চিনি নিয়ে ছিনিমিনি, কেজি ১৬০
গ্যাসের সংকট কেটে যাওয়ায় চিনির উৎপাদন প্রায় স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছে। তারপরও বাজারে চিনি নিয়ে চলছে রীতিমতো ছিনিমিনি খেলা। সরকার খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে খোলা চিনি ১০২ ও প্যাকেটজাত চিনি ১০৮ টাকা কেজি নির্ধারণ করে দিলেও কোনো বাজারে এ রেটে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ‘সতেজ ফুড’ নামে এক কোম্পানি দেশি আখের নামে প্যাকেট চিনি ১৬০ টাকা কেজি বিক্রি করছে। এছাড়া খোলা চিনি ১১৫ টাকা বিক্রি করছে খুচরা ব্যবসায়ীরা।
মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষিমার্কেট, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন অলিগলিতে সরেজমিনে ঘুরে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।
চিনি আছে, কতো টাকা কেজি? এমন কথা বলা মাত্র কৃষিমার্কেটের মেসার্স পারভেজ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো পরভেজ এ প্রতিবেদককে বলেন, না ভাই, চিনি নেই। গোড়াতে বেশি দাম। তাই আনি না। বেশি দামে এনে বিক্রি করলে জরিমানা দিতে হয়। লাভ কি?
এর সামনেই বিক্রমপুর ট্রেডিং কর্পোরেশনে চিনি আছে বলা মাত্র বিক্রয় কর্মকর্তা জসিম বলেন, হ্যা আছে, ১৫০ টাকা কেজি। এতো দাম? বলা মাত্র তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে সাফ জানিয়ে দেন বেশি দামে কেনা। আমরা কি লোকসান করে ব্যবসা করব? চিনির পাকেটে নাম ঠিকানা আছে, দেখেন, যা বলার তাদের বলেন। তার কথা মোতাবেক ‘সতেজ ফুড’ নামে কোম্পানির প্যাকেটে দেখা যায় খুচরা মূল্য ১৬০ টাকা। ওই কোম্পানির ঠিকানা দেওয়া আছে রাধাকানাই, ফুলবাড়িয়া, ময়মনসিংহ। কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, সতেজের লোক অর্ডার কাটার জন্য ঘুর ঘুর করছে।
এক পর্যায়ে যোগাযোগ করা হয় সতেজ ফুড কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার অমিতের সঙ্গে। দর কতো? বলা মাত্র তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, দেখেন বাজারে ঝামেলা। তাই বেশি দাম। এমআরপি ১৬০ টাকা। তবে কম করে ধরা হবে, ১৩৫ টাকা কেজি। এতো কেন? সরকারতো প্যাকেটজাত চিনি ১০৮ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাহলে অনেক পার্থক্য না? উত্তরে বলেন, কতো নিবেন বলেন, বেশি নিলে একটু কম দর ধরা হবে।
এরপরই পাশের পাইকারি দোকান মোহাম্মদ আলী এন্টারপ্রাইজে জানতে চাওয়া হয় চিনি আছে, কতো দাম। মালিক মোহাম্মদ আলী সাফ জানিয়ে দেন কয়েক দিন থেকে নেই চিনি। সিটি, মেঘনা থেকে দিচ্ছে না। তাই নেই।
শুধু এই মোহাম্মদ আলীই নয় কৃষিমার্কেটের বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা এ প্রতিবেদককে অভিযোগ করে জানান, ভাই গোড়াতে ধরলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তারা চিনি দিলেও আমরা যে দামেই হোক বিক্রি করতে পারব।
পাইকারি বাজারে প্রায় দোকানে তেমন চিনি নেই। তাই মোহাম্মদপুরের বছিলা রোডে খুচরা ব্যবসায়ী পারভেজ এন্টারপ্রাইজের রুবেলের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বাজারে চিনি নেই। এটা কি সরকার জানে না। কোম্পানি বিভিন্ন অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে, সরকার কি করছে? আগে চিনির কেজি ৯৭ টাকা ছিলো, হয়ে গেল ১০৮ টাকা। তাও পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি দামেই কিনতে হচ্ছে। সিটি ও মেঘনার খোলা চিনি বেশি দামে কেনা। তাই ১১৫ টাকা কেজি বিক্রি করতে হচ্ছে। এতো কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেন, আমরা বলির পাঠা। দোকানে না রাখলে কাস্টমার ফিরে যায়, আবার বেশি দাম না দিলে পাইকারি থেকে পাওয়া যায় না।
মোহাম্মদপুর বাসষ্টান্ডের জনতা মার্কেটে আক্তার স্টোরেও চিনি আছে কি না জানতে চাইলে আক্তার হোসেন বলেন, না, চিনি নেই। পরে বলেন, আছে, তবে দাম বেশি। খোলা চিনির কেজি ১১৫ টাকা। কবে থেকে বেশি দাম, সরকারি রেট তো ১০৮ টাকা। উত্তরে তিনি বলেন, সহজে পাওয়া যায় না। তাই বেশি দামে কিনে বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে।
রাজধানীর আরেক বড় বাজার কারওয়ান বাজারে সরেজমিনে গেলে ইয়াসিন জেনারেল স্টোরের মনোয়ার হোসেন বলেন, দাম বেশি তাই রাখি না। ১৫০ টাকা কেজি চিনি বিক্রি করলে অনেক কাস্টামার রাগ করছে। সতেজ ফুডের চিনি ১৬০ টাকা রেট। কিন্তু সরকার তো ১০৮ টাকা রেটে বিক্রি করতে বলেছে। তাহলে অনেক বেশি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ কারণেই তো রাখি না।
