বাড়ছে কোরবানির চামড়ার দাম
ফাইল ছবি
গত বছর কোরবানি ঈদে চামড়া নিয়ে রীতিমত হা-হুতাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে মৌসুমি ব্যবসায়ী, মধ্যস্বত্বভোগীরা একেবারে পথে বসেছিলেন। ন্যায্যমূল্য তো দূরের কথা, ক্রয়মূল্য পর্যন্ত পাননি তারা। শেষ পর্যন্ত সেই চামড়া তারা পুঁতেছেন মাটির নিচে, কেউ কেউ নদীতে ফেলে দিয়েছেন।
গত বছরের এই তিক্ত অভিজ্ঞতাকে আমলে নিয়ে সরকার এবার চামড়ার দাম কিছুটা বাড়িয়ে নির্ধারণ করার কথা ভাবছে। সরকারের এই উদ্যোগের সঙ্গে লবন মিলমালিক, ট্যানারি মালিকরাও আশা দেখছেন এবং দেখাচ্ছেন। কাঁচা চামড়ার মূল্য নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে আগামীকাল (মঙ্গলবার) ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমনই তথ্য জানা গেছে।
ট্যানারি মালিকরা সারা বছর যে পরিমাণ চামড়া সংগ্রহ করেন এর ৮০ শতাংশ আসে কোরবানি ঈদের সময়। এই চামড়া দিয়ে সারা বছর জুড়ে ব্যবসা করেন তারা। কিন্তু চামড়ার সঠিক বা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না ক্ষুদ্র, মাঝারি ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ রয়েছে, ট্যানারি মালিকরা ঠিকমতো টাকা দেন না। কারণ গত কয়েক বছর থেকে সরকার কাঁচা চামড়ার দাম বেধে দিলেও ট্যানারি মালিকরা সেই দামে চামড়া কিনেন না বা কিনতে চান না। যার ফলে কোরবানি ঈদের সময় ছোট ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পড়েন কঠিন সংকটে। বেশি দামে বা সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনে তারা পড়েন বিপাকে।
গত বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে মাথায় রেখে সরকার এবার কোরবানির চামড়ার বিষয়ে আগে থেকেই উদ্যোগ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে ব্যাংকগুলোকে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট করে ঋণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
অন্যদিকে দেশে পর্যাপ্ত লবন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিল মালিকরাও বলছেন, দেশে যথেষ্ট লবন রয়েছে। লাগবে মাত্র ৬০ হাজার টন। কেউ যাতে লবনের দাম বেশি নিতে না পারে এজন্য জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদেরও নজর রাখতে বলেছে সরকার। তাই এবার চামড়া সংগ্রহকারী ট্যানারি মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগী চামড়া সরবরাহকারীরাও আশা করছেন এবছর চামড়ার দাম বাড়বে।
চামড়ার দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি শাহীন আহমেদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘বিশ্বে সব কিছুর দাম বাড়ছে। তাই আশা করি আমাদের দেশেও জাতীয় সম্পদ কোরবানির চামড়ার দাম বাড়বে। সরকার দাম বেধে দেওয়ার পরও বাড়ে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগে যাই হোক এবারের অবস্থা ভিন্ন, বিশ্বে সব কিছুর দাম বাড়ছে। তাই আমরা কিছুটা হলেও বেশি দামে চামড়া কিনব।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ট্যানারি মালিকরা চামড়ার দাম দেয় না, বকেয়া রয়েছে, এটা মধ্যস্বত্বভোগীদের বাজে অজুহাত। এটা বলে তারা বাজারকে অস্থিতিশীল করার কৌশল নেয়। আগে হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। তাই কিছুটা বকেয়া ছিল। সেটা পুরোনো কথা। কয়েক বছর থেকে আর কোনো বাকি নেই। প্রতিবছরে চামড়া কেনা হয় নগদ টাকা দিয়ে।’
দাম বাড়বে বা কত বাড়তে পারে জানতে চাইলে শাহীন আহমেদ বলেন, ‘মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম নির্ধারণ করে দেবে। সেই দামে কেনা হবে ঈদের চামড়া।’
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকও ব্যবসায়ীদের অর্থাৎ ট্যানারি মালিকদের ঋণ দিতে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া কিনতে ব্যবসায়ীদের বিশেষ ঋণ সুবিধা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে দিয়ে পুনঃতফসিল করা যাবে। পাশাপাশি কাঁচা চামড়া কিনতে ঋণ পাবেন গ্রাহক। এই সুবিধা আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বহাল থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সার্কুলার অনুযায়ী ঋণ দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে রুপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমরা দেখে শুনে ঋণ দেই। তাই আমাদের ১০০ শতাংশ ঋণ রিকভারি (আদায়) হয়ে থাকে। গত বছর চামড়া কেনায় যে ঋণ দিয়েছি তা আদায় হয়েছে। এবারও বেঙ্গলসহ অন্যদের ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং সেটি দেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আফতাব খান বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এবার চামড়ার দাম বাড়তি। তাই এবার কোরবানির ঈদে চামড়ার দাম বাড়বে। তিনি বলেন, ‘১০ বছর আগে চামড়ার দাম চার গুণ বেশি ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কয়েক বছর থেকে দাম কমে গেছে। গতবার ৭০০ থেকে ১০৫০ টাকা পিস গরুর চামড়া কেনা হয়েছে। কিন্তু এবার গত বছরের তুলনায় দাম বাড়বে। ট্যানারি মালিকরাও কয়েক বছর থেকে চামড়ার দাম বকেয়া রাখে না। কিছু থাকলেও তা অনেক আগের বকেয়া। লবনও পর্যাপ্ত রয়েছে দেশে, মিলমালিকরা তা জানিয়েছেন। তাই দাম বাড়বে।’
লবন সংকটের অজুহাতে গতবার চামড়া কেনা হয়নি বলে অভিযোগ করলে এবার মিলমালিকরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, দেশে চাহিদার তুলনায় বহুগুণ বেশি লবন রয়েছে।
বাংলাদেশ লবন মালিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কবির বলেছেন,‘কোরবানির ঈদে লবন লাগবে ৭০ হাজার টন। বর্তমানে দেশে মজুত রয়েছে সাড়ে তিন লাখ টন। মিলগেটে সর্বোচ্চ দাম সাড়ে ১২ টাকা থেকে ১৫ টাকা কেজি। পরিবহন খরচসহ সব মিলে খুচরা বাজারে ২০ টাকা বেশি হবে না ।’
উল্লেখ্য,গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা নির্ধারণ করে। এবার দাম গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি হবে এমনটাই প্রত্যাশা করছেন কোরবানিকে ঘিরে চামড়া ব্যবসায়ীর সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা।
এনএইচবি/এসজি/