সাধারণের নাভিশ্বাস
নিত্যপণ্যের দামে পাগলা ঘোড়া
করোনাকালেও বিভিন্ন অজুহাতে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। কয়েক মাস আগে ডিজেলের দাম বাড়ায় পরিবহনসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। সরকারি হিসেবেই বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি। ভোজ্যতেলে প্রায় ৩৫ শতাংশ, ডালে ৪৪, আটা ২৫, চিনিতে ১৩, ডিমে ২৬ শতাংশ বেড়েছে।
বাড়তি ব্যয়ে অতিষ্ঠ জনজীবন। করোনাকালে আয় বাড়েনি, কিন্তু ব্যয়ের হিসাব দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। নিম্নবিত্তের মানুষ বিভিন্ন সরকারি সুবিধা পেলেও বাড়তি ব্যয়ের চাপে পিষ্ট মধ্যবিত্তরা।
ভোলা জেলার চরফ্যাশনের রিকশাচালক মো. আল আমিন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আয় আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। দিনে পাঁচশ থেকে সর্বোচ্চ আটশ টাকা হয়। বছর খানেক আগে হাজার ছাড়িয়ে যেত। ভালোভাবেই চলত সংসার। সংসারে খরচ করে থাকত কিছু। কিন্তু চাল, তেল, চিনিসহ সব জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছুই থাকে না। সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে।
কারওয়ান বাজারের মেসার্স ইউসুফ জেনারেল ষ্টোর সুজন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, করোনার কারণে গত বছর থেকে আয় রোজগার কমে গেছে। কিন্তু ব্যয়তো কমেনি। বছরের ব্যবধানে প্রায় সব জিনিসের দাম বেড়েছে। বাড়তি ব্যয়ে জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
রাজধানীর দিলকুশায় রূপালীর ব্যাংকের সামনে ফুটপথের মসলা ব্যবসায়ী মো. সজীব ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বেশি দামে বিভিন্ন কিনে বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে কোনো লাভ হচ্ছে না। ২০ বছর ধরে ব্যবসা করছি। কিন্তু কখনো এতো কম আয় হয়নি। দিনে ৫০ টাকাও লাভ হয় না। কিন্তু খরচও তার চেয়ে অনেক বেশি। তাই জীবনে বাচানোই কঠিন হয়ে গেছে।’
প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার তোহরাব আলী সরদার বলেন, ‘করোনাকালে কাজ অনেক কমে গেছে। লাভ তো দুরের কথা লোকসানে দিন কাটছে। কারণ প্রায় নির্মাণ সামগ্রীর দাম অনেক বেড়ে গেছে। সাড়ে আট হাজার টাকার ইট ১০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। ৫৬ হাজার টাকা রড প্রায় ৮০ হাজার টাকা। ৩২০ টাকার সিমেন্ট ৩৬০ টাকা ছাড়িয়েছে। কিন্তু রেটতো বাড়েনি। কাজেই লোকসান দিয়েই কাজ শেষ করতে হচ্ছে। কারণ চুক্তিমূল্য আগেই হয়েছে। কিন্তু রেট বাড়ার তো সুযোগ নেই। বর্তমানে এভাবে চলতে থাকলে আধামরার মতো অবস্থা।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপ-সচিব ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আগের পে-স্কেলে বেতন পাচ্ছি। যা বাড়ার আগেই বেড়েছে। সেভাবেই সব কিছু ব্যয় করা হচ্ছে। এক বছরে তেমন বাড়েনি বেতন। কিন্তু মাছ, মাংস, পাল, ডালসহ প্রায় জিনিসের দাম বেড়েছে। বর্তমানে সামাজিকতা বজায় রেখে সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে। কাউকে বলা যায় না, কওয়াও যায় না।’
এদিকে করোনাকালে সব কিছু খোলা থাকলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধ রয়েছে। অনলাইনে ক্লাশ, পরীক্ষা হচ্ছে। তাই আয়ও কমে গেছে শিক্ষকদের। তারপরও তাদের খরচ থেমে নেই। এ ব্যাপারে একটি বেসরকারি কলেজের সহকারি অধ্যাপক কানিজ ফাতিমা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘ছেলে মেয়েদের শিক্ষা ব্যয় ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। মাসে মাসে না দিয়ে বছর শেষে পুরোটাই পরিশোধ করতে হচ্ছে। কিন্তু আয় কমে গেছে। কারণ করোনাকালে প্রায় পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। তাই ঠিক মতো বেতন পরিশোধ করতে পারছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
