কৃষক বঞ্চিত ধানে ভোক্তারা ঠকছে চালে
বোরোর আগে কমবে না চালের দাম

কৃষকের কথা বিবেচনা করে সরকার আমন মৌসুমে ধানের দাম বাড়িয়েছে। মণ প্রতি ১ হাজার ৮০ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু ধান উঠার পর কৃষক কম দামে বিক্রি করে দেওয়ায় বর্তমানে ফড়িয়াদের ঘরে ধান। আর ফরিয়ারা সেইধান বিক্রি করছে বেশি দামে। এ জন্য ভোক্তাদেরও কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। তবে বোরো ধান না উঠা পর্যন্ত কমবে না চালের দাম-এমনটাই বলছেন আড়তদাররা। কারণ আমন মৌসুমে শুধু মোটা চাল হয়। বোরো ধানকে কেটে মিনিকেট চাল করতে হয়। দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষক, মিলমালিক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়িদের সঙ্গে কথা বলে চালের বাজারের এমনই চিত্র জানা গেছে।
সুনামগঞ্জে চালের দামে চরম হতাশা:
সুনামগঞ্জের হাওড়ের কৃষকেরা বলছেন, এক বিঘা জমি আবাদে যে খরচ হয়, ধান বিক্রি করে তা উঠছে না। সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওড়পারের কৃষক মো. লিয়াজ উদ্দিন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘এবার আমি আট একর জমিতে আমনের ধানের আবাদ করেছি, ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু ধানের দাম নিয়ে চরম হতাশ। কারণ সরকার প্রতি মণ ধানের মূল্য নির্ধারণ করছে ১ হাজার ৮০ টাকা। এর কোনো প্রভাব নেই বাজারে। হাওড় এলাকায় এখন প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৯৫০ টাকা। পরিবারের ব্যয় মেটাতে বাধ্য হয়েই কম দামে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।’
সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের মঈনপুর গ্রামের কৃষক ফজর আলী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, তারা কষ্টে ধান ফলায় কিন্তু দাম পায় না, তাই কৃষকদের কষ্ট আর ঘোচে না।
রাসেল অটো রাইস মিলের মালিক রাসেল আহমদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমন ধান এক হাজার টাকা মণ কেনা হচ্ছে। মিলে ভাঙিয়ে ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা নতুন চাল ১৯০০ থেকে ২০০০ বা কেজি ৪০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। আর পুরাতন ২৮ চাল বিক্রি করা হচ্ছে ২২০০ বস্তা বা কেজি ৪৪ টাকা ।
সুনামগঞ্জ শহরের বিভিন্ন চালের খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, মোটা চাল কেজি ৪০ টাকা, পাইজাম ৪৫/৫৫ টাকা, আটাইশ ৫২ টাকা , মিনিকেট ৬০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।
নওগাঁয় চালের দাম ঊর্ধ্বগতি:
দেশের অন্যতম বৃহৎ ধান-চালের মোকাম জেলা হওয়া সত্ত্বেও নওগাঁর পাইকারি বাজারে মোটা ও চিকন চালের দাম কেজিপ্রতি ৩-৫ টাকা বেড়েছে। এরফলে খুচরা বাজারেও বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা। এতে বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ। আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মিল মালিকদের দুষছেন ব্যবসায়ীরা। নওগাঁর খুচরা ও পাইকারি বাজারে সপ্তাহ ব্যবধানে প্রায় প্রতি কেজি চালের দাম ৪ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে মিল মালিকরা বলছেন বাজারে ধানের দাম বেশি। এছাড়া মিলের অন্যান্য খরচ ধরেই চাল বিক্রি করায় কিছুটা বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।
নওগাঁ বড় বাজারের চাল ক্রেতা জিন্নাহ বলেন, 'এতদিন চালের বাজার ঠিক থাকলেও কয়েকদিন ধরে চালের বাজারে দর বাড়ছে। মহসিন নামের এক অটো রিকশাচালক জানান, চালের দাম বাড়ছে। এ কারণে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মহাদেবপুর স্বরশতীপূর বাজারে চাচা ভাতিজা ট্রেডার্সের পাইকারি বিক্রেতা মো. সিদ্দিক মোল্লা বলেন, মিলাররা কৃষকের কাছে আগে কম দামে ধান কিনে মজুদ করেছে।
কৃষকের চেয়ে ব্যবসায়ীদের পকেটে লাভ:
