, তেল, পাওয়া যায় ট্রাকে। আর এরজন্য লাইনে আগে দাঁড়ানো নিয়ে রীতিমত হুড়োহুড়ি চলে। দিন পেরিয়ে যায় লাইন ছোট হয় না। লাইনে দাঁড়ানো সবাইকি নিম্ন আয়ের? এটা ভাববার বিষয়। কারণ লাইনে যারা দাঁড়ানোরা অনেকের চেহারায় তা বলে না। এখন আর টিসিবির লাইনে কেবল নিম্ন আয়ের মানুষ দাঁড়ায় না। মধ্যআয়ের অনেকেই মাথা নিচু করে হউক আর মুখ ঢেকে হউক লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয় মিলাতে পারছে না বলেই এ পরিস্থিতি।
বাজার পরিস্থিতি কি বলে?
সরকারি হিসেবেই বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি। ভোজ্যতেলে প্রায় ৩৫ শতাংশ, ডালে ৪৪, আটা ২৫, চিনিতে ১৩, ডিমে ২৬ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া মুরগি, গরু, খাসির মাংস ও মাছের দামও বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। ৬০০ টাকা কমে গরু ও ৯০০ টাকার কমে পাওয়া যায় না খাসীর মাংস। ২০০ থেকে ৩৫০ টাকার রুই ও কাতলা মাছ ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা হয়েছে। একই সঙ্গে ৭০ থেকে ১০০ টাকার আদার কেজি ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এভাবে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকার কেজি লবঙ্গ ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে বাজারে। শুধু তাই নয়, শিশু খাদ্য গুঁড়ো দুধের দামও বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ।
এ যখন বাজারের অবস্থা তখন টিসিবির লাইনে না দাঁড়িয়ে উপায় কি? বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, করোনাকালে যারা চাকরি হারিয়েছেন বা যাদের বেতন কমেগেছে, তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ের লাগাম টানতে পেরেছেন কতটা? একজন মধ্যআয়ের ব্যক্তি যিনি ২০ হাজার টাকার বাসায় ভাড়া থাকেন, যার দুটি সন্তান আছে স্কুলে বা কলেজে পড়ে। তাদের জন্য ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরার কি কোনো উপায় আছে? সন্তানদের পড়াশুনার খরচ, সামাজিক অবস্থা, চিকিৎসা ব্যয়ে কি লাগাম টানা যায়? তাহলে আয় বাড়ার ফর্মূলাটা কি?
আয় বাড়ল কার?
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান হচ্ছে, ঠিক করোনার বছরেই মোট ১০ হাজার নতুন কোটিপতি যুক্ত হয়েছেন ব্যাংক ব্যবস্থায়। আর ৫০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রেখেছে, এমন হিসাবের সংখ্যাই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৯০-তে।
২০১৮ সালে ওয়েলথ-এক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আড়াই শ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিকদের সংখ্যা বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। মহামারির মধ্যেও অবিশ্বাস্য খরুচে সব প্রকল্পের কাজও থেমে নেই।
মাথাপিছু আয় কি?
মাথাপিছু আয় বলতে কোন দেশের মোট আয়কে জনপ্রতি ভাগ করে দিলে যা হয়, তাকে বোঝায়। জনগণের সর্বমোট ব্যক্তিগত আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। সাধারণতঃ মাথাপিছু আয়কে টাকা প্রতিবছর এককে প্রকাশ করা হয়।
মাথাপিছু আয় কিভাবে নির্ণয় হয়
বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস এই হিসাব করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলেছেন, এক বছরে দেশজ উৎপাদন থেকে যে আয় হয়, তার সঙ্গে রেমিট্যান্স যোগ করে জাতীয় আয় বের করা হয়। সেই জাতীয় আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে গড় মাথাপিছু বের করা হয়।
তবে মাথাপিছু আয় নির্ণয়ের এই পদ্ধতিতে বিরোধ আছে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সরকারি হিসাবকে কাগজেকলমে হিসাব। এই পরিসংখ্যানে দেশের মানুষের আয়ের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে দ্রুত ধনী এবং অতি ধনী হওয়ার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু গরীব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে সমাজে বৈষম্য এবং মানুষের আয়ের ফারাক অনেক বেশি হচ্ছে। এই পরিস্থিতির প্রতিফলন সরকারি হিসাবে আসছে না।
তবে অন্যদল অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বাংলাদেশে যে পদ্ধতিতে মাথাপিছু আয় বের করা হয় তা জাতিসংঘের স্বীকৃত পদ্ধতি । বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির খবর আমাদের আন্দোলিত করে বটে, কিন্তু লাগামহীন দ্রব্যমূল্যে সাধারণ মানুষের নাবিশ্বাস। এ থেকে মুক্তির পথ বের না হলে, মধ্যবিত্ত শ্রেণী দরিদ্র আর দরিদ্র শ্রেণী আরও দরিদ্র হওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর থাকবে না।