আইসিবি-পদ্মা-বেসিক ব্যাংকের অর্ধেকের বেশি খেলাপি ঋণ
করোনার ধকল থেকে ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নবায়নসহ বিভিন্নভাবে সুবিধা দিয়েছে সরকার। তারপরও লাগামহীন খেলাপি ঋণ। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ স্থিতির ১৩ লাখ এক হাজার ৭৯৭ কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি ঋণ হয়েছে এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণ হয়েছে বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ৬৬২ কোটি টাকা বা ৭৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। কারণ এর মোট ঋণস্থিতি ৮৪৩ কোটি টাকা। আর নতুন প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ৩ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা বা ৬৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর ঋণস্থিতি ৫ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে বহু আলোচিত সরকারি বেসিক ব্যাংকের ৭ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা বা ৫৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। কারণ এর ঋণস্থিতি হলো ১৪ হাজার ২৩১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ কর্মাস ব্যাংকের খেলাপি হয়েছে এক হাজার ৯৬ কোটি টাকা বা ৪৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। এর ঋণস্থিতি হলো ২ হাজার ৩০২ কোটি টাকা। আর খেলাপির ৫ম স্থানে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ ডেভলপমেন্ট ব্যাংক ৭২৮ কোটি টাকা বা ৩৬ শতাংশ। কারণ এর ঋণস্থিতি হলো ২ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া বিদেশি ৯টি ব্যাংকের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক পাকিস্তানের খেলাপি ঋণ হয়েছে এক হাজার ৩৭২ কোটি টাকা বা ৯৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এর মোট ঋণস্থিতি হলো এক হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ সব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা সম্ভব না হওয়ায় মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘সরকার সুযোগ দিলেও সরকারি ব্যাংকের মতো বেসরকারি ব্যাংকেরও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এভাবে চলতে পারে না। সরকার ঠিকমতো কৌশল বের করতে পারেনি বলেই পদ্মা ব্যাংকেরও খেলাপি বাড়ছে। বেসরকারি পদ্মা ব্যাংকে বিনিয়োগ করে বাঁচার কৌশল ভুল ছিল। এতে সরকারেরই লোকসান হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে হয় কারো সঙ্গে মার্জ ( যুক্ত) করতে হবে না হলে বন্ধ করে দিতে হবে। এভাবে লোকসানে চলতে থাকা ব্যাংকের দরকার নেই।’
সূত্র মতে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষায় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু তা পূরণ করতে পারেনি ৮টি ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর ওই সময়ে প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের মার্চে করোনা শুরু হলে গত দুই বছর ধরে ঋণ আদায়ে নানাভাবে ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের রক্ষা করতে ২০২০ সালের শুরু থেকেই মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নবায়নে ছাড় দেওয়া হয়। কারণ বিদ্যমান নীতিমালা ছিল, ঋণ নবায়ন করতে হলে বকেয়া ঋণের ১৫ শতাংশ এককালীন পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু এ নীতিমালা শিথিল করে ওই বছরের শুরু থেকে মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বিপুল অঙ্কের ঋণ নবায়ন করা হয়। এতে সুদহারের ওপর শিথিলতা আনা হয়। ঋণ আদায়ের ওপরই ঢালাও ছাড় দেওয়া হয়। এক টাকা পরিশোধ না করলেও খেলাপি ঋণ করা হবে না। এ সুবিধা দেওয়ায় গত ২০২০ সাল শেষে খেলাপি ঋণ বাড়েনি। বরং কমে বছর শেষে খেলাপি ঋণ কমে হয় ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। এরই ধারাবাহিকতায় বিদায়ী বছরেও (২০২১ সাল) ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা ছিল। সর্বশেষ বলা হয়, মোট বকেয়া কিস্তির মাত্র ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলে ঋণ নিয়মিত হয়ে যাবে। এসব সুবিধা দেওয়ার পরেও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমেনি, বরং এক বছরে বেড়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিথিলতা না থাকলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেড়ে যেত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বর শেষে ৬১টি ব্যাংকের মোট ঋণস্থিতি ছিল ১৩ লাখ এক হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ হয়েছে এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। খেলাপি ঋণের মধ্যে ছয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকেরই ৪৪ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংক ছয়টির মোট ঋণের ১৮.০৬ শতাংশ। তবে বরাবরই সরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম ছিল। কিন্তু এবার তা বেড়ে হয়েছে ৪৩ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। তবে শতকরা হিসাবে সরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ে কম অর্থাৎ ৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
এ দিকে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়েছে মন্দ ঋণের পরিমাণ। এ আদায় অযোগ্য মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে ঝুঁকির পরিমাণ। এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে ৯১ হাজার ৫৮ কোটি টাকাই মন্দ (ব্যাড) ঋণ, যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৮.১৭ শতাংশ।
মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতিও বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণ গ্রাহকের আমানত সুরক্ষা রাখতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের প্রকারভেদে ২০ শতাংশ থেকে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকগুলোর আয় থেকে অর্থ নিয়ে। কিন্তু ডিসেম্বর শেষে ৮ ব্যাংক তাদের আয় দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। এই ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তিন ব্যাংকেরই প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে ঝুঁকির পরিমাণ।
বিদায়ী বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। কারণ গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ (সাবস্টান্ডার্ড, ডাউটফুল ও ব্যাড/লস) বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের মধ্যে আদায় অযোগ্য মন্দ (ব্যাড/লস) ঋণ বেড়ে হয়েছে ৯১ হাজার ৫৮ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের ৮৮ দশমিক ১৭ শতাংশ।
জেডএ/আরএ/