৫০ বছরে পাচার ১২ লাখ কোটি টাকা: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আগামী অর্থবছরের জন্য প্রায় ২১ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে। যা বর্তমান বাজেটের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ বেশি। বিকল্প বাজেট বাস্তবায়ন করলে ১০ বছরের মধ্যে বিপজ্জনক বৈষম্য কমানো সম্ভব।
প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে গত ৫০ বছরে কালো টাকা ও অর্থ পাচারের পরিমাণ হচ্ছে ১ কোটি ৪৪ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পুঞ্জীভূত কালো টাকা ১ কোটি ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এ সময় অর্থ পাচার হয়েছে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা। বিকল্প বাজেট বাস্তবায়ন হলে এটা কমানো সম্ভব।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অডিটোরিয়ামে সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২৩-২৪: বৈষম্য নিরসনে জনগণতান্ত্রিক বাজেট' বাজেট’ নামে এই প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম। এ সময় বিভিন্ন অর্থনীতিবিদরা উপস্থিত ছিলেন।
আবুল বারকাত বলেন, ‘আমাদের বাজেট সম্প্রসারণমূলক। সরকার আগামী অর্থবছরে যে বাজেট প্রণয়ন করতে যাচ্ছে তার আকার ৭ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা বলে আমরা শুনেছি। সেক্ষেত্রে আমাদের বাজেট সরকারের চেয়ে ২ দশমিক ৭ গুণ বড় হবে। উন্নয়ন এবং পরিচালন ব্যয় মিলে এই বাজেটের মোট আকার ২০ লাখ ৯৪ হাজার ১১২ কোটি টাকা।’
তিনি বলেন, ‘বিকল্প বাজেটে রাজস্ব আয় থেকে আসবে ১৯ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা। যা চলমান অর্থবছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৪ দশমিক ৪২ গুণ বেশি। বাকি ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি হবে ঘাটতি বাজেট।’ এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের মধ্যে আয়, মুনাফা ও মূলধনের উপর কর অর্থ্যাৎ আয়কর প্রস্তাব হচ্ছে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। সম্পদ কর খাতে ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা আসা সম্ভব।
অন্যদিকে, এনবিআর বহির্ভূত কর মাদক শুল্ক ১৫২ কোটি টাকা, ভূমি রাজস্ব থেকে আসবে ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর বাজেট ঘাটতি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও আমরা বিদেশি অর্থায়ন ও ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার পক্ষে নেই। ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বিকল্প বাজেটের ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র, বন্ড, বিদেশে বসবাসরত নাগরিক ও কোম্পানি থেকে নেওয়ার কথা বলেছি।
তিনি বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, লাগামহীন কর্মবাজার সংকোচন, মহামারি ও ইউরোপ যুদ্ধের অভিঘাত, এসব বিষয় মাথায় রেখে আগামী বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। পূর্ণ কর্ম নিয়োজন, শিশুর জন্য সুস্থ জীবন, সবার জন্য আবাসন ও মূল্যস্ফীতি রোধ-এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে অর্থনীতি সমিতি বাজেট প্রণয়ন করেছে।
আবুল বারকাত বলেন, ‘আমাদের ঘোষিত বাজেটে ২৪টি মূল পয়েন্টের উপস্থাপন করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে-বৈষম্য ও অসম দারিদ্র্য নিরসন, সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বেষ্টনী, মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ ও সঞ্চয়, রেমিট্যান্স, পুঁজিবাজার, ব্যাংক, বৈদেশিক খাত, সরকারি ঋণ, কৃষি ভূমি, ভূমি মামলা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়, প্রতিবন্ধী মানুষ, প্রকৃতি ও সরকারি অর্থের সংস্থান প্রভৃতি। বিকল্প বাজেট সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও কনফারেন্সে দেশের ৬৪টি জেলা, ১৩৫টি উপজেলা এবং ৪৫টি ইউনিয়ন থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিরা ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন।
পঞ্চাশ বছরে কালো টাকার পরিমাণ ১ কোটি ৩২ লাখ ৫৪ হাজার টাকা
অধ্যাপক বারকাত বলেন, ‘বাংলাদেশে ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরে কালো টাকা ও অর্থ পাচারের পরিমাণ হচ্ছে ১ কোটি ৪৪ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পুঞ্জীভূত কালো টাকা ১ কোটি ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ও অর্থপাচার প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা।’
এ জন্য আমরা বিকল্প বাজেটে কালো টাকাকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ, গত ৫০ বছরে কালো টাকার পরিমাণ মোট ১ কোটি ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যার মাত্র ২ শতাংশ সরকারকে উদ্ধারের প্রস্তাব করেছি। এটা যদি উদ্ধার করা সম্ভব হয়, তাহলে সরকার ২ লাখ ৬৫ হাজার ৭০ কোটি টাকা উদ্ধার করতে পারবে। আর অর্থ পাচারের মোট পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটে ওই অর্থের মাত্র ৫ শতাংশ উদ্ধার করা যায় তাহলে সরকার ৫৯ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ উদ্ধারের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান উৎস হতে পারে কালো টাকা ও অর্থ পাচারের ওই খাত।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতি সমিতির সভাপতি বলেন, কালো টাকা অর্থনৈতিক বৈষম্য কমায়। সম্পদ আরোপ করলে বৈষম্য কমায়। ধনীদের কর কমালে প্রবৃদ্ধি বাড়ে না। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কর কমালে কর্মসংস্থান হয়। আমাদের উদ্দেশ্য বিপজ্জনক বৈষম্য কমানো। বিকল্প বাজেট বাস্তবায়ন করলে ১০ বছরের মধ্যে বিপজ্জনক বৈষম্য কমানো সম্ভব।
উল্লেখ্য, এর আগে চলতি (২০২২-২০২৩) অর্থবছরের জন্য ২০ লাখ ৫০ হাজার ৩৬ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট পেশ করেছিল বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। ওই বাজেটে মোট ৩৩৮টি সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল। অভ্যন্তরীণ উৎস রাজস্ব আয় ধরা হয়েছিল ১৮ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। যেখান প্রত্যক্ষ করের উপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি কালো টাকা উদ্ধার ও পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে বাজেট ঘাটতি পূরণের কথা বলা হয়।
জেডএ/এমএমএ/