মোবাইল ব্যাংকিংয়ে খরচ কমানোর দাবি
করোনাকালে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে খুচরা ব্যবসায়ীরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্যের দাম পৌঁছে দিয়েছে। এতে আস্থা বেড়েছে। এই সেবায় সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগও রয়েছে। এই সেবা একবারে তৃণমূলে পৌঁছে গেছে। প্রায় ১০ কোটি অ্যাকাউন্ট চালু করা হয়েছে। তবে সার্বক্ষণিক ব্যবহার করতে না পারায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে ছয় কোটি। সেবার মান ও খরচের মাত্রায় ভিন্নতা আনতে হবে। খরচ কমাতে হবে। টাকা পকেটে থাকার দরকার নেই। পরিষেবা চালু করে সব জায়গায় যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
শনিবার (১২ মার্চ) উন্নয়ন সমন্বয় এবং নলেজ অ্যালায়েন্সের যৌথ উদ্যোগে ‘এমএফএস-এর ১০ বছর: করোনা-পরবর্তি মাঠ-বাস্তবতা সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে বাংলাদেশে এমএফএস-এর দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে চরাঞ্চলে প্রান্তিক মানুষের উপর মাঠ-জরিপের ফলাফল তুলে ধরতে এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়। বাংলা মোটরে উন্নয়ন সমন্বয় কার্যালয় মিলনায়তনে এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে নলেজ অ্যালাইন্সের প্রতিষ্ঠা সভাপতি খন্দকার সাখাওয়াত আলী বলেন , ‘অনেক দরিদ্র মানুষ কেবল সরকারি ভাতার জন্যই এমএফএস একাউন্ট খুলেছিলেন। তাই সার্বক্ষণিক ব্যবহার না হওয়ায় বর্তমান মোট এমএফএস অ্যাকাউন্টের অর্ধেকের বেশি অচল। (তিন মাস লেনদেন না হলে নিস্ক্রিয় অ্যাকাউন্ট) তবে এটিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা উচিৎ। কিভাবে এই গ্রাহকদের অন্যান্য লেনদেনেও এমএফএস ব্যবহারে উৎসাহিত করা যায় তা নিয়ে ভাবা উচিৎ। নিস্ক্রিয় হিসাব সক্রিয় করা দরকার। ক্যাশ ইন, ক্যাশ আউট, রেমিটেন্স, ইউটিলিটি বিল, ফ্লেক্সি লোড ছাড়াও ঋণের টাকা নেওয়া যাচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রাহকরাই এটা ব্যবহার বাঁচিয়ে রেখেছে। মহানগরি থেকে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে সর্বত্রই নিম্ন আয়শ্রেণির মানুষ এমএফএস-এর সুবিধা ভোগ করেছেন। সে বিবেচনায় বলা যায়, এমএফএস ‘করোনার পরীক্ষায় পাশ করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ শুধু পপুলিজম (জনপ্রিয়) দিয়ে টিকে থাকবে না। মোবাইল ব্যাংকিং নামে ঘুরেফিরে বিকাশ, রকেট ও নগদ। এতে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। গ্রাহকের স্বার্থে মানসম্মত সেবা দরকার। লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড দরকার। গ্রাহকের চয়েস নীতিতে আছে, বাস্তবে নেই।’
প্যানেল আলোচক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ. মনসুর বলেন, ‘১০ বছর আগে যেভাবে দেখেছিলাম বর্তমানে তা ভিন্নভাবে এসে গেছে মোবাইল ব্যাংকিং। শুধু ক্যাশ আউট, ক্যাশ ইনে সীমাবন্ধ থাকলে হবে না আরও ভিন্নতা আনতে হবে।'
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সেবার মান, মাত্রা ও খরচ এই তিনটার মাত্রায় ভিন্নতা আনতে হবে। খরচ কমাতে কমাতে হবে। এজেন্ট নির্ভরতা কমাতে হবে। ইন্টার-অপারেটিং সিস্টেম চালু করতে হবে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোন থেকে এটা করতে হবে। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংককে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। সার্ভিস চার্জ যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে হবে। এজেন্ট থেকে বেরিয়ে আসলে খরচ কমে যাবে। খরচ না কমলে কে বিনিয়োগ করবে? টাকা পাঠানো এবং উত্তোলনের পাশাপাশি অন্যান্য আর্থিক লেনদেনেও এমএফএস-এর ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাহলে দুর্নীতির মাত্রা কমে যাবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক অসীম কুমার দাশগুপ্ত বলেন, ‘২০১২ সালের মার্চে সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সহায়তায় যে লক্ষ্য নিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং শুরু হয়েছিলো তার কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। এরফলে নগদ অর্থের ব্যবহার কমে গেছে। এর অবদানে করোনাকালেও মাস্ক বিতরণ থেকে খাদ্য সহায়তা করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে প্রতি দিন আড়াই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। তবে সার্ভিস চার্জ বেশি তা কমাতে হবে। তৃণমূলের লোকজন যাতে কম খরচে নন ব্যাংকিং এলাকায় লেনদেনের সুযোগ পাই।’
অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন. ‘চেকের খরচের চেয়ে অনেক কম খরচে মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন করা হয়। সব সেবা খাতকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে যুক্ত করা সম্ভব হলে সরকারের ৩৪ শতাংশ রাজস্ব আদায় হবে। খরচ কম হলে মানি লন্ডারিং ও অবৈধ লেনদেন বন্ধ হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘যত মানি রান হবে অর্থনীতির গতিও ততো বাড়বে। করোনাকালেও তৃণমূলে প্রচুর অর্থের লেনদেন হয়েছে। এরফলে চাঙ্গা হয়েছে গ্রামাঞ্চল। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে চ্যালেঞ্জ আছে, থাকবে।’
জেডএ/এএস