মধ্যবিত্তরাও এখন টিসিবির লাইনে
‘প্রায় এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জীবনে প্রথম আসা। তারপর ১৮ নম্বর সিরিয়াল (ক্রমিক নম্বর) পেয়ে আড়াইটায় পেলাম টিসিবির পেঁয়াজ, চিনি, তেল ও ডাল। ব্যাগে ভরে নিচ্ছি। কারণ অফিস হয়ে বাসায় যাব।’ প্রচণ্ড রোদে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকায় পিপাসা লেগেছে। তাই পানি পান করতে করতে এভাবেই ট্রাকসেলের পাশে বসে মনির হোসেন কম দামের পণ্য কেনার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানান। আর ৯৪ নম্বর সিরিয়াল পাওয়া শাহজাহান বলেন, ‘অনেক লম্বা লাইন। পাব তো? দোকান বন্ধ করে এসেছি। তেলের দাম এতো বেশি যে বাইরে কেনা সম্ভব না। তাই বাধ্য হয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছি।’ বেসিক ব্যাংকের মো. শহিদুল ইসলামেরও একই শঙ্কা। বলেন, প্রায় এক ঘণ্টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, শেষে পাব তো?
মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ট্রাকসেল থেকে টিসিবির পণ্য কিনতে শুধু এই তিন জনই নয়, সোমবার ( ৭ মার্চ) টিসিবির পণ্য পেতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ট্রাকসেলের একই দশা চোখে পড়ে। তবে ডিলাররা বলছেন, টিসিবি থেকে যা দেওয়া হয়েছে, তা শেষ হয়ে গেলে আমরা চলে যাব। আবার কালকে আসব। কেউ না পেলে আমাদের করার কিছু নেই।
সারা দেশে নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপকভাবে বেড়েছে টিসিবির পণ্যের চাহিদা। মাঝপথে ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সাত দিন বন্ধ থাকার পর রবিবার ( ৬ মার্চ) থেকে আবার শুরু হয়েছে পণ্য বিক্রি। কিন্তু দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে পণ্য পাচ্ছেন না। জীবনে প্রথমবারের মতো এসেও অনেকে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন।
সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে টিসিবির মুখপাত্র মো. হুমায়ন কবির ঢাকাপ্রকাশকে জানান, ‘সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী সারাদেশে এক কোটি পরিবারকে এই নিত্যপণ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাজারের চেয়ে টিসিবির পণ্যের অনেক কম দাম। তাই ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু আমাদের সিস্টেমে এসব পণ্য দেওয়া হচ্ছে। এর বেশি দেওয়া এ মুহূর্তে সম্ভব নয়।
লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের হাতে সিরিয়ল দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা টিসিবি থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে বিশৃঙ্খলা এড়াতে হয়ত কোনো কোনো ডিলার এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন।’ এটা ভালো দিক উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘গত রোজার চেয়ে এবার তিন গুণ বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। আগে না থাকলেও এবার শুধু ঢাকা শহরের দুই সিটিতে ১৫০টি ট্রাকসেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর ঢাকার বাইরে জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী ডিলারের মাধ্যমে ৮৮ লাখ পরিবারকে তেল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
টিসিবি বলছে, সকাল ১০টার পর থেকেই নির্ধারিত স্থানে ১৫০টি ট্রাকসেলে ডিলাররা সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য বিক্রি করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। গোডাউন থেকে মালামাল তুলে তারা বিক্রি করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। সকাল ১০টা থেকে কম দামে কয়েকটি পণ্য নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ালেও দেখা মেলে না ট্রাকের। নিম্ন আয়ের সঙ্গে মধ্যবিত্তরাও অফিসের এক ফাঁকে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। তারপরও পাচ্ছেন না তেল, ডাল, চিনি পেঁয়াজ।
মতিঝিলের শাপলা চত্বরে বেসিক ব্যাংকের মো. শহিদুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘জীবনে এই প্রথম এসেছি। বাজারে চিনি, পেঁয়াজ, তেল, ডালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। তাই কম দামে পাওয়ার আশায় লাইনে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাব কিনা শঙ্কায় আছি।’
একই কথা বলেন, রুপনগর থেকে আসা চায়ের দোকানদার শাহজাহান। তিনি বলেন, ‘বেশি দামে তেল কেনা সম্ভব নয়। তাই দোকান বন্ধ করে লাইনে দাঁড়িয়েছি। ৪৭ নম্বর সিরিয়াল পেয়েছি। পাইলে তো ভালো, না পেলে সব বরবাদ হয়ে যাবে।’
শুধু পুরুষই নয়, সময় বুঝে কম দামে পণ্য পেতে মহিলারাও দাঁড়াচ্ছেন লাইনে। কমলাপুর থেকে আসা তানজিলা আক্তার বলেন, ‘স্বামী বেকার। ২ ছেলে-মেয়ে রেখে কম দামে পাব বলে লাইনে দাঁড়িয়েছি। সামনে অনেক ভিড়। সিরিয়াল দিয়েও অনেকে উঁকি দিচ্ছেন। তাই ভয়ে আছি পাব কি না?
ঠিক সময়ে না আসার কথা স্বীকার করে শাপলা চত্বরে মিন্জু এন্টারপ্রাজের বিক্রয়কর্মী হাসান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, দুপুর ১টার সময় এসেছি। এটা সেটা করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে। লাইনে অনেক মানুষ। সবাইকে দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। আবার কালকে আসব।’
কম দামে পণ্য পেতে প্রেসক্লাব, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, কৃষি মার্কেটসহ বিভিন্ন জায়গায় একই চিত্র দেখা গেছে। সকাল ১০টা থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন ভোক্তারা। কিন্তু ঠিক সময়ে আসে না ট্রাক। কোথায়ও ১২টা, কোথায় আবার ১টার পর আসছে ট্রাক। এ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ হুড়োহুড়ি করছেন। অনেকে সিরিয়াল নম্বর নিয়েও চেষ্টা করছেন কীভাবে আগে নেওয়া যায়।
আসন্ন রমজান মাস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এক কোটি নিম্ন আয়ের পরিবারকে দুবার করে কম দামের পণ্য দেওয়ার জন্য রবিবার থেকে (৬ মার্চ) ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে বিক্রয় কার্যক্রম শুরু করেছে টিসিবি। রাজধানীতে ১৫০টি ট্রাকে এই পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সারাদেশে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তালিকা করে ২৪ মার্চ পর্যন্ত চলবে। তবে শুক্রবার বন্ধ থাকবে। এরপর দুই দিন বন্ধ থাকার পর ২৭ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত আবারও এসব পণ্য বিক্রি করা হবে রাজধানীতে। আর ঢাকার বাইরে শুরু হবে ১৫ মার্চ থেকে।
টিসিবি জানায়, এবার একজন ভোক্তা ৩০ টাকা কেজি দরে দুই কেজি পেঁয়াজ, ৫৫ টাকা কেজি দরে দুই কেজি করে চিনি, ১১০ টাকা দরে দুই লিটার তেল এবং ৬০ টাকা দরে এক কেজি মশুর ডাল কিনতে পারবেন। প্রতি ট্রাকে ৫০০ থেকে এক হাজার কেজি চিনি, ডাল, পেঁয়াজ বরাদ্দ দেওয়া হবে। এছাড়া সয়াবিন তেল ৫০০ থেকে এক হাজার লিটার বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ডিলারদের।
জেডএ/আরএ/