বিশ্ববাজারের চেয়ে দেশে জিনিসপত্রের দাম বেশি: সিপিডি
বিশ্ব বাজারের তুলনায় বাংলাদেশে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেশি। সুশাসনের অভাব ও বাজার কারসাজির কারণে এই অবস্থা হয়েছে। এ বাড়তি দামের চাপ মানুষের উপর পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশে গরীব মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
রবিবার (২০ মার্চ) বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ ( সিপিড) এর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে অর্থনীতির এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডির সম্মেলন কক্ষে এ ব্যাপারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। আলোচক ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনসহ অন্যরা।
পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন পথে শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কোভিড-১৯ অতিমারী বৈশ্বিক অর্থনীতিকে বিভিন্ন মাত্রার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। সামাজিক দুরত্বসহ জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বিবেচনা করে নেওয়া পদক্ষেপগুলি অর্থনীতির চাহিদা এবং যোগান উভয় দিককেই দুর্বল করে তুলেছে। এই করোনার সঙ্গে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের তাপেও দেশে বিভিন্ন জিনিসের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুশাসনের অভাব ও বাজার সিন্ডিকেটে বাড়াচ্ছে দাম। যা বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি। অথচ আমাদের চেয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের গড় আয় অনেক বেশি।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে একদিকে নিত্যপণ্যের আকাশ চুম্বি দাম, অন্যদিকে, মুল্যস্ফীতি স্থিতিশীল। এটা আশ্চর্যের বিষয়। কারণ সারা বিশ্বে মুল্যস্ফীতি বাড়ছে, এটা আকাশ চুম্বি। অথচ আমাদের দেশে ৬ শতাংশের বেশি না। এটা বাজারের সঠিক চিত্র প্রকাশ করে না। কারণ কোনো কোনো পণ্যের দাম ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ বেড়েছে। চাল, ডাল পেঁয়াজ তেলের দাম দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ হয়েছে। তারপরও মুল্যস্ফীতি স্থিতিশীল দেখা যায। মানুষের আয় বাড়লেও প্রকৃত আয় কম হওয়ায় ক্রয় ক্ষমতা কমেছে দেশে।’
সিপিডি বলছে, ‘গত এক বছরে দেশে প্রায় ৮৪ শতাংশ জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। যেখানে বিশ্ব বাজারে এর দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ। জ্বালানির এই বাড়তি দাম মেটাতে দেশকে চাপে পড়তে হবে।
ফাহমিদা বলেন, ‘ খাদ্য ও খাদ্য বহিভূত মিলে মনে হচ্ছে মূল্যস্ফীতি তেমন বাড়ছে না। কিন্তু আসলে সব জিনিসের দাম তো বাড়ছে। তাহলে মোটের উপর মূল্যস্ফীতি আরও বেশি । তাইতো মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মিনিকেট, পাইজাম ও ইরি-বোরোর আবাদ বাড়ছে। দেশে উৎপাদন ভালো হলেও চালের দাম কমছে না। দেখা যায় ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারিতে মিনিকেট চালের দাম ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি ছিলো। সেই চাল গত জানুয়ারিতে বেড়ে ৭০ টাকা কেজি হয়েছে। ৪৮ টাকা পাইজাম হয়েছে ৫৭ টাকা কেজি। আর ৩৯ টাকার ইরি-বোরো হয়েছে ৪৫ টাকা। এভাবে প্রায় চালের দাম অনেকে বেড়েছে। অথচ ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে বেড়েছে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ। খাদ্যের মধ্যে প্যাকেট আটার কেজিতে ৩৫টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি। খোলা আটার দামও একইভাবে বেড়েছে।’
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বাড়ার তালিকায় দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে- ভোজ্যতেল। ২০২০ সালের মার্চ মাসে যে তেলের লিটার ১৪০ টাকা ছিলো, বছরের ব্যবধানে এই মার্চে প্রতি লিটার তেলের দাম হয়েছে ১৭০ টাকার বেশি। যা বিশ্বে ১২০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪০ টাকা। মাংসের দামও বছরের দাম ৫৮০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৭০ টাকা কেজি। যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে ৪০০ থেকে হয়েছে ৫০০ টাকা কেজি।
তিনি আরও বলেন, খাদ্যের মধ্যে চিনির দাম ৬৭ টাকা থেকে হয়েছে ৭৭ টাকা কেজি। যা বিশ্বে ৩০ থেকে বেড়ে ৪০ টাকা কেজি হয়েছে। এমনি কি দেশে অনেক উৎপাদন হয়ে বছরের ব্যবধানে ডিমের দামও বেড়েছে অনেক। দেশে এক ডজন ডিমের দাম ১১১ টাকা হয়েছে। যা মালেয়েশিয়ায় ৮৬ টাকা ডজন। অথচ ওই দেশের মাসিক আয় আমাদের চেয়ে ৪২০ ডলার বেশি। কারণ আমাদের দেশে মাসিক আয় ১৪৯ ধরা হলেও তাদের আয় ৬৬৯ ডলার। আর যুক্তরাষ্ট্রে মাসিক গড় আয় ৩ হাজার ৯৫৫ ডলার হলেও ১০৩ টাকা ডজন ডিম কিনতে হয় ভোক্তাদের। তাদের আয় অনেক বেশি হলেও কম দামে এসব পণ্য কিনতে পারছে তারা।’
শুধু তাই নয়, মসলা জাতীয় পণ্যের মধ্যে সম্প্রতি পেঁয়াজের দামও অনেক বেড়েছে। ফাহমিদা বলেন, ‘বছরের ব্যবধানে ৩৫ টাকার পেঁয়াজ ৫৫ থেকে বেড়ে এই মার্চে ৭০ টাকা কেজি হয়েছে। অথচ আমাদের মাসে গড় আয় ১৪৯ ডলার। যেখানে বেলগ্রেড ও সার্বিয়াতে মাসে আয় ৩৩৫ ডলার। কিন্তু তাদের ৪০ টাকা কেজি পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। গুড়া দুধসহ অন্যান্য খাদ্য পণ্যেরও একই চিত্র।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘সব মিলে বলা যায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশে পণ্যের দাম বেশি। বাজারে কারসাজি রয়েছে। সুশাসনের অভাবও রয়েছে। এরফলে সুযোগ সন্ধানীরা বেশি সুযোগ নিচ্ছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করে বাজার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত দরকার। সরবরাহ যাতে যথেষ্ট থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে, দক্ষতা ও সুচারুভাবে ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে বাজার ব্যবস্থা।
সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন কারণে বৈদেশিক লেনদেনের (ব্যালান্স অপ পেমেন্ট) ভারসাম্যে খুবই ফারাক দেখা দিয়েছে। গত জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এই ৭ মাসে মাইনাস বা ঋনাত্বক হয়েছে ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি ) ডলার। যেখানে গত বছরের একই সময়ে ৬ বিলিয়ন ডলার প্লাসে ছিলো। এরফলে রিজার্ভেও প্রভাব পড়েছে। কারণ ঘাটতি বলা যায় ৮ বিলিয়ন ডলার। রেমিটেন্স দিয়েও এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব না। কারণ ইনফরম্যাল চ্যানেলে রেমিটেন্স আসছে দেশে। আবার ইনভয়েস ও ওভার ভয়েসের মাধ্যমেও টাকা চলে যাচ্ছে বাইরে। কাজেই খুবই সর্তকতার সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি দেখা দরকার সরকারকে। এটা একটা অভিঘাত, অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে।’
জেডএ/এসএ/