দিনাজপুরের কৃষক আজিজুল ইসলাম জানান, বন্ধকী জমিতে চাষাবাদ করে এক একর জমিতে ২৮-আমন ধান আবাদ করে ফলন ঘরে তুলেছেন ৮৫মণ ধান। তার খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। আগেই কম দামে ধান বিক্রি করে পেয়েছেন ৯০ হাজার টাকা। কিন্তু তার ঘরে কোনো ধান নেই। মধ্যস্বত্বভোগি আর মৌসুমি খরিদ্দারের হাতে ধান।
কৃষক কল্যাণ সমিতির কৃষক আজিজুল ইসলাম জানান, ‘তার নিজের জমি নেই। বন্ধক নেওয়া ৪ একর জমিতে ধার দেনা করে আবাদ করে ঘরে ধান তুলতে হয়। তাই প্রথম দিকেই কম দামে বিক্রি করতে হয় ধান।’
ধানের বাড়তি দামের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলহাটের আদর মমতা অটোরাইস মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুর রহমান মোহন পাটোয়ারী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘ধান মূলতঃ তিনভাগে বাজারে উঠে। অনেক কৃষক প্রথমেই ধান বিক্রি করে কাটাই মাড়ায়ের খরচের যোগান দিতে। কিছু অংশ ধরে রাখে পরবর্তী ফসল আবাদের খচরের যোগান মিটানো প্রয়োজনে। প্রথম দিকে কম দামে ওইসব ধান কিনে মজুদ করে রাখে মৌসুমি ও মধ্যস্বত্বভোগি ব্যবসায়ীরা।
উল্লেখ্য, সরকারি আইন অনুযায়ী ছাটাইয়ের জন্য ধান ৪৫ দিন এবং ছাটাইয়ে পর ৬০দিন পর্যন্ত চাল ধরে রাখা যায়। তারপরও বেশি করে ধান, চাল মজুদ করে পরে বেশি দামে বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা। এরফলে ভোক্তাদের বেশি দামে চাল কিনতে হচ্ছে।
রাজধানীর চিত্র:
এদিকে রাজধানীর পাইকারি বাজার কৃষিমার্কেট, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজারের আড়তে সরেজমিনে দেখা গেছে থরে থরে সাজানো চালের বস্তা। কিন্তু কৃষকেরা যে দামে ধান বিক্রি করছে তার চেয়ে অনেক বেশি দামে চাল বিক্রি করা হচ্ছে।
কৃষিমার্কেটের সাপলা রাইস এজেন্সির মালিক মাঈনুদ্দিন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘এবার আমন ধান উঠলেও কমছে না চালের বাজার। কারণ কৃষকদের জন্য বেশি দামে সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। এতে মিলমালিকদের বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছ। তাই কমছে না চালের দাম। তিনি আরও বলেন, মঙ্গলবার কৃষিমার্কেটে মিনিকেট চাল ৫৯ থেকে ৬১ টাকা, আটাশ ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা ও মোটা গুটি স্বর্ণা ৪০ থেকে ৪২ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।
অপরদিকে কারওয়ান বাজারের মেসার্স কুমিল্লা রাইস এজেন্সির মো. আবুল কাসেম ঢাকাপ্রকাশকে জানান, কয়েক সপ্তাহের ধারাবাহিকতায় এ সপ্তাহেও চালের দাম বাড়েনি-কমেনিও। আগের দামেই মিনিকেট ৬০ থেকে ৬২ টাকা, বিআর-২৮ কেজি ৪৬ থেকে ৪৭ টাকা, পারিজা ৪৪ তেকে ৪৬ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। এবার আমনের প্রথম থেকেই বাড়তি চালের বাজার। মাঘ মাসেও কমবে না। বোরো উঠা শুরু হলে তখন কমবে। কারণ বোরো ধান থেকেই মিনিকেট (চিকন) চাল করা হয়। আর বাজারে কিচন চালের চাহিদা বেশি।
একই বাজারের চাটখিল রাইস এজেন্সির বেলাল হোসেনও বলেন, ‘আগের দামেই মিনিকেট ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, আটাশ ৪৮ থেকে ৪৯ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। তবে একই চাল বিভিন্ন বাজারে পাইকারির চেয়ে চার থেকে পাঁচ টাকা বেশি দামে খুচরা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে মোটা চাল ৪৫ টাকা, আটাশ ৫৫ এবং মিনিকেট চাল ৬৭ টাকা কেজি বিক্রি করছে ব্যবসায়ীরা। কেজিতে ৫ টাকা পার্থক্য দেখা গেছে।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, মিনিকেট নামে কোনো ধানের জাত নেই। সরু ধানকে বেশি করে ছিলে বা মিলে রাউন্ড বেশি দিয়ে চাল চিকন করে তা বাজারে বেশি দামে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে ভোক্তারা একদিকে ঠকছেন, অন্য দিকে গুণগত মান পাচ্ছেন না। কারণ বেশি ছিলার ফলে গুণগতমান কমে যাচ্ছে।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন নওগাঁর শামীনূর রহমান, সুনামগঞ্জের মনোয়ার চৌধুরী ]
জেডএ/