সতেজ ফুড বেশি দাম নিচ্ছে। কোনো নিয়ম নীতি মানেনি। এই কোম্পানি কি ঠিক আছে। এমন প্রশ্নের জবাবে বিক্রমপুর ট্রেডিং কর্পোরেশনসহ অন্য খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান ‘আমরা কিছু বললে সতেজের বিক্রয় কর্মকর্তা বলেন, পণ্যের মাননিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআইসহ সবার লাইসেন্স নেওয়া আছে। এটা কোনো ভুয়া কোম্পানি না।
সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ঢাকাপ্রকাশ থেকে মঙ্গলবারই খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ময়মনসিংহের ওই ঠিকানায় সতেজ ফুড নামে কোনো কোম্পানির অস্তিত্ব নেই।
বিএসটিআইর অনুমোদন ও লোগো ব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আসলে অনেকে অনেকভাবে ভুয়ামি ও প্রতারণা করে ভোক্তাদের সঙ্গে। সতেজ ফুড আসলে অনুমোদন দিয়েছে কিনা তা দেখে বলতে হবে।
চিনি নিয়ে আসলে হচ্ছে কি? ১০৮ টাকার চিনি ১৬০ টাকা কেন? এসব তথ্য জানার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হলে মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিউজ্জামান বিদেশে থাকায় তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মাদ শাহরিয়ার এ ব্যাপারে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এটা ডাহা প্রতারণা। তিনি নিজেই অবাক হয়ে বলেন, এতো বেশি দাম। আমরা অবশ্যই অ্যাকশনে যাব। সরকারের বেধে দেওয়া রেটের বেশি কেউ কোনো পণ্য বিক্রি করতে পারবে না। এর আগেও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সাদা চিনিতে ক্ষতিকর রং মিশিয়ে ‘লাল চিনি’ নামে বেশি দামে বিক্রি করায় (২২ সেপ্টেম্বর) কাওরানবাজারে অভিযান চালিয়ে কয়েকটি দোকান থেকে ২০০ কেজির বেশি লাল চিনি জব্দ করে ধ্বংস করা হয়। সতেজ এবং গাংচিল নামে লাল চিনি বিক্রি হতে দেখে সন্দেহ হলে ভোক্তা অধিদপ্তর থেকে অ্যাকশনে নামা হয়।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সব সময় তৎপর রয়েছি। ভোক্তাদের স্বার্থে সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সাধ্য মতো চেষ্টা করা হচ্ছে মিলমালিক থেকে ডিলার, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
এর আগে মিল থেকে বলা হয়েছে গ্যাসের সংকটরে কারণে উৎপাদন কিছুটা কম হওয়ায় সরবরাহ কমে যায়। এ সুযোগে এক শ্রেণির অসাধৃ ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। ধরা পড়লে তাদের জরিমানা করা হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে মোট চিনির চাহিদা ১৮ লাখ মেট্রিক টন। রমজান মাসে দুঈ লাখ টনের মতো চাহিদা হয়। তখনই হঠাৎ করে দাম বেড়ে যায় বাজারে। দেশে ৬০ হাজার টনের মতো দেশীয় আখ থেকে উৎপাদিত হয়। বাকি চাহিদা মেটাতে আমদানি করা ‘র সুগার’। সিটি, মেঘনাসহ বিভিন্ন রিফাইনারি কোম্পানি পরিশোধন করে বাজারে বিক্রি করে। প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার টন চিনির চাহিদা। এসব কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার টনের মতো। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে গত আগস্ট থেকে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ সুযোগে অস্থির হয়ে গেছে চিনির বাজার।
এছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে ডলার সংকটও দেখা দেয়। রিফাইনারি কোম্পানি দাম বৃদ্ধির চাপ দিলে সরকার গত ৬ অক্টোবর খোলা চিনি প্রতি কেজি ৯০ ও প্যাকেটজাত ৯৫ টাকা রেট করে দেয়। যা আগে খোলা ছিল ৮৪ টাকা ও প্যাকেট চিনি ৮৯ টাকা কেজি। তারপরও কোম্পানি থেকে লোকসান হচ্ছে এমন অভিযোগ করে দাম বৃদ্ধি চাপ দিলে গত ১৭ নভেম্বর সরকার একলাফে প্যাকেট চিনির দাম ৯৫ থেকে ১০৮ টাকা ও খোলা চিনির কেজি ৮৪ থেকে ১০২ টাকা কেজি ঘোষণা করে।
তারপরও সহজে মিলছে না চিনি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক মো. তসলিম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, দেখুন সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে বাজার উন্নতি হয়েছে। গ্যাসের সংকট প্রায় কেটে গেছে। আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩ হাজার টন। বর্তমানে হচ্ছে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টন। প্রতি দিন সারা দেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। তারপরও কেন বাজারে সহজে পাওয়া যাচ্ছে না চিনি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কার কাছে এ চিনি আছে আমাদের বলা মুশকিল। কারণ ডিলাররা নেয়, তারা পাইকারকে দেয়। তারা আবার ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করার জন্য খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। আর সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন না ধরায় কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জেডএ/এএস