ঢাকা চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআিই) সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক জিনিসের দাম বেড়েছে। তার প্রভাব আমাদের দেশেও পড়ছে। মুল্যম্ফীতির কারণে সাধারণত বছরে কিছু দাম বাড়ে। তবে করোনাকালে আমদানিকৃত পণ্যের দাম ফ্রেইটের (পরিবহন) কারণে অনেক বেড়ে গেছে। তাই ব্যবসার ব্যয় বেড়ে গেছে। আয় সেভাবে বাড়েনি। এতে চলতে সমস্যা হচ্ছে।
বাড়তি ব্যয়ে শুধু এই ব্যক্তিদের নয়, সারা বাংলাদেশে প্রায় মানুষের একই দশা। কারণ খোদ সরকারি হিসেবেই ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর বাজারদর মুল্য তালিকা অনুযায়ী বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের বেশি। গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি সরু চালের কেজি ছিলো ৫৮ থেকে ৬২ টাকা। সেই চাল বর্তমানে ৬২ থেকে ৭০ টাকা কেজি বাজারে বিক্রি করছে খুচরা ব্যবসায়ীরা। ভোজ্যতেলে প্রায় ৩৫ শতাংশ। কারণ ২০২১ সালে এই সময়ে ১১৪ থেকে সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা লিটার বিক্রি হলেও বর্তমানে ১৬৫ টাকা লিটার হয়ে গেছে। আরও দাম বাড়ার জন্য মিলমালিকরা সরকারকে চিঠি দিয়েছে। ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজির ডাল ৯৫ থেকে ১০০ টাকা। বাস্তবে আর বেশি ১১৫ টাকা কেজি বিক্রি করছে খুচরা ব্যবসায়ীরা। ডালে বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা কেজি প্যাকেট আটা হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি। এখাতে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। আর ৩৮ থেকে ৪৬ টাকা কেজির ময়দা ৫২ থেকে ৬০ টাকা কেজি বিক্রি করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া মুরগি, গরু, খাসির মাংস ও মাছের দামও বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। ৬০০ টাকা কমে গরু ও ৯০০ টাকার কমে পাওয়া যায় না খাসীর মাংস। ২০০ থেকে ৩৫০ টাকার রুই ও কাতলা মাছ ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকা হয়েছে। একই সঙ্গে ৭০ থেকে ১০০ টাকার আদার কেজি ১২০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এভাবে ৭০০ থেকে ৯০০ টাকার কেজি লবঙ্গ ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে বাজারে। শুধু তাই নয়, বাচ্চাদের খাবার গুড়ো দুধের দামও বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। কারণ গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি ৬০০ থেকে ৬৩০ টাকা কেজি ডানো দুধ বিক্রি হলেও বর্তমানে ৬৫০ থেকে ৬৮০ টাকার কম বিক্রি হয় না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় এক লাফে ৩২৭ ডলার বা ১৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। আর গত ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাড়িয়েছে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। এটি ২০২১ সালের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি।
অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম কমার লক্ষণ নেই। কারণ বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়লে তা সরাসরি প্রভাব পড়বে নিত্যপণ্যের ওপর।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘করোনাকালে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে এটা ঠিক। তবে মূল্যস্ফীতির চেয়ে আয় বেড়েছে এটাও ঠিক। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ হয়েছে। আয়ের প্রবৃদ্ধিও ৭ শতাংশ হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে মানুষের ব্যয় বেড়েছে বৈশ্বিক কারণে। কারণ দেশের তেল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজসহ প্রায় পণ্য আমদানি করা। করোনার কারণেই এসব পণ্যের দাম বাড়ছে। আর কৃষককে বাঁচাতে ধান চাল বেশি দামে কেনা হচ্ছে। এজন্য চালের দামও বেশি।’
জেডএ/