‘ট্যাক্স সিস্টেমে গলদ থাকায় বাড়ছে না রাজস্ব’
ট্যাক্স (কর) সিস্টেমে গলদ থাকায় রাড়ছে না রাজস্ব। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের কারণে ট্যাক্স প্রদানকারীদের ভোগান্তি কমছে না।
তাদের কারণে অনেকে বেশি সুবিধা নিলেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কম রাজস্ব দিচ্ছেন। এ জন্য কর জিডিপির অনুপাত দিন দিন কমে যাচ্ছে। সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) কর্মশালায় এমনই তথ্য জানানো হয়েছে।
রাজধানীর বনানীতে পিআরআইর সম্মেলন কক্ষে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য কনটেক্সট অব ডমিস্টিক রিসোর্স মোবিলাইজেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. জায়েদী সাত্তার বলেন, এনবিআর কর্মকর্তাদের কাজ রাজস্ব আদায় হতে পারে না। তাদের কাজ হবে করদাতাদের সুবিধার ব্যাপারে নীতি সহায়তার ব্যবস্থা করা। কারণ, টাক্স সিস্টেম যত উন্নত হবে রাজস্ব আদায়ও ততো বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্রেড ট্যাক্স খুবই কম। অথচ আমাদের দেশে তার উল্টো চিত্র। চীনে ট্রেড ট্যাক্স মাত্র ১ দশমিক ৮৫ শতাংশ হলেও আসাদের হচ্ছে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ট্রেড বৃদ্ধি না করে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না। তাই শুধু আরএমজির উপর ভর না করে অন্য পণ্যের দিকেও নজর দিয়ে করের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।
পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক ও ব্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কর বৃদ্ধির জন্য এনবিআর এর উল্লেখ করার মতো পদক্ষেপ দেখা যায় না। ব্রিটিশ আমলের কর প্রশাসনের কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। কারণ, ২০১২ সালে ভ্যাট আইন করা হলেও রাজনৈতিক কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি। বিশ্বে করদাতারা ট্যাক্স দিলেও কর গ্রহণকারীদের মুখ দেখে না।
আমাদের দেশে তার উল্টো চিত্র। করদাতারা কর্মকর্তাদের সামনে এসে সুবিধা নিয়ে থাকে। তাদের হাতে সর্বময় ক্ষমতা। পৃথিবীর কোনো দেশে এ দৃশ্য নেই। ট্যাক্স পরিশোধে ভোগান্তি কমছে না। এ কারণে কর জিডিপির অনুপাত দিন দিন কমছে। ১২ শতাংশ থেকে কমে সাড়ে ৭ শতাংশে নেমেছে। সিস্টেমের পরিবর্তন করা না হলে ভবিষ্যতে আরও কমবে, যোগ করেন তিনি।
পিআরআইর পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. বজলুল হক খন্দকার বলেন, বাংলাদেশে অনেক অর্জন থাকলেও শঙ্কা পিছু থাড়ছে না। বাংলাদেশে ট্যাক্স রেট খুবই বেশি, ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। বিভিন্ন দেশে তা ১০ থেকে ১২ শতাংশ। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) চেয়ারম্যান আরও বলেন, ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকীতে জিডিপিতে করের অনুপাত ১০ শতাংশ ধরা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে প্রত্যক্ষ কর ৩৫ শতাংশ ও পরোক্ষ কর ৬৫ শতাংশ। এটা বিপরীত করা হলে ট্যাক্স বাড়বে। কারণ পরোক্ষ করে অন্যের উপর সহজেই ট্যাক্স বৃদ্ধি করা যায়। ট্যাক্স আদায়ে একটি গোষ্ঠী সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু সার্বিকভাবে সাধারণ মানুষের লাভ হয়নি।
পিআরআইয়ের পরিচালক ড. এম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ২০৩০ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে বাংলাদেশ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ১৭টি টার্গেট পূরণ করতে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে সরকারকে অতিরিক্ত আরও ৮০০ কোটি থেকে ১০০০ হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলার জোগান দিতে হবে।
কিন্তু এই বিশাল অঙ্কের অর্থ কোনো খাত থেকে আসবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা সরকারের নেই। ফলে এসডিজি বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এসডিজি বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেট আরও বাড়াতে হবে। ইউনিসেফের মানদণ্ড অনুযায়ী একটি উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা খাতে মোট জিডিপির ৪ শতাংশ পরিমাণ বরাদ্দ থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই খাতেই বরাদ্দের হার ১ শতাংশ। এটা আরও বাড়াতে হবে।
অপরদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখতে হবে ৫ শতাংশ। আমাদের দেশে বাজেটে বরাদ্দ রয়েছে দশমিক ৭ শতাংশ। যা খুবই নগণ্য। এ ছাড়া, সামাজিক সুরক্ষা খাতেও বরাদ্দ খুবই কম। যেটাও দেওয়া হচ্ছে সেখানে রয়েছে অনিয়ম ও বৈষম্য। আব্দুর রাজ্জাক বলেন বলেন, বৈষম্যহীন এই সমাজ টেকসই হবে না। কারণ যারা পাওয়ার উপযোগী তারা পাচ্ছে না। এই বরাদ্দ বাড়াতে রাজস্ব আহরণের বিকল্প নেই।
এক্ষেত্রে বর্তমান কর ১৩ শতাংশ হারে আহরণ হচ্ছে। এটা ন্যূনতম ২০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। যারা বেশি করে সুবিধা নিচ্ছে তারা ট্যাক্স দিচ্ছে না। অপরদিকে যারা সেবা পাওয়ার কথা তারা পাচ্ছে না। তাই যথাযথ ট্যাক্স সিস্টেম চালু করতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ কর্মী বাড়াতে পারলে একদিকে এসডিজি বাস্তবায়নে সম্ভব হবে। অন্যদিকে শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নতি হবে, মৌলিক চাহিদা হিসেবে স্বাস্থ্য খাত এগিয়ে যাবে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলামসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা।
জেডএ/এমএমএ/