অস্থিরতায় শেষ পুঁজিবাজার
করোনার মহামারির পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বের গতি মন্থর করে দেয়৷ তারপর থেকেই অস্থিরতা দেখা দেয় বিশ্বের পুঁজিবাজারে৷ যার প্রভাব পড়ে দেশের পুঁজিবাজারেও৷ বিভিন্ন কারণে বাজার-চিত্র পাল্টে যেতে থাকে৷ লেনদেন ও সূচক কমতে থাকে৷ টানা দরপতনে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন৷ এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিও চাপের মুখে পড়ে৷ নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী উদ্যোগে বছরের প্রথমভাগে (জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি) এবং শেষের দিকে আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে পুঁজিবাজারে যে উত্থান দেখা দিয়েছিল, তার স্থায়ীত্ব বজায় না থাকায় শেষ দুই মাসের অস্থিরতায় শেষ হয়েছে ২০২২ সাল৷
তবে বিদায়ী বছরে নানা সংকটের মধ্যেও পুঁজিবাজারে প্রথমবারের মতো ইসলামি সুকুক বন্ড তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে সম্ভাবনার এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে৷ ৩২ লাখ মিলিয়ন টাকা বাজার মূলধন নিয়ে ডিএসই’র ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মে বহুল প্রতীক্ষিত ২৫০টি সরকারি সিকিউরিটিজের লেনদেন শুরু হয়েছে৷ পুঁজিবাজারে অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি)-এ লেনদেন শুরুর অপেক্ষায়৷ এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ) চালুর কার্যক্রমও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে৷ পুঁজিবাজারে রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্ট (আরইআইট) প্রবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷
তারপরও দরপতন ঠেকাতে না পেরে আবারও ফ্লোর প্রাইস বা শেয়ারের দামের সর্বনিম্ন সীমা বেধে দেয়া হয়েছে৷ ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধসের আগে থেকেই পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাবের ক্ষেত্রে শেয়ারের ক্রয়মূল্যেকে বাজার মূল্য হিসেবে বিবেচনার দাবি জানিয়ে আসছিল৷ এক যুগের বেশি সময় ধরে এ দাবি অমীমাংসিত ছিল৷ এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসেবে আব্দুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেয়ার পর বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নেন৷ সে অনুযায়ী গত ৪ আগষ্ট শেয়ারের ক্রয়মূল্যকে ‘বাজারমূল্য’ ধরে ব্যাংকের বিনিয়োগসীমা বা এক্সপোজার লিমিট হিসাব করার নির্দেশনা জারী করে বাংলাদেশ ব্যাংক৷
২টি ট্রেকহোল্ডার কোম্পানি এপিআই কানেক্টিভিটি স্থাপন করে তাদের নিজস্ব ওএমএস এর মাধ্যমে লেনদেন শুরু করছে। এছাড়াও ডিএসই থেকে ১১টি ট্রেকহোল্ডার কোম্পানিকে এপিআই ইউএটি সংযোগ প্রদান করা হয়েছে।
বাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে ব্লক মার্কেটে ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দামের চেয়ে ১০ শতাংশ কম দামে শেয়ার বেচাকেনা করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে৷ বছরের একেবারে শেষভাগে শেয়ারবাজারে লেনদেনের গতি ফেরাতে তালিকাভুক্ত ১৬৯টি কোম্পানি ও মিউচ্যুায়াল ফান্ডের ওপর আরোপিত ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্যস্তর তুলে নেয়া হয়, তবে একদিনে সর্বোচ্চ ১ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না৷
পুঁজিবাজারের ব্যাপারে ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এম. সাইফুর রহমান মজুমদার বলেন, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বৈশ্বিক অর্থনীতি টানাপোড়নের মধ্যদিয়ে যাচ্ছিল, এরই ধারাবাহিকতায় বছরের শেষভাগে দেশের পুঁজিবাজার একটা বিয়ারিশ ট্রেন্ড পার করে৷ আশা করি ২০২৩ সালের শুরুতেই এই সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে ৷
বাজারের চিত্র
বিদায়ী বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫৮টি। এর মধ্যে কোম্পানি ৩৫৪টি, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ৩৭টি, ডিবেঞ্চার ৮টি, গভর্ণমেন্ট ট্রেজারি বন্ড ২৫০টি এবং করপোরেট বন্ড ৯টি। যার বাজার মূলধনের কাঠামো কোম্পানি ৫৭.৭৮ শতাংশ, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ০.৫১ শতাংশ, করপোরেট বন্ড ০.৪৪ শতাংশ, ডিবেঞ্চার ০.০১ শতাংশ এবং গভর্ণমেন্ট ট্রেজারি বন্ড ৪১.২৭ শতাংশ৷
এমএমই
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে ৬টি এসএমই কোম্পানি নিয়ে স্মল ক্যাপিটাল প্ল্যাটফর্মে লেনদেনের শুভসুচনা করে৷ ২০২২ সালের শেষে এসএমই প্ল্যাটফর্মে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫টি এবং মোট লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৪৯৫.৮৩ মিলিয়ন টাকা৷ যা মোট লেনদেনের ১.০৪ শতাংশ ৷
মোবাইল লেনদেন
২০২২ সালে মোবাইলে লেনদেনকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৭ হাজার ১০৩ জনে।
আইপিও
২০২২ সালে ৬টি কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে ৭,১৩৭.৮১ মিলিয়ন টাকা মূলধন সংগ্রহ করে৷ এর মধ্যে ২টি কোম্পানি প্রিমিয়াম বাবদ মূলধন সংগ্রহ করে ৮৭৫.২০ মিলিয়ন টাকা৷ এছাড়াও ১টি পারপিচ্যুয়াল বন্ড এবং ১টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে ৭৫০ মিলিয়ন টাকা মূলধন সংগ্রহ করে এবং ১ পারপিচ্যুয়াল বন্ড প্রাইভেট প্লেসম্যান্টের মাধ্যমে ৪ হাজার মিলিয়ন টাকা মূলধন সংগ্রহ করে৷
রাইট শেয়ার ইস্যু
২০২২ সাল ১টি কোম্পানি ১০.৯৮ মিলিয়ন রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মোট ১০৯.৮২ মিলিয়ন টাকা মূলধন সংগ্রহ করে৷
ডিএসই’র ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন
কোভিড ১৯ মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের কারণে বিশ্বের স্টক মার্কেটের মতো বাংলাদেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের গতিও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে৷ ২০২২ সালে ডিএসইতে ২৪৪ কার্যদিবসে লেনদেনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২,৩ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯.৩৭ মিলিয়ন টাকা ৷ যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন ৷
ডিএসই ব্রড ইনডেক্স হ্রাস ৮.১৪%
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক ডিএসই ব্রড ইনডেক্স (ডিএসইএক্স) আগের বছরের চেয়ে ৫৪৯.৮৫ পয়েন্ট বা ৮.১৪ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৬ হাজার ২০৬.৮১ পয়েন্টে দাঁড়ায়৷
ডিএসই ৩০ সূচক হ্রাস ১৩.৩২%
ডিএসই ৩০ সূচক (ডিএস৩০) ৩৩৭.২৮ পয়েন্ট বা ১৩.৩২ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ২১৯৫.৩০ পয়েন্টে দাঁড়ায়৷ ২০২২ সালে ডিএস৩০ মূল্য সূচক সর্বোচ্চ ২৬৩৫.৩৮ পয়েন্টে উন্নীত হয় এবং সর্বনিম্ন ছিল ২১৪৫.২৫ পয়েন্ট৷
ডিএসইএক্স শরীয়াহ্ সূচক হ্রাস ৫.০৫%
একই বছর ডিএসইএক্স শরীয়াহ্ সূচক (ডিএসইএস) ৭২.২৯ পয়েন্ট বা ৫.০৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১৩৫৮.৮৪ পয়েন্টে দাঁড়ায়৷ ২০২২ সালে ডিএসইএস মূল্য সূচক সর্বোচ্চ ১৫২২.৯৮ পয়েন্টে উন্নীত হয় এবং সর্বনিম্ন ছিল ১৩০৮.২০ পয়েন্ট৷
বাজার মূলধন
২০২২ সালে ডিএসই’র ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মে ৩১ লাখ ৪০ হাজার ১৪৩.২৭ মিলিয়ন টাকা বাজার মূলধন নিয়ে ২৫০টি সরকারি সিকিউরিটিজ তালিকাভুওির মাধ্যমে ১০.১০.২০২২ তারিখে বাজার মূলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭,৭২৫,১৪৪ মিলিয়ন টাকা৷ বছরশেষে বাজার মূলধনের দাঁড়ায় ৭,৬০৯,৩৬৮ মিলিয়ন টাকা দাঁড়ায়৷
ব্লক মার্কেট
২০২২ সালে ব্লক মার্কেটে লেনদেন হয় ১৪২,৫৩১.৯৬ মিলিয়ন টাকা৷ যা মোট লেনদেনের ৬.০৪ শতাংশ৷ অপরদিকে ২০২১ সালে ব্লক মার্কেটে লেনদেনের পরিমান ছিল ১৪০,৫১০.৮৩ মিলিয়ন টাকা, যা মোট লেনদেনের ৩.৯৭ শতাংশ৷
মার্কেট পিই
২০২২ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিঃ এ তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজ সমূহের মূল্য আয় অনুপাত বা মার্কেট পিই দাঁড়ায় ১৪.০৮ ৷
জেডএ/এএস