ঘোষণার পরও কমেনি ভোজ্যতেলের দাম
এক লাফে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ৩৮ টাকা বাড়লেও ১৪ টাকা কমানোর ঘোষণার প্রভাব বাজারে দেখা যায়নি। বরং বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে বিক্রেতারা যে যার মতো দামে তেল বিক্রি করছেন।
সোমবার (১৮ জুলাই) থেকে নতুন দামের তেল বিক্রি কার্যকর করার কথা বললেও কোম্পানির ডিলাররা আগের বেশি দামের তেল অর্ডার কাটাচ্ছেন দোকানে দোকানে।
বিক্রেতারা বলছেন, আগের এটি দাম ঘোষণা করুক আর যাই করুক কম দামে তেল পেলে কম দামে বিক্রি করা হবে ।কখন থেকে কার্যকর হবে অর্থাৎ ভোক্তারা কম দামে তেল পাবে। মিলগেট থেকে এটা সেটা করতে করতে ১০-১৫ দিন লেগে যাবে। ওই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তাদের কম দামে তেল নেওয়ার জন্য।
সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর টাউন হল, কৃষিমার্কেট ঘুরে বিভিন্ন দোকানে ক্রেতা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে এমনই চিত্র জানা গেছে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত ও ডলারের ঊর্ধ্বগতির কারণ দেখে সয়াবিন তেলের মিলমালিকরা সরকারের কাছে আবেদন করে দাম বাড়ানোর জন্য। তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গত ৫ মে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৩৮ টাকা বাড়ায়। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অনেক কমতে শুরু করলে আড়াই মাস পর রবিবার প্রতি লিটারে ১৪ টাকা কামানোর ঘোষণা দেয় সরকার। যা সোমবার থেকে কার্যকর হবে বলে গতকাল বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানিয়েছেন।
সরকারের এই ঘোষণা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে তা জানতে রাজধানীর ছোটখাটো দোকান থেকে বড় বড় বাজার এমনকি পাইকারি বাজারেও সরেজমিনে গেলে দেখা যায়, কোনো বিক্রেতাই কম দামে তেল বিক্রি করছেন না।
বিক্রেতারা জানান, দাম কমানো হয়নি। আগের দামে বিক্রি করা হচ্ছে সয়াবিন তেল। ক্রেতারা বলছেন, সরকার কমালেও বিক্রেতারা আগের দামে বিক্রি করছে এটা খুবই খারাপ কথা। বাজার ব্যবস্থায় সরকারের নিয়ন্ত্রণ নাই। তাই এভাবে তারা বেশি দামে আমাদের কাছে তেল বিক্রি করছে।
মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের নিউ হক ভ্যারাইটি স্টোরের লিটন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আগের দামে তেল বিক্রি করা হচ্ছে। পাঁচ লিটার ৯৬০ টাকা, ২ লিটার ৩৯৫ টাকা ও ১ লিটার ১৯৯ টাকা। আজকেও রূপচাঁদা কোম্পানির লোক এসেছে আগের দামে তারা অর্ডার কাটল । তাহলে আমরা কীভাবে কম দামে তেল বিক্রি করব?
কম দামে ক্রেতাদের কাছে তেল বিক্রি করব, তবে এটা কবে কার্যকর হবে বলা যাবে না। এ সময় রূপচাঁদা কোম্পানির প্রতিনিধি মিলনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, দাম কমানোর কোনো সিদ্ধান্ত হেড অফিস থেকে পাইনি। তাই আগের দামে অর্ডার কাটা হচ্ছে। নতুন দামের সিদ্ধান্ত পেলে তখন সেভাবে অর্ডার কাটা হবে।
একই বাজারের মিলন ট্রেডার্স এর মিলন ঢাকা প্রকাশ কেউ বলেন, দাম কমার কোনো বার্তা নাই। তাই আগের দামে ৫ লিটার ৯৭০ টাকা, ২ লিটার ৪১০ টাকা ও ১ লিটার ২০০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। কবে কমবে সেটা জানি না।
কোম্পানি কমালে কম দামে বিক্রি করা হবে। তবে মিলগেটে শুরু করে ডিলার হয়ে আমাদের কাছে আসতে, এই সেই করতে করতে ১০-১৫ দিন লেগে যাবে।
মোহাম্মদপুরের জনতা মার্কেটের আক্তার জেনারেল স্টোরে আক্তারও বলেন, পাঁচ লিটার ৯৯০ টাকা, ২ লিটার ৩৯০ টাকা এবং ১ লিটার ১৯৫ টাকা । যেভাবে কেনা সেভাবে বিক্রি করা হচ্ছে। এখনো কম দামে পাইনি, তাই আগের দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
এদিকে, কৃষিমার্কেটের সিটি এন্টারপ্রাইজের আবু তাহেরও ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, আগের দামে তেল বিক্রি করা হচ্ছে। শুনেছি লিটারে ১৪ টাকা কমেছে। কিন্তু কোম্পানির লোক আজও অর্ডার কাটতে এসেছে। পুষ্টির প্রতিনিধি বলছে পাঁচ লিটার, এক লিটার সবই আগের রেটে। তাই আমরা ও আগের দামে তেল বিক্রি করছি।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে তেলের পাইকারি ব্যবসায়ী মেসার্স সিদ্দিক এন্টারপ্রাইজ এর মাহমুদ সিদ্দিক জানান, ৫ লিটার ৯৫০ টাকা, ২ লিটার ২৮০ টাকা ও ১ লিটার ২০০ টাকা। নতুন রেটের কোনো খবর নাই, পরে জানতে পারবেন।
খুচরা ব্যবসায়ী মেসার্স ইউসুফ জেনারেল স্টােরের ইউসুফ জানান, আগের মাল বিক্রি করা হচ্ছে পাঁচ লিটার ৯৫০ টাকা, ২ লিটার ৩৯০ টাকা ও ১ লিটার ১৯৫ টাকা। কোম্পানি যদি কমায় আমরাও কম দামে তেল বিক্রি করব।
নতুন দর অনুযায়ী, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রায় ৭ শতাংশ কমে ১৮৫ টাকায় বিক্রি হবে। আগের ঘোষণা অনুযায়ী বাজারে বর্তমানে প্রতি পাঁচ লিটারের বোতলের নতুন দাম হবে ৯১০ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তেলের মিল ও পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে বৈঠক থেকে সরকার নতুন দাম নির্ধারণ করে দেয়। তারপরও ভোক্তরা পাচ্ছে না কম দামে সোয়াবিন তেল। অথচ তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা মাত্রই গায়ের রেট যাই থাকুক, ভোক্তাদের বেশি দামেই কিনতে হয়।
এভাবেই তেলের দাম বাড়ানো-কমানোর ঘোষণায় ভোক্তাদের পকেট থেকে কাটা যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। কারণ, বাংলাদেশে মাসে প্রায় দেড় লাখ টন সোয়াবিন তেল লাগে।
সোমবার বিভিন্ন বাজারে দোকানে দেখা যায় বিক্রেতারা চাল ডাল সাবানসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য বিক্রি করলেও তেল বিক্রির কোনাে সাড়া তেমন দেখা যায়নি। বিক্রেতাদেরও তেল কিনতে দেখা যায়নি। তবে টাউন হলের নিউ হক ভ্যারাইটিতে জোসনা নামে এক ভোক্তা ৫ লিটার তেল কেনেন ৯৮০ টাকায়।
তেলের দাম কমেছে জানেন কি? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শুধু শুনেছি কমেছে। কিন্তু বাস্তবে তো দেখলাম না। দোকানে আগের দামে তেল বিক্রি করছে। এটা কি দেখার কেউ নাই? বিক্রেতারা শুধু আমাদের কাছে বেশি দামেই বিক্রি করবে আর সরকার বলবে কমানো হয়েছে তেলের দাম, এটা হয় না।
দাম কমানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে সিটিগ্রুপের পরিচালক (তীর ব্রান্ড তেল) বিশ্বজিত সাহা ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘বিশ্ব বাজারের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশেও সয়াবিন তেলের দাম কমানো হয়েছে এবার। রবিবার সরকারের সঙ্গে বৈঠক করে সোমবার থেকে লিটারে ১৪ টাকা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মিলগেটে আজ থেকেই তা কার্যকর হচ্ছে। তাহলে বাজারে যে সব আগের বেশি দামে তেল সরবরাহ আছে সেগুলো কোন দামে বিক্রি করা হবে? এমন প্রশ্নের ব্যাপারে তিনি বলেন, ডিলারদের সঙ্গে বসে কম দামের ব্যাপারে ম্যাসেজ দেওয়া হবে। তখন আগের বেশি দামের তেলও কম দামে বিত্রি করনা হবে। অপর এক প্রশ্নের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘একটু ধৈর্য ধরতে হবে। সবকিছূই এক দিনে হয় না। দেখেন, অল্প সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।’
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে মিলমালিকরা গত রমজানের ঈদের পর ৫ মে এবং সর্বশেষ বাজেট ঘোষণার দিনই ৯ জুন ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। এ নিয়ে দেশে হই-চই পড়লে পরে ২৭ জুন থেকে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে ৬ টাকা কমিয়ে ১৯৯ টাকা দাম নির্ধারণ করে। ৫ লিটারের বোতলের দাম নির্ধারণ করা হয় ৯৮০ টাকা। এ ছাড়া প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৮০ টাকা, পাম অয়েল ১৫৮ টাকা লিটার নির্ধারণ করা হয়।
জেডএ/এমএমএ/