১০ টাকার ব্যাংক হিসাব
বড় হচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন, সঞ্চয় ৫৬৯ কোটি টাকা
দেশের প্রান্তিক কৃষকদের কাছে ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা ছিল একেবারে স্বপ্নের মতো। প্রায় এক যুগে কৃষকের সেই স্বপ্ন বিস্তার লাভ করেছে ব্যাপকভাবে। বর্তমানে প্রায় কোটির ঘরে পৌঁছেছে কৃষকের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা। শুধু হিসাব খুলেই শেষ নয়, কৃষকের এসব হিসাব নম্বরে জমাকৃত সঞ্চয়ের পরিমাণ এখন ৫৬৯ কোটি টাকা। আর এসব ব্যাংক হিসাব কৃষকের নানামুখী কাজে লাগছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
কৃষি ঋণের সুবিধাসহ ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে প্রান্তিক কৃষকদের জন্য প্রায় এক যুগ আগে ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
করোনা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ নানামুখী সংকট ও বিশ্বমন্দার প্রভাবে অনেকেই যখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন, তখন প্রান্তিক কৃষকরা স্বপ্নের হিসাব নম্বরে সঞ্চয় করছেন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাস পর্যন্ত ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা প্রায় এক কোটি কৃষকের হিসাব নম্বরে সঞ্চয়ের পরিমাণ ৫৬৯ কোটি টাকা। গত এক বছরে তাদের এই সঞ্চয় বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭ শতাংশ। আর শেষ তিন মাসে সঞ্চয় বৃদ্ধির পরিমাণ ১১ শতাংশের বেশি।
প্রান্তিক কৃষকের ব্যাংক হিসাব খোলার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এই দুর্দিনেও তাদের অ্যাকাউন্টে সঞ্চয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা খুবই খুশির খরব, আশার খবর। কারণ করোনার সঙ্গে বিশ্বমন্দার প্রভাবে অনেকেই সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। সেখানে কৃষকের মধ্যে সঞ্চয়ের মনোভাব রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে বিশ্বে যে সংকট চলছে তাতে এই দুঃসময় থেকে কৃষকরাই উদ্ধার করতে পারেন। তাই কৃষকদের যেভাবে হোক এগিয়ে নিতে হবে। কারণ বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলা করে কৃষকরাই টিকিয়ে রাখছেন ফসলের জোগান। যেভাবেই হোক তাদের জন্য আরও ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। এটা করা দরকার।
সাবেক এই গভর্নর বলেন, ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে কৃষকদেরও ১০ টাকায় বাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। সেই সুযোগকে তারা কাজে লাগিয়েছেন। এ জন্যই তারা আজ পুরো ব্যাংকিং সেবার সুযোগ পাচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বিতীয় প্রান্তিকের (এপ্রিল থেকে জুন) প্রতিবেদনে দেখা যায়, কৃষকরা বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে ৯৮ লাখ ২০ হাজার ৬৯৯টি ব্যাংক হিসাব খুলেছেন। এ সব হিসাব নম্বরে বর্তমানে সঞ্চয়ের পরিমাণ ৫৬৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। গত বছরের একই সময়ে এই কৃষকের হিসাব নম্বরে সঞ্চয় জমা ছিল ৪৪৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। বছরের ব্যবধানে তাদের সঞ্চয় বেড়েছে ১২২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা বা ২৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ। শেষ তিন মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সঞ্চয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১১ শতাংশের বেশি। তবে করোনাকালে ব্যাংকগুলোতে নানা বিধিনিষেধের কারণে কৃষকের যাতায়াত কমে যায়। সেজন্য মার্চে তাদের হিসাব নম্বরে সঞ্চয়ও কিছুটা কমতে থাকে। ২০২০ সালের জুনে যেখানে সঞ্চয় জমা হয়েছিল ৩৬৪ কোটি টাকা, সেখানে ২০২১ সালে সঞ্চয় জমার পরিমাণ কিছুটা কমে হয়েছিল ৩৫২ কোটি টাকা।
শুধু সঞ্চয় নয়, ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খুলে কৃষকরা ব্যাংকিং অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৯৮ লাখ হিসাব নম্বরের মধ্যে ২৮ লাখ ২৮ হাজার হিসাব নম্বরে সরকারের কাছ থেকে প্রায় ৭৩ কোটি টাকা ভর্তুকি গ্রহণ করেছেন প্রান্তিক কৃষকরা।
অন্যান্য খাতের মতো সরকার কম সুদে প্রান্তিক কৃষকদের ঋণ সুবিধাও দিচ্ছে। ২০১৪ সালে ২০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করার পর কোনো জামানত ছাড়াই তাদের ঋণ সুবিধাও দেওয়া হয়।
এ ছাড়া তাদের এই হিসাব নম্বরের মাধ্যমে ৫০০ কোটির রি-ফাইন্যান্সিং (পুনঃঅর্থায়ন তহবিল) থেকেও ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর্থিক সেবার আওতায় আনতে জুন পর্যন্ত সরকার ৯৫ হাজার কৃষককে এই দুই তহবিল থেকে ৫৬০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে।
এ সব সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি কৃষকের হিসাব নম্বরে রেমিট্যান্সও আসছে। প্রবাসীরা তাদের স্বজনদের জন্য এসব হিসাবে অল্প ও দ্রুত সময়ে টাকা পাঠাচ্ছেন। গত এক যুগে এক লাখ ১৫ হাজার প্রবাসী ৪৬১ কোটি টাকার বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান কৃষকদের জন্য ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার উদ্যোগ নেন। এরপর ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করে। তাতে কৃষকদের ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়।
একই বছরে হতদরিদ্রদেরও ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ৩৩ লাখ হিসাব খুলেছেন হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী।
এরপর ২০১১ সালের মুক্তিযোদ্ধা, সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনীর সুবিধাভোগী, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীদের ১০ টাকার বিনিময়ে অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে এ সব তথ্য জানা গেছে।
এনএইচবি/আরএ/