অবৈধভাবে থাকা বিদেশিদের তালিকায় ভারতীয়দের আধিপত্য, বছরে পাচার বিপুল অর্থ
ছবি : ঢাকাপ্রকাশ
বাংলাদেশে অবৈধ বিদেশি কর্মীদের উপস্থিতি এবং তাদের মাধ্যমে অর্থপাচার একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে বর্তমানে কমপক্ষে আড়াই লাখ অবৈধ বিদেশি কর্মরত রয়েছে, যারা প্রতি বছর প্রায় ৩.১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতীয় নাগরিক, যারা বছরে ৫০.৬০ মিলিয়ন ডলার পাচার করে থাকেন।
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও সুরক্ষা সেবা বিভাগের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বৈধভাবে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা এক লাখ সাত হাজার ১৬৭ জন। এর মধ্যে ৩৭ হাজার ৪৬৪ জন ভারতীয়। দ্বিতীয় অবস্থানে চীনের নাগরিক, যাদের সংখ্যা ১১ হাজার ৪০৪। তবে অবৈধ বিদেশিদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০২০ সালে এক জরিপে জানিয়েছিল, বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে দেশে কমপক্ষে আড়াই লাখ বিদেশি কর্মরত। এদের বেশিরভাগই ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, জাপান, মালয়েশিয়া, এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে এসেছেন। তাদের বেশিরভাগই তৈরি পোশাক, চামড়া শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, হাসপাতাল এবং হোটেল খাতে কাজ করেন।
অধিকাংশ অবৈধ বিদেশি ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন খাতে কাজ শুরু করেন। তারা ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই কাজ করে আয়কর ফাঁকি দেয় এবং হুন্ডির মাধ্যমে নিজ দেশে অর্থ পাঠায়। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিদেশি কর্মীরা ১৩০.৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তাদের দেশে পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে ভারত ৫০.৬০ মিলিয়ন ডলার, চীন ১৪.৫৬ মিলিয়ন ডলার এবং শ্রীলঙ্কা ১২.৭১ মিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে অবৈধ বিদেশিদের বৈধ কাগজপত্র সংগ্রহের জন্য সতর্ক করেছে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, “বাংলাদেশে কোনো অবৈধ বিদেশিকে থাকতে দেওয়া হবে না।”
তবে অবৈধ বিদেশি কর্মীদের সংখ্যা নিয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। অনেকে মনে করেন, অবৈধ বিদেশিদের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি হতে পারে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই ভারতীয়। অবৈধ বিদেশিদের চিহ্নিত করতে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টেও একটি রিট করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে। ফলে বিদেশি কর্মীদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। পোশাক শিল্প, চামড়া শিল্প, এবং আইটি খাতের মতো ক্ষেত্রে বিশেষায়িত দক্ষতা প্রয়োজন, যা স্থানীয় জনশক্তির অভাবে বিদেশিদের মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মাশরুর রিয়াজ বলেছেন, “আমাদের দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরি না হওয়ায় বিদেশিদের আনতে হচ্ছে। তবে তারা ট্যুরিস্ট ভিসায় এসে বছরের পর বছর থেকে আয়কর ফাঁকি দেয় এবং অর্থপাচার করে। এতে দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অবৈধ বিদেশি কর্মীদের চিহ্নিত করে তাদের বৈধতার আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি, স্থানীয় জনশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কোনো বিদেশি যাতে কাজ করতে না পারে, সেদিকে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
অর্থনীতিবিদরা আরও বলছেন, “বিদেশি কর্মীদের কাজের নিয়মাবলী কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি, স্থানীয় জনশক্তি উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর মাধ্যমে বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।” সূত্র: ডয়চে ভেলে